রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ ।। ৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রসেনানী আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

|| মুফতি মুতীউর রাহমান রহ. ||

প্রখ্যাত আলেমেদীন, সুযোগ্য শায়খুল হাদিস, বিশিষ্ট লেখক, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, আল্লাহর প্রিয় ওলি, আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. বিগত ২৬ রবিউস্সানী মুতাবিক ৫ই জুন ২০০৫ইংরেজি রোজ রোববার দিবাগত রাতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন।

তাঁর শাহাদাতের পর থেকে আজ অবধি যত মহলে তাঁকে নিয়ে যত ধরনের আলোচনা হয়েছে ততো আলোচনা অন্য কারো মৃত্যুতে অন্তত আমি হতে দেখিনি। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর উস্তাদ, শাগরেদ, বন্ধুমহল, সহকর্মী, হিতাকাংখী, ভক্ত অনুরক্ত সর্বশ্রেণীর যত মানুষকে কাঁদতে দেখেছি, আর কারো মৃত্যুতে এত মানুষকে কাঁদতে আমি আমার এ বয়সে দেখিনি।

আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.-এর সাথে যারই সামান্যতম সম্পর্ক ছিল সেই যেন তাঁর মৃত্যুতে আপনজন হারানোর শোকে শোকাহত হয়েছে। হযরতের সবচেয়ে বড় যে গুণটি আজ সর্বমহলে আলোচনা হচ্ছে তাহলো, তাঁর প্রত্যেকের সাথে একান্ত আপন, প্রিয়জনের মত আচরণ। ফলে তাঁর পরিচিত প্রত্যেকেই মনে করতো হযরত বুঝি আমাকেই সর্বাধিক ভালবাসেন।

আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম বলেছেন, "যে হঠাৎ তাঁর প্রতি তাকাত সে ভয় পেয়ে যেতো। আবার পরিচিত হওয়ার পর যে তাঁর সাথে মিশতো সেই তাকে ভালবেসে ফেলত"। ঠিক এই নববী চরিত্রটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছিল আল্লামা ইসহাক ফরিদীর রহ. জীবনে। অনেকেই পূর্ব পরিচয় না থাকায় তাঁর সাথে কথা বলার সাহসই পেতেন না। আবার যখন একটু সাহস করে কথা বলেই ফেলতেন, পরিচিত হয়ে যেতেন, তখন তিনি তাদের সাথে এমন খোলামেলা, হাসিখুশী কথা বলতেন, প্রথম সাক্ষাতেই এক নিখাদ ভালবাসার সৃষ্টি হয়ে যেতো। আর তাঁর সাথে যারই একবার পরিচয় হয়েছে, আমরণ সে পরিচয় অটুট থেকেছে।

আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যতোগুলো স্মরণসভা, দোয়ার মাহফিল হয়েছে সবগুলোতেই আলোচকরা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন, তাঁর সেই বহুমুখী প্রতিভার কথা। সেই বহুমুখী প্রতিভার কারণেই তাঁর কার্যক্ষেত্রও ছিল ব্যাপক। মাদরাসা পরিচালনা, দরস-তাদরিস, ক্লাসে পাঠদান, লেখালেখী, রাজনীতি, সমাজসেবা, তাযকিয়ায়ে নফসসহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

সাধারণতঃ এমন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সকল ক্ষেত্রে কার্যমুখর মানুষ খুব কমই পাওয়া যায় বা যাবে। সকল ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপক অবদানের কারণেই তাঁর পরিচিতি, হিতার্থী, ভক্ত, অনুরক্ত সর্বোপরী আপনজনের পরিধিও ব্যাপক। আর সে কারণেই তাঁর মৃত্যুতে এতো অসংখ্য মানুষের শোকাহত হওয়া, এতো অশ্রু বিসর্জন। মৃত্যুর পর স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলগুলোতে আলোচক, বক্তাগণ বিভিন্নভাবে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনকে মূল্যায়ন ও চিত্রিত করেছেন।

