শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ।। ২ কার্তিক ১৪৩১ ।। ১৫ রবিউস সানি ১৪৪৬


সমকাল বিজয়ী এক অভিযাত্রী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

|| মুজাহিদ হুসাইন ইয়াসীন ||

ইতিহাসের গতিপথে যে কেউ উঠতে পারে না। কারণ, তার গতি অতি দুরন্ত। শ্লথ গতির কেউ এখানে ঠাঁই পায় না। জোর করে কেউ আশ্রয় নিলে খসে যেতেও সময় লাগে না তার। স্বীয় সবুজ জমিনকে নিখাদ বিশ্বাসে উর্বর রাখতে ইতিহাসের এই অমোঘতা পালন ছাড়া উপায় নেই।

গলিপথ বা গোলক ধাঁধা তৈরি হওয়ার মতো ক্লেদাক্ত বালির স্তূপ তার সমতল ভূমিতে একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। থাকে সে তার স্থায়ী ভূমিতে, রোপণ করবে তার জন্যে, তালিকাভুক্তির জন্যে এবং তাকে প্রস্তুত রাখতে হয় সন্তোষজনক ব্যাখ্যার বহু ...... মালা। যে ব্যাখ্যার দৃঢ়তায় তীক্ষ্ণ চোখের পর্যবেক্ষক গবেষক ও সমালোচকের তর্জনি নতমুখী থাকতে বাধ্য।

ইতিহাস তার এই অলংঘনীয় ধারাকে বজায় রেখেই পূর্ণ সমীহ জ্ঞাপন পূর্বক স্থান করে দিয়েছে আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. কে। বরং তাঁর মতো দিকপাল ও নক্ষত্রখচিত ব্যক্তি উপাখ্যানকে আশ্রয় করে ইতিহাসের কাল-স্তম্ভ আরো মজবুত হয় এবং নিজের সাদামাটা অস্তিত্বকে স্বর্ণাভ আলোকচ্ছটায় করতে পারে সুশোভিত তাহলে দাঁড়ালো, আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. একটি কালের বা শতাব্দীর কিংবদন্তি এক পুরুষ।

কিংবদন্তি শিল্পী লেখার প্রথম বাক্যেই লেখা যেতো, তখন এটা হয়ে যেতো গতানুগতিক ধারার কোন শব্দ আরোপ করা। অতিমাত্রায় তর্কবিশ্বাসী কিছু লোক আছে যারা প্রভাতের সূর্যালোকে ও ঘনকুয়াশা আবিষ্কার করে আত্মতৃপ্তি পায়। অবশ্য এদেরকে এড়ানোরও প্রয়োজন নেই। এরা সর্বত্রই অনাহুত।

কারণ, শতাব্দী অন্তর অন্তর আল্লামা ইসহাক ফরিদীরা এসে তাদের কালের দিনলিপিকে সতেজপ্রাণ করে দিয়ে যান। আর করে দিয়ে যান অপঠিত ইতিহাসকে বহুল পঠিত ইতিহাসে। এর বড় কারণ তার সামগ্রিক জীবনটাই যে কোন সমাজের জন্য অনুকরণীয় ইতিহাস।

শুধু এ জন্যে লিখতে চেয়েছিলাম তাঁর সংক্ষিপ্ত সাহিত্য জীবন নিয়ে। কিন্তু তাঁর ঐ জীবনটার চতুর্দিক এমন বিপুল উৎকর্ষতায় আবরিত এবং এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে সাজানো যেন তা কুদরতেরই এক বিরল বিন্যাস।

আরো এ জন্যেই তার সাহিত্য জীবনটা আর দশজন সাহিত্যিকের মতো নয়। কথায় আছে, এক সঙ্গে দুই নৌকায় পা দিলে পা ফসকে জলমগ্ন হয়ে নির্ঘাত মৃত্যু। আর তিনি শুধু দুই নৌকা নয়; বরং পঞ্চকূলের পাঁচ নৌকায় পড়ে শেষ পর্যন্ত দারুণ সফলতায় তীরবর্তী হতে পেরেছেন। তালে পরিবাহিত সেই পঞ্চ নৌকার এভাবে গোত্রীয় নাম দেয়া যায়:

এক. শিক্ষকতা, ইমামতি, খতিবি।

দুই, রাজনীতিক, সাংগঠনিক, মসজিদ, মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা।

তিন, লেখালেখি।

চার, বক্তৃতা ও ওয়ায-নসিহত।

পাঁচ, ইহতিমামি।

শিক্ষকতা, ইমামতি ও খতিবি এক সঙ্গে করেও অনেকে রাজনীতি বা লেখালেখি করেন। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সমভাবে সফল; এমন কারো নাম আমাদের খুব একটা জানা নেই। সবাই জানেন, শিক্ষক হিসেবে আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, যেখানে বিচরণ করার মতো অভিযাত্রী তার সমসাময়িকদের মধ্যে হাতে গোনা।

অন্যদিকে আবার রাজনীতিক হিসেবে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্টতা সর্বদলে, সর্বমহলে তাঁকে দারুণ আহুত আদৃত রেখেছে সবসময়। 'সত্যপন্থীদের যে কোন মূল্যে ঐক্যে' এ ছিল তার রাজনীতির মূল আহ্বান। এখানেও তিনি সফল, স্ব- মহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

