|| হোসাইন আহমদ ||
আরবি একটি ঐতিহাসিক ভাষা। এর রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। কুরআনের মাধ্যমে এই ভাষা পেয়েছে অমরত্ব। হাদিসের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছে তার মর্যাদা। ফলে বিশ্বের সকল মুসলিম আরবি শেখে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য। এর সঙ্গে আরেকটি উদ্দেশ্য থাকে। তা হলো কুরআন-হাদীসকে গভীরভাবে বুঝা এবং ইসলামকে উৎসমূল থেকে জানা। পাশাপাশি সময় ও কালভেদে অনেক দেশেই ঘটেছে আরবির জাগরণ। বাংলাদেশও এই জাগরণের কাতারে দাঁড়িয়ে।
ইতিহাস বলে, আরবির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এই ভূখন্ডে ইসলাম প্রবেশের শুরু সময় থেকে। তবে সেই সম্পর্ক ছিল সীমিত পরিসরে। মানুষ তখন আরবি শিখত কেবল দ্বীনকে যথাযথভাবে পালন করার জন্য। পরবর্তীতে সময়ের প্রয়োজনে তারা কুরআন-হাদীসকে গভীরভাবে বুঝা ও ইসলামকে উৎসমূল থেকে জানার জন্যে আরবি ভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করতে শুরু করে। আরবি শিক্ষা তখন প্রাতিষ্ঠানিক আকৃতি লাভ করে। ফলে দেশে আরবি জানা অনেক লোক তৈরি হয়। এই শেখাটা ছিল ব্যাকরণ ও অনুবাদ পদ্ধতিতে। ফলে ভাষার সব দিক তাতে গুরুত্ব পায়নি।
কিছু বিষয় অবহেলার শিকার হয়। বিষয়টি নিয়ে ভাবেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক আল্লামা সুলতান যউক নদভী দা.বা.। গবেষণার পাশাপাশি তিনি কথা বলেন শিক্ষা কারিকুলামের পরিবর্তন প্রসঙ্গে। সর্বত্র আওয়াজ তোলেন নেসাব সংস্করণের। এভাবে সূচনা হয় আরবি ভাষার নীরব আন্দোলন।
এই চিন্তার সাথে মিলিত হন মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ .। তিনিও নির্দেশনা করেন নতুন পদ্ধতির। প্রস্তাবনা দেন নয়া নেসাবের। এর সাথে ধীরে ধীরে কাজের কিছু নমুনাও তুলে ধরেন। তার এই ভাষা আন্দোলন একসময় সফলতার মুখ দেখে। ভাষা শেখার নবীন শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এর স্প্রিট। শুরু হয় আরবি ভাষার নতুন জাগরণ। অভিভাবকরাও ঝুঁকে পড়েন এই নেসাব ও নেযামের দিকে। মাদরাসার পরিচালকগণও গ্রহণ করেন নেসাবের কিতাব এবং তার রীতি ও পদ্ধতি। এই জাগরণে তিনি একাই কাজ করেছেন, এমনটি কিন্তু নয়। বরং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজ অবস্থান থেকে আরো অনেকেই অবদান রেখেছেন। যেমন রয়েছেন, মাওলানা সফিউল্লাহ ফুয়াদ। তিনি নিজের জায়গা থেকে সামগ্রিকভাবে আরবি ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকে ২০০০ সাল পর্যন্ত। তারপর আরবি সাহিত্যের আরেক দিকপাল মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী রহ.-এর মাধ্যমে ঘটে আরবির জগতে নতুন বিপ্লব। সূচিত হয় আধুনিক আরবি ভাষা জাগরণের নতুন ইতিহাস। তাঁর মাধ্যমে আরবি শেখা ও শেখানো আরম্ভ হয় ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে। বারী রহ.-এর ইন্তেকালের পর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই তার এই আন্দোলনের হাল ধরেন। তাদের অন্যতম একজন হলেন শায়েখ মহিউদ্দীন ফারুকী হাফিযাহুল্লাহ। কাজে-কর্মে তার প্রতিষ্ঠান মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়া বাংলাদেশ “সবার জন্য আরবি শিক্ষা” শ্লোগানকে ধারণ করে শিক্ষিত মহলে নতুন জোয়ার সৃষ্টি করে। যেখান থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্টসংখ্যক ছাত্র আরবি ভাষায় ডিপ্লোমা করে এবং সেখান থেকে বাছাইকৃত গুটি কয়েক ছাত্রকে রাখা হয় আরবি ভাষা ও সাহিত্য গবেষণা বিভাগে; আরবি ভাষার বিশেষায়িত শিক্ষক হিসেবে দক্ষভাবে প্রস্তুত করার জন্যে। তাছাড়া মারকায সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের জন্যে অফলাইন ও অনলাইন নিয়মিত মাসিক ও সাময়িক আরবি কোর্সের আয়োজন করে। কোর্স ব্যতিত আরবি প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামেরও ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া মারকাযুল লুগার তত্ত্বাবধানে আরো অনেকগুলো মাদরাসার আরবি বিভাগ পরিচালিত হয়। আরবির এই অঙ্গনে আরো অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। মাওলানা শফিকুল ইসলাম ইমদাদীও বর্তমানে একটি সমুজ্জ্বল নাম। আরবির এই জাগরণে অফলাইনের মতো অনলাইনেও ভূমিকা রাখেন অনেকে। বিশেষত করোনা ও তার পরবর্তী সময়ে অনলাইনে ভাষা শেখার চাহিদা বৃদ্ধির পর থেকে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করারা মতো একটি নাম হচ্ছে ‘সিবওয়াই ইনস্টিটিউট’। এর প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট আরবি শিক্ষক নাজমুল হাছান। আরো রয়েছে নিবরাস একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ। অন্যদিকে ঢাকা, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে চলছে গতানুগতিকভাবে একাডেমিক কার্যক্রম।
আরবি ভাষা শেখার এই প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মাদরাসাপড়–য়াদের পাশাপাশি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। সচিবালয়, সামরিক মিশন ও দূতাবাসের কর্মকর্তা ছাড়াও সাধারণ শিক্ষিতরা এই ভাষা শেখার প্রতি ঝুঁকছে।
বাংলদেশে আরবি ভাষার এই জাগরণ আনন্দ ও সুখের। আমরা মনে করি, এই জাগরণে মুসলমানরা ইসলামি সংস্কৃতির সাথে খুব সহজেই পরিচিত হতে পারবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হবে।
শিক্ষার্থী: উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য গবেষণা বিভাগ, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ।
এনএ/