আমি অনেকগুলো স্মরণ সভা ও দোয়ার মাহফিলে উপস্থিত থেকে সব শোনেছি। যারা তাঁকে পূর্ণাঙ্গরূপে জানেন না তাদের কাছে অনেকের বক্তব্য অতিরঞ্জন, অতিশয়োক্তি বা বাড়িয়ে বলা বলে মনে হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা তাঁকে ২/৩ যুগ করেছি তাদের মতে এসব বক্তব্য সম্পূর্ণ বাস্তব বরং অনেক বক্তব্যকেই তাঁর প্রকৃত যোগ্যতা, কৃতিত্ব থেকে কম বলা বলেই মনে হয়েছে।

আমি এ নিবন্ধে তাঁর জীবনী আলোচনা করব না। বহুমুখী প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করবো না। তাঁর বর্ণিল জীবনের শুধু একটি সমুজ্জ্বল দিক নিয়েই আলোচনা করবো। ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.- এর স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়ার মাহফিল হয়। সেখানে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ., মুফতি ওয়াক্কাস রহ., মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ., মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ., মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা শাহীনুর পাশাসহ বহু বরেণ্য উলামায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন।

প্রত্যেকেই ফরিদী রহ. সম্পর্কে আপন অনুভূতি ও মূল্যায়ন পেশ করেছেন। প্রত্যেকের বক্তব্যই যথার্থ, কিন্তু একই মূল্যায়ন অনেকের মুখে পুনঃপুনঃ উচ্চারণ হয়েছে। যে বিষয়টি সকলের চোখেই সুস্পষ্ট ধরা পড়েছে, তা সকলেই বলেছেন। কিন্তু মুফতি ওয়াক্কাস রহ. ফরিদী রহ. সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করেন। তাঁর সে মূল্যায়ন আমার অত্যন্ত মনোপূত হয়।

তিনি বলেন, "হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. এই উপমহাদেশে উপরন্তু গোটা পৃথিবীতে যে ইসলামি জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. সেই ইসলামি জাগরণের সফল অগ্রসেনানী। আল্লামা ইসহাক ফরিদীর ত্যাগী আন্দোলনের মাধ্যমে গোটা বিশ্বময় ইসলামী জাগরণ সফলভাবে সূচিত হয়েছে। তিনি আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁকে আমরা আর ফিরে পাব না। কিন্তু তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে তাঁর মাধ্যমে সূচিত ইসলামি জাগরণকে এগিয়ে নেওয়া আমাদের কর্তব্য।

মুফতি ওয়াক্কাস রহ. হযরত ফরিদী রহ. সম্পর্কে এই যে মূল্যায়ন করলেন, অনুভূতি ব্যক্ত করলেন, সেটা আর কেউ করেছেন বলে অন্তত আমি জানি না। কিন্তু এ ব্যাপারে তার সাথে কেউ দ্বিমতও পোষণ করবেন না আশা করি। কারণ, এটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা মানে দিবালোকের সূর্যকেই অস্বীকার করা। মুফতি ওয়াক্কাস সাহেবের সাথে আল্লামা ইসহাক ফরিদীর ইসলামি রাজনীতির সম্পর্ক ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মাধ্যমে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বহু পুরাতন একটি পরিপূর্ণ হক ও নির্ভেজাল দল। কিন্তু দীর্ঘকাল বাংলাদেশে তা নিষ্ক্রিয়ই ছিল। ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটি মাত্র কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সময়োপযোগী কর্মসূচি নিয়ে সফল আন্দোলন চালিয়ে যায়। অতি সম্প্রতি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও বাংলাদেশে খুব সক্রিয় ও বেগবান হয়। এই দুই ইসলামি আন্দোলনের অতি স্বল্প সময়ের কার্যকালেও আল্লামা ইসহাক ফরিদীর রহ. বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই মুফতী ওয়াক্কাস রহ. তাঁর সম্পর্কে এমন অতি মূল্যবান ও উঁচু পর্যায়ের মন্তব্য করেন।

