বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ।। ৩ পৌষ ১৪৩১ ।। ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬


শুদ্ধ চেতনার বাহক আরবি ভাষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| আবদুল আজিজ ||

মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ভাষা-এটি ভাষার পোশাকি পরিচয়। এর বাইরে ভাষার আরেকটি পরিচয় আছে-তা হল, ভাষা তার ভাষীদের পরিচয় বহন করে। তার আশ্রিত জাতির চিন্তা-চেতনা, রুচি-প্রকৃতি ও সংস্কৃতি ধারণ করে। যা শব্দ-বাক্যের আবরণে অন্যের মাঝে অনুপ্রবেশ করে।

ফলে যে ব্যক্তি সে ভাষাটি শিখতে চায়, সে শুধু সে ভাষার শব্দ, বাক্য বা প্রকাশভঙ্গি শেখে, তা নয়। বরং এর ভেতর দিয়ে অবচেতনে সে একটি চিন্তা ও চেতনার বাহক হয়ে যায়, যা সে ভাষার মাঝে অস্ফুটভাবে বিদ্যমান।

একটি ভাষা পুরো জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে সে ভাষাভাষীরা সবাই সমমনা হয়-রুচি, প্রকৃতি, মনন, মেধা, বুদ্ধি ও আচার-আচরণে। একইভাবে প্রতিটি ভাষার ভেতর থাকে একটি শক্তি ও চেতনা। সেই শক্তি ও চেতনা তৈরি হয় যারা এ ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এ ভাষার উত্থানে যাদের স্বেদ, রক্ত, ঘাম, মেধা ও সময় বিসর্জিত হয়, তাদের হাত ধরে। তাদের চিন্তা-চেতনায় যে ধরনের উপাদান নিহিত থাকে, ভাষা তা বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধারণ করে। সে চেতনা কখনো হয় বৈপ্লবিক, কখনো বিশ্বাসের, কখনো বস্তুবাদী, কখনো চারিত্রিক, কখনো বা এসবের মিশেলে। আরবি ভাষা বর্তমান পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত একটি ভাষা। এটি অত্যন্ত নির্মল, স্বচ্ছ, সুন্দর ও শুদ্ধ এক চেতনাকে ধারণ করে আছে। কারণ, তার মূলে রয়েছে এমন দুই উৎস, যাতে অসুন্দর ও অশুদ্ধতার বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগবার কোন সুযোগ নেই কেয়ামত অবধি।

ইসলামপূর্ব দেড়শত বছর থেকে মূলত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের একাডেমিক ইতিহাস গণনা করা হয়। সে থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর‌্যন্ত আরবি ভাষার যে রূপ ছিল, তা তৎকালীন পৃথিবীর আরব ভূখন্ডের একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে সে সময়ের সাহিত্যে যতসব অনাচার, হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও অবৈধ প্রেম-ভালোবাসা চিত্রায়িত হয়েছে। কিন্তু যখন ইসলামের রবি উদয় হল এবং তার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর দিক দিগন্তে, তখন আরবি ভাষা ও সাহিত্যও তার আলোয় প্রদীপ্ত হল। আরবি ভাষার শব্দ, বাক্য কাঠামো ও বর্ণনাশৈলী-সর্বক্ষেত্রে ইসলামের প্রভাব প্রতিফলিত হতে লাগল। সূচনা হলো আরবি ভাষার নতুন ধারা। দুর্বোদ্ধ ও কঠিন শব্দের স্থানে কোমল শব্দ স্থান করে নিল। বর্ণনাশৈলীতে এল সাবলীলতা, ঋজুতা ও মিষ্টতা। বয়ান-বক্তৃতায় যুক্ত হল নতুন আঙ্গিক। পত্রসাহিত্যে এল বিচিত্র ধরন-রীতি। এভাবে সমাজ সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে আরবি ভাষারও আমূল সংস্কার সাধন হল। ফলে আজ প্রায় সাড়ে ১৪০০ বছরের ব্যবধানেও তার গতি-প্রকৃতিতে মিশে আছে এক বিশুদ্ধ ও সরল বিশ্বাস, সুস্থ রুচি ও গভীর মূল্যবোধ।