সারাদেশে তাঁর ওয়ায-নসিহত ও বক্তৃতার খ্যাতিও কম ছিল না। তাঁর বক্তৃতাস্থলে সবধরনের শ্রোতা তো বটেই; গবেষক, লেখকরাও বহু কাংখিত তথ্যমালা নিয়ে ফিরে যেতে পারতেন। এতো ক্ষেত্রে সফল হয়ে মুহতামিম হিসেবে তার সাফল্য শতভাগেরও ওপরে। একেবারে অখ্যাত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম যে আজ দেশবাসী সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্মরণ করে, তার পেছনে আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. এর অনবদ্য অবদানের কথা কে না জানে।

এতগুলো সাফল্যের পালকে কারো মাথা খচিত হলে তাকে সবাই বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করতে বাধ্য। কিন্তু আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. যে তার এই বিরলত্বও অতিক্রম করে গেছেন! এতোসবের পরও তিনি লিখেছেন এবং অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য রেখে গেছেন অতি প্রয়োজনীয় এবং বিশাল রচনাসমগ্র।

অবিশ্বাস্য এ কারণে যে, মাত্র ১৯৮৩ সনে কুরবানির ইতিহাস সম্পর্কিত তার প্রথম বই। আর ২০০৫ সনের মধ্যপর্ব পর্যন্ত তার লিখিত বই সংখ্যা দাঁড়ায় সত্তরের অধিক। এর মধ্যে আছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বড় বড় বেশ কয়েকটি অনুবাদ, গবেষণা ও সম্পাদনাকর্ম।

অথচ অনেক বড় বড় লেখকও নিজেদের লেখালেখির জন্য স্ব স্ব পেশাকে বিসর্জন দিয়েছেন। তবুও ইসহাক ফরিদী রহ. বিশ-বাইশ বছরের অতি ক্ষুদ্র সময়ে যে কাজ করে গেছেন তারা আরো কয়েকগুণ বেশী সময় পেলেও তা করতে পারবেন কি না সন্দেহ।

ইসলামের এমন কোন অঙ্গন নেই যেখানে তাঁর কলম ঝলসে উঠেনি। কুরআন, হাদিস, ফিকহ, সংস্কৃতি, দাওয়াত, দা'ঈ, ইতিহাস, তাসাওউফ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যাংকিং, কোন্ বিষয়ে তার পূর্ণাঙ্গ রচনা নেই? শুধু বাংলা নয়, আরবী-উর্দুতেও তাঁর স্বতন্ত্র রচনা রয়েছে।

তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সর্বমহলের পাঠকের জন্য পাঠযোগ্য ভাষা। অর্থাৎ, আটপৌঢ়ে ভাষার মধ্যে বর্ণনা ভঙ্গিতে হালকা কারুকাজসহ নির্ভয়ে গদ্য রীতি পাঠককে সহজেই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। তাত্ত্বিকতা, তথ্যের নিরলস গাঁথুনি আহরণের পর পাঠককে তাই মোটেও ক্লান্তিতে পড়তে হবে না। অর্থাৎ, তাঁর রচনা ছন্দোবদ্ধও নয়, আবার কোথায়ও ছন্দ পতনের আভাসও নেই। বক্তৃতা নদীর মতো স্বচ্ছ-গতিময়।

বছর দশ/বারো বছর আগে তেজগাঁওস্থ পি ডব্লিউ ডি জামে মসজিদের প্রাঙ্গণে এক সভায় প্রধান অতিথি ও প্রধান বক্তা হিসেবে নিমন্ত্রিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম নজরুল রসিক, কবি, সমালোচক, দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক রুহুল আমীন খান। অনুষ্ঠান শেষে আলিমগণের সাহিত্য চর্চা নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন।

এক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রবাদ প্রতিম দার্শনিক, লেখক, সাহিত্যিক, আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ-এর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম কবি রুহুল আমীন খানকে। কবি রুহুল আমীন খান আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ সম্পর্কে দু'একটি উচ্ছসিত মন্তব্য করে বললেন, মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ নয়, ফরিদী সাহেবের কথা বলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, ইসহাক ফরিদী সাহেব? বললেন, 'হ্যাঁ, তাঁর লেখায় দারুণ গতি আছে। আমাদের মধ্যে তার সাথে কারোর তুলনা হয় না। তিনি অনেককে ছাড়িয়ে যাবেন। আর এতো ধৈর্যসম্পন্ন ও নিরলস লোক কমই আছে। সত্যিই তার গতি-ক্ষিপ্রতা এমন দুর্বার ছিল, যেন হাজার অশ্বপালের মাথায় করে তিনি ছুটছিলেন এবং অতিক্রম করে গেছেন তার সমকালকে কয়েক মনযিল দূরে রেখে।

সময়ের চরাচরে তাঁর যাপিত পরিসর কতই না ক্ষুদ্র ছিল, অথচ এতেই রচনা করে গেছেন সহস্র মনযিলব্যাপী বিস্তীর্ণ পথ-পরিক্রমা।

-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