কিন্তু যারা তিন দশকের অধিককাল হযরত ফরিদীকে কাছে থেকে দেখেছেন তারা খুব ভালো করেই জানেন, আন্দোলনের উপলব্ধির বয়স- ছাত্রকাল থেকেই তিনি ছিলেন ইসলামের নিবেদিত প্রাণ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইসলামি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে গোটা জীবনই তিনি ইসলামের জন্য বিসর্জন করেছেন। ইসলামের স্বার্থে যে কোন ত্যাগের জন্য তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন।

আমি প্রায় দুই যুগ তাঁকে অতি নিকট থেকেই দেখেছি। দেখেছি তাঁর ইসলামের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারের অতীব আগ্রহ। ছাত্র যমানায় তিনি ছাত্র ফৌজ পরবর্তীতে লাজনাতুত্তালাবার আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। যখন তিনি লাজনাতুত্তালাবার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তখন তাঁর মাধ্যমে তাঁর প্রাণান্তকর কার্যচেষ্টায় বহু ছাত্র লাজনাতুত্তালাবার সুশীতল ছায়াতলে এসে জড়ো হয়। লাজনার কর্মসূচীর মাধ্যমে হযরতের নিষ্ঠাবান প্রচেষ্টায় সেই ছাত্ররা হয়ে উঠে সার্বিক যোগ্যতা সম্পন্ন ও সুসংহত। যোগ্য অইলমেদীন, মুফতী, মুহাদ্দিস, লেখক, সুসাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ।

যারা বর্তমানে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, মসজিদে ইমামতি, লেখালেখি, ইসলামি রাজনীতি ও বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের যথাযথ খেদমত করে যাচ্ছেন। দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।

জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময়ে আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. লাজনাতুত্তালাবা ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সক্রিয় ছিলেন না। কিন্তু ইসলামের স্বার্থে যে কোন কুরবানি ও ত্যাগের জন্য তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন বলে যে কোন সাময়িক ইস্যুতে যখনই কোন আন্দোলন হয়েছে, মিটিং-মিছিল হয়েছে, অবরোধ-ঘেরাও হয়েছে সে সবের অগ্রভাগে তাঁকে অবশ্যই দেখা গেছে। তিনি তাঁর উস্তাদ ও মুরুব্বীদের নেতৃত্বে নিজের ছাত্র ও ভক্তদের নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচীতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।

সালমান রুশদী বিরোধী আন্দোলন, খতমে নবুওয়ত আন্দোলন, তাসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এমন আরো শত সাময়িক দুর্বার আন্দোলনে কখনো তিনি পিছিয়ে থাকেন নি।

আমাদের আকাবির আসলাফ যে সকল দল, মত, মতবাদ, মতাদর্শ সম্পর্কে ভ্রান্ত বলে ফতোয়া দিয়েছেন আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. কখনো তাদের সাথে আপোস করেন নি। তাদের সাথে মিলে কাজ করার চিন্তাও করেননি। এটা তাঁর রাজনীতির একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। স্বাতন্ত্র, স্বকীয়তা। আমাদের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষণীয় বিষয়। জামায়াতে ইসলামির কথাই ধরুন। জামায়াতে ইসলামির অনেকেই হযরতের কাছে আসতেন। কেউ একান্ত ব্যক্তিগত কাজে। কেউ তাঁকে তাদের দলীয় কোন কর্মসূচিতে দাওয়াত দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে।

হযরত এমন অনেককে একাধিক বার বলছেন, আমি সামনে থেকে নিজ কানে শোনেছি। আপনারা মাওলানা মওদুদির ভ্রান্ত আকিদাগুলো পরিহার করুন। সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘোষণা দিন। তাহলে আমরা আপনাদের সাথে কাজ করতে সম্পূর্ণ রাজি। আর তা না করতে পারলে কোন কালেই আমরা আপনাদের সাথে এক সঙ্গে কাজ করতে পারব না।

