বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৯ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২৫ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

দেহব্যবসা নিষিদ্ধ করার পেছনে ইসলামী দর্শন


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
সংগৃহীত

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব

ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতা, পবিত্রতা এবং মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এই দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হলো—মানব শরীর ও যৌনতা যেন সীমার মধ্যে থাকে এবং তা যেন সমাজের সুস্থতা ও ভারসাম্য রক্ষা করে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলাম পতিতাবৃত্তি বা দেহব্যবসাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তা হারাম কর্ম হিসেবে গণ্য করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে রয়েছে একাধিক গভীর হিকমা বা উদ্দেশ্য।

১. মানব মর্যাদা ও নারীর সম্মান রক্ষা

ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী মনে করে। নারীর দেহকে বিক্রয়যোগ্য পণ্য বানানো, তাকে কেবল ভোগের বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা, তার সম্মানহানিকর জীবন বেছে নিতে বাধ্য করা—সবই ইসলামী মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন: “আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।”
(সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ৭০)

পতিতাবৃত্তি নারীকে মর্যাদাশূন্য করে তোলে, তাকে দেহব্যবসার এক ঘৃণিত যন্ত্রে পরিণত করে। ইসলাম এই অন্যায় বন্ধ করে তাকে সম্মানিত জীবনে ফিরিয়ে আনার পথ দেখায়।

২. জিনা এবং যৌন অবাধ্যতা প্রতিরোধ

পতিতাবৃত্তি মূলত জিনার একটি প্রকাশ্য রূপ। অথচ ইসলাম স্পষ্টভাবে জিনাকে হারাম ঘোষণা করেছে এবং তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে: “আর জেনার কাছেও যেয়ো না। এটা অত্যন্ত অশ্লীল কাজ এবং কতই না নিকৃষ্ট পথ।”
(সূরা ইসরা, আয়াত ৩২)

জিনা সমাজে ব্যভিচার ছড়ায়, পরিবারের বন্ধন দুর্বল করে, সন্তানদের অধিকার নষ্ট করে এবং নৈতিকতাকে ধ্বংস করে। পতিতাবৃত্তি এই ক্ষতিকর পথকে আরও বৈধতা দেয় এবং সমাজে ব্যাপকভাবে অনৈতিকতা ছড়ায়।

৩. পরিবার ও সমাজব্যবস্থার স্থিতি রক্ষা

পরিবার হচ্ছে সমাজের মূল ভিত্তি। পতিতাবৃত্তি পরিবারব্যবস্থার জন্য এক মারাত্মক হুমকি। এটি মানুষের বৈবাহিক জীবনে অনাস্থা তৈরি করে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায় এবং গোপন সন্তান ও অবৈধ সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটায়, যা শেষমেশ পরিবার ভেঙে দেয়।

৪. অসুস্থতা ও সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধ

পতিতাবৃত্তি কেবল নৈতিক ক্ষয়ই নয়, বরং শারীরিক রোগ ও মানসিক দুর্বলতারও অন্যতম উৎস। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যেমন নানা যৌন রোগের ঝুঁকিতে থাকে, তেমনি তাদের মাধ্যমে সমাজেও এসব রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই জন্যই ইসলাম মানুষকে এমন অনৈতিক ও বিপজ্জনক পথ থেকে দূরে রাখে।

৫. অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

অনেক নারী বা পুরুষ অর্থনৈতিক চাপ, দারিদ্র্য, অথবা পারিবারিক বাধ্যবাধকতার কারণে পতিতাবৃত্তিতে নিপতিত হন। ইসলাম এই শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সম্মানজনক জীবিকার পথকে উৎসাহিত করে। ইসলামে নারীর উপার্জন বৈধ এবং সম্মানজনক—পতিতাবৃত্তির