ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী এই গোষ্ঠীটি। মূলত গত বছরের জুলাইতে তিনি নিহত হয়েছেন।
মোহাম্মদ দেইফের নিহত হওয়ার খবর আগেই ইসরায়েল জানিয়েছিল, তবে এবার হামাসও তার মৃত্যু নিশ্চিত করল। শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, গত বছরের ১৩ জুলাই ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনিস এলাকায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় মোহাম্মদ দেইফ নিহত হন। সেই মাসেরই শেষের দিকে এ খবর প্রকাশ করেছিল ইসরায়েল।
তবে এতদিন হামাসের পক্ষ থেকে দেইফের নিহত হওয়ার বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। পরে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে দেইফের নিহতের খবর প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করে হামাস। হামাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জ্যেষ্ঠ নেতা বরাবরই প্রচার থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতেন। ঘনিষ্ট সহচররা ছাড়া তার হদিস কেউ জানতে পারত না।
এছাড়া হামাসের সামরিক শাখার উপপ্রধান মারওয়ান ইশার নিহত হওয়ার খবরও নিশ্চিত করেছে হামাস। যদিও এই কমান্ডারের নিহতের খবর গত বছরের মার্চে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
মূলত মোহাম্মদ দেইফ হামাসের সামরিক শাখা ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্ব ছিলেন। তিনি এমন একজন ছায়াময় ব্যক্তিত্ব যিনি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘দ্য মাস্টারমাইন্ড’ এবং ইসরায়েলিদের কাছে ‘দ্য ক্যাট উইথ নাইন লাইভস’ নামে পরিচিত।
বিবিসি গত বছর এক প্রতিবেদনে বলেছিল, মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে এবং ইসরায়েলিদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলের ফেরারী সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম ছিল সবার ওপরে। দেইফকে হত্যার জন্য ইসরায়েল বছরের পর বছর হন্যে হয়ে খুঁজেছে।
এর আগে ২০২১ সালে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে লড়াই চলাকালে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ইসরায়েল, কিন্তু তাকে হত্যা করা যায়নি। তখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র হিডাই যিলবারম্যান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, “এই পুরো অভিযান চলার সময় আমরা মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার চেষ্টা করেছি।”
গত দুই দশকে মোহাম্মদ দেইফকে হত্যার জন্য সাতবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল ইসরায়েল। দেইফকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীও ছিল বেশ হতাশ।
মোহাম্মদ দেইফ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি অভিনয় এবং থিয়েটার প্রতি আগ্রহের জন্য পরিচিত ছিলেন, আর সেখানে তিনি একটি শিল্পী দলও গঠন করেছিলেন। যখন হামাসের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়, তিনি বিনা দ্বিধায় এই দলে যোগ দেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৮৯ সালে গ্রেপ্তার করে, আর হামাসের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিযোগে বিনা বিচারে ১৬ মাস কাটান কারাগারে।
মোহাম্মদ দেইফ সম্পর্কে যা জানা যায়, তা মূলত ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে। এসব রিপোর্ট অনুসারে, মোহাম্মদ দেইফের জন্ম ১৯৬০ এর দশকে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন ছিল মিসরের দখলে। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহীম আল-মাসরি। বহু দশক ধরে চলতে থাকা ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কেও জানা যায় খুব কম। হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ দেইফ একজন তরুণ। ১৯৮০-এর দশকের শেষে তিনি হামাসে যোগ দেন।
হামাসের যে বিখ্যাত ‘কাসাম রকেট’, সেটির পরিকল্পনা এবং তৈরির কৃতিত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ দেইফকে। গাজার ভূগর্ভে যেসব টানেল খনন করা হয়েছে, সেগুলোও মোহাম্মদ দেইফের পরিকল্পনা। তিনি বেশিরভাগ সময় এসব টানেলের মধ্যে কাটাতেন বলেও শোনা যায়। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এখান থেকেই তিনি হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
এমএন/