কারণ, আকিদার প্রশ্নে আমরা আপোষহীন। এ ব্যাপারে আমরা কোন ছাড়ই দিতে রাজী নই। জামায়াতে ইসলামির লোকেরা নিরাশ হয়ে চলে গেছে। হযরত তাঁর অবস্থানে অনঢ় থেকেছেন। হযরত ফরিদীর রহ. কুমিল্লা কাসিমুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন।

তখনকার একটি ঘটনা বলি। আলাউদ্দিন ষ্টোরের মালিক আলাউদ্দিন ভাইয়ের সাথে হুজুরের সম্পর্ক ছিল। তিনি মাদরাসায় হুজুরের কাছে মাঝে মধ্যেই আসতেন। হুজুরও মাঝে মধ্যে তার বাসায় যেতেন। একদিন তার বাসায় বসে আলাপ চারিতায় মওদুদিবাদ নিয়ে উভয়ের মধ্যে তুমুল বিতর্ক বেধে গেল। মওদুদি সাহেবের বিভ্রান্তিসমূহ সম্পর্কে হুজুর আলাউদ্দিন ভাইকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আলাউদ্দিন ভাই হয়তো প্রমাণ চাইলেন, হুজুর তার বাসা থেকে সাথে সাথে রিক্সায় মাদরাসায় চলে এলেন। হুজুরের অনেক কিতাব। সেসব কিতাবের সমাহার থেকে মওদুদিবাদ সম্পর্কিত কিতাবগুলো পৃথক করলেন। এরপর ২/৩ জন ছাত্রকে সাথে নিয়ে কিতাবগুলো নিয়ে আলাউদ্দিন ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।

হুজুর তখন বললেন, আজ হয়ত আলাউদ্দিন ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যাবে। অথবা আরো গাঢ় হবে। বাসায় গিয়ে তাকে মওদুদির বিভ্রান্তির সকল দলিল-প্রমাণ কিতাবাদি খুলে খুলে দেখালেন। আলাউদ্দিন ভাইও আপাততঃ সেদিনকার মত হুজুরের কথাই মেনে নিলেন। অন্তর থেকে মানলেন কি না কে জানে।

হযরত তাঁর প্রথম আলোড়ন সৃষ্টিকারী, নন্দিত, সর্বজন গৃহীত, বহুল বিক্রিত, যুগান্তকারী পুস্তক, "বাতিল যুগে যুগে" বইটিতে মওদুদিবাদসহ অন্য আরো অনেক ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ আলোচনা করেছেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসায়হুজুরের সভাপতিত্বে আমার পরিচালনায় মওদুদি মতবাদ সম্পর্কে ছাত্রদের জন্য প্রশিক্ষণমূলক আলোচনা হয়েছে।

এ রকম অনেক ঘটনা প্রমাণ করে যে, আল্লামা ইসহাক ফরিদী কখনই ভ্রান্ত মতবাদের অনুসারী দলগুলোর সাথে রাজনীতির ক্ষেত্রে কোন আপোস, আঁতাত করেন নি। এলাকায়ও তাঁর অনেকগুলো সংগঠন ছিল। সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সমাজ ও জনকল্যাণমূলক বহু কাজের পাশাপাশি সরলমনা মুসলমানদের ঈমান আকিদার সরঞ্জাম বাতিল দল, মত বিশেষভাবে বিদ'আতের প্রতিরোধে সফলভাবে কাজ করে গেছেন।

হযরত প্রায়ই বড় গর্ব করেই বলতেন, আমাদের কাছে যারা পড়েছে, সংশ্রবে যারা থেকেছে, তারা বাতিলকে চিনতে ও পরিচয় করতে পারার এক আশ্চর্য যোগ্যতা অর্জন করেছে। ফলে তারা সহজে বাতিলকে চিনে ফেলে। এ জন্য এরা আর যাই করুক বাতিলের সাথে হাত মিলায় না। হযরত যখন যে মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন তখন সেখানকার সকল ছাত্রকেই বাতিল সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করতেন। এ সম্পর্কে প্রশিক্ষণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। ছাত্রদের হাতে কলমে জ্ঞান দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট পুস্তকাদি পড়তে দিয়েছেন।