পরবর্তীতে যারা এ ভাষাকে ধারণ করেছেন, এ ভাষায় সাহিত্য সৃজন করেছেন এবং নিজের বর্ণাঢ্য কর্ম দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, তারাও ছিলেন একেকজন জাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আদর্শে প্রবাদ পুরুষ। ফলে তাদের চিন্তা, চেতনা ও জ্ঞায় এ ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। সিবাওয়াইহ, খলিল আহমাদ ফারাহিদি, ইবনুল জিন্নি, ইবুনুল ফারিস, ইবনে খালদুন এখানে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুগেও এ ভাষার নিয়ন্ত্রণ সেসব মহান ব্যক্তিদের হাতেই হয়েছে, একদিকে যারা জ্ঞান-প্রজ্ঞায় অত্যুচ্চ; অন্য দিকে নিজের বিশ্বাস, আদর্শ মূল্যবোধের ব্যাপার দৃঢ় রক্ষণশীল। আলী তানতাবি, মুস্তফা সাদেক রাফেয়ী, আবুল হাসান আলী নদভীর নাম এখানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ফলে যারা এ ভাষা শেখে ও চর্চা করে, কুরআন সুন্নাহর নির্মল বিশ্বাস ও ইসলামের সুমহান আদর্শের স্বচ্ছ জলধারায় তারা স্নাত হয়।

চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ভাষা স্বজাতীর সংস্কৃতিরও প্রতিনিধিত্ব করে। আরবি ভাষা এ জায়গাটায় অনন্য। এ ভাষার সংস্কৃতিতে প্রতিবিম্ব হয় সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, অপরের কল্যাণ কামনার আবেদন। আরবি ভাষার সম্ভাষণ হল, ‘আসসালামু আলাইকুম’। অর্থাৎ আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। কেউ সামান্য উপকার করলেও তার জন্য বরাদ্দ থাকে- ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’। অর্থাৎ আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। সাক্ষাৎপর্বে সম্ভাষণের পরবর্তী ধাপই হলো, মুসাফাহা। আরবি ভাষায় এর জন্য রয়েছে এমন একটি কল্যাণবাক্য, যা প্রতিটি মুসলমানের মনের আরাধনা- ‘ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম’। অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে ক্ষমা করে দিন।

এভাবে যাপিত জীবনের প্রতিটি ধাপেই রয়েছে আরবি ভাষার অফুরন্ত দান, যাতে রয়েছে কেবলই শান্তি-সম্প্রীতির সুভাস, অপরের কল্যাণ প্রার্থনা, কৃতজ্ঞতার অকৃত্রিম বহিঃপ্রকাশ। এ সমাজে আজ ইংলিশের বড় কদর। শুদ্ধ উচ্চারণে এক দু’ লাইন বাংলা না পারলেও ইংলিশ শেখা যেন বিশাল গৌরবের। অভিভাবকগণ সন্তানদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম বেছে নিচ্ছেন জীবনের অঙ্কুরেই। এর ফলে নতুন প্রজন্মের ভেতর দেশীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতি আবেগ ও মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি অনাস্থা, অশ্রদ্ধা তৈরি হচ্ছে। তারা গড়ে উঠছে পশ্চিমা সংস্কৃতি, পাশ্চাত্যের অসুস্থ রুচি- প্রকৃতি ও তথাকথিত মুক্তচিন্তা নিয়ে। এটি এ সমাজের আদর্শিক পরাজয়। বাঙ্গালী সংস্কৃতির পরাজয়। ইসলাম ও মানবতার জন্য বিরাট হুমকি।

তাই মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকস্পর্শ পেতে আরবি ভাষার প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। এ ভাষার সুবাস ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। উন্নত চিন্তা, নির্মল বিশ্বাস ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে এ ভাষাকে তুলে দিতে নতুন প্রজন্মের মুখে। একটি সুন্দর সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে আরবি ভাষা হতে পারে অন্যতম নিয়ামক। কারণ, এটিই কুরআন-সুন্নাহর চাবিকাঠি। আর কুরআন-সুন্নাহ সমস্ত কল্যাণের উৎস।

শিক্ষক: আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ।

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