আমি হুজুরের পরামর্শ ও সাজেশন অনুযায়ী ছাত্রকালেই শুধুমাত্র মওদুদিবাদ সম্পর্কে হুজুরের সংগৃহীত পুস্তকাদি থেকে ৩০০০/ তিন হাজারের অধিক পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করেছি। যা এ বিষয়ে আমার জ্ঞানের ভিত্তি। পরবর্তীতে অবশ্য আমি দারুল উলুম দেওবন্দ-এ ইফতা অধ্যয়নরত অবস্থায় পাঁচটি বিষয়ের উপর যে 'মুহাজারা' বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি, তন্মধ্যে 'মওদুদিবাদের প্রতিরোধ অন্যতম।

হযরত দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ ছাত্রদের যখন উপদেশ দিতেন, হাদিসের সনদ দিতেন তখন আকিদার প্রতি অতীব গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি বলতেন, যতদিন যতক্ষণ তোমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদার উপর থাকবে ততদিনই আমার সাথে সম্পর্ক থাকবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা থেকে ছিটকে পড়লে, বিচ্যুত হলেই কিন্তু তোমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। হাদিসের ইজাযত সনদ বা অনুমতি থাকবে না।

আমি সব সময়ই হযরতকে আকিদার ব্যাপারে বড় কঠোর, সংরক্ষণশীল, যত্নশীল পেয়েছি। আকিদার প্রশ্নে তিনি উদ্বিগ্ন, চিন্তিত পেরেশান হতেন খুব তাড়াতাড়ি।

হযরত মুহাম্মদ সা. একদিন হুজুরা থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলেন সাহাবায়ে কিরাম তাকদির সম্পর্কে আলোচনা করছেন। এতে তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেল। যেন পাকা ডালিমের লাল লাল দানাগুলো নিংড়ে রসগুলো হযরত সা.-এর চেহারায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি উদ্বিগ্ন, রাগান্বিত স্বরে বললেন, তোমাদেরকে কি এ জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? না আমাকে এ জন্য পাঠানো হয়েছে? আকিদার ব্যাপারে নবীজির সা. উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তা আমি আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন হযরত ফরিদীর রহ. ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি।

হযরত ফরিদী রহ. ইসমতে আম্বিয়া সম্পর্কেও বই লিখেছেন। আর সব শেষে তো ইসলামি আকিদা নামে আকিদার একটি প্রামাণ্য পুস্তক রচনা করেছেন। যা পড়ে ছাত্র শিক্ষক, গবেষক, সাধারণ মানুষসহ সকল শ্রেণীর মানুষই প্রভূত উপকৃত ও কৃতার্থ হয়েছে-হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ্। বাতিলের সাথে হযরতের আপোষহীনতা, আকিদার প্রশ্নে কঠোর অবস্থানের এমন আলেখ্য, তাঁর জীবনময় ভুরি ভুরি।

শহীদ আল্লামা ইসহাক ফরিদীর ইসলামি রাজনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল নিরবচ্ছিন্নতা, নিরলসতা। অনেক আন্দোলন হঠাৎ তুঙ্গে উঠে চাঙ্গা ও গরম হয়। আবার কদিন পর ঠান্ডা হয়ে যায়, ঝিমিয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী মর্দে মুজাহিদদের শীতে পেয়ে যায়। অনেক দিন তাঁদের আর মাঠে ময়দানে, কাজের অঙ্গনে খুঁজে পাওয়া যায় না। একেবারে লাপাত্তা। এমন আন্দোলন ফলপ্রসূ হয় না। বা খুব কমই হয়।

হযরত ফরিদী রহ. নিরলস, নিরবচ্ছিন্ন সদা তৎপর কর্মচঞ্চল ইসলামি রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। এটা শুধু একটা দাবীই নয় বাস্তবতাও বটে। সপ্তাহের যে কোন দিনে, বছরের যে কোন মাসে সর্বোপরি দিনের যে কোন সময়ে তিনি যে কোন কর্মসূচির আহবানে সাড়া দিয়েছেন। ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটির কথা বলুন, আর জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কথাই বলুন, দলের প্রাণস্পন্দন সর্বদা এক হালে রাখার জন্য তিনি সময়োপযোগী বিভিন্ন কর্মসূচির প্রস্তাব দিতেন। দলের মুরুব্বীরাও তা বিবেচনা করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানতেন।

নির্মোহ, নির্লোভ এবং খাঁটি ইসলামি রাজনীতি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. কে অপরাপর রাজনীতিকদের মাঝে স্বাতন্ত্র মন্ডিত করেছিল। গোটা পৃথিবীতে-ই রাজনীতি এখন একটি আয়ের উৎস, উপার্জনের মাধ্যম, পার্থিব উন্নতির সিড়ি বিবেচিত হচ্ছে। যারা রাজনীতি করেন, তারা মখে দেশ জাতি, রাষ্ট্রের কল্যানের কথা, জনগনের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তারা নিজের ধান্ধা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।

রাজনীতি করে ক্ষমতায় যেতে পারলেতো আর কোন কথাই নেই। নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাতারাতি তাদের জীবন যাপনের মান ও চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। হযরত ফরিদী রহ. কে আমি একেবারে কাছ থেকেই দেখেছি। তাঁর রাজনীতি ছিল একেবারেই নির্মোহ, নির্লোভ। তিনি জীবনের শেষ দিকে নিজের অতি কষ্টার্জিত অর্থ-কড়ি রাজনীতির পিছনে ব্যয় করেছেন। বিনিময়ে পার্থিব কিছুই পান নি। আশাও করেন নি।

আর এ কথাটি শুধু আমি কেন, তাঁকে যারা ভালভাবে জানেন, তাঁর সম্পর্কে সম্যক অবগত, তাঁর সাথে বিভিন্ন কর্মসূচীতে একসাথে কাজ করেছেন, একসাথে উঠাবসা, চলাফেরা করেছেন, তারা সকলেই এ কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করবেন বলে বিশ্বাস করি।

প্রকৃত কথা হচ্ছে, হযরত ফরিদী রহ. শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা পৃথিবীতে খেলাফত আলা মিনহাজিন্নবুয়‍্যাহ, খোলাফায়ে রাশেদার শাসনের মত ইসলামি সুশাসন, ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নই তাঁকে তাঁর প্রতিটি কাজে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রেরণা যোগাত। সেই প্রেরণাই তাঁকে সুস্থ-অসুস্থ, ব্যস্ত, অবসর, শংকাযুক্ত, শংকামুক্ত, নিরাপদ, অনিরাপদ দিবারাত্রি যে কোন সময়, যে কোন অবস্থায়, ইসলামের প্রয়োজনে যে কোন স্থানে, যে কোন মহান পবিত্র কাজে টেনে নিয়ে গেছে। আমাদের সামনে তিনি প্রায়ই এই স্বপ্নের কথা বলতেন।

আমরা তাঁর কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শোনে বুঝতাম তাঁর মনে কত বড় আশা। মাঝে মধ্যেই বলতেন, যদি দেশে ইসলামি হুকুমত থাকত, বা কখনো যদি ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা হয়, তাহলে তোমরা মুফতিরা মন্ত্রীর মত সম্মান পাবে। হয়ত, সুপ্রিমকোর্টের বিচারকই হবে।

প্রসঙ্গতঃ কখনো হযরত আলী রা.- এর কাযা-বিচারকার্যের বিভিন্ন কালজয়ী ঘটনাও বলতেন। তিনি বলতেন, রাজনীতিই ইসলাম নয়, রাজনীতিও ইসলাম। খলিফা নির্বাচন করা মুসলমানদের উপর ফরয। আমরাতো সে ফরয আদায় করছি না। এ জন্য আমাদের গুনাহগার হতে হবে। এই মর্মবেদনা কয়জনের পাওয়া যায় বা যাবে?

-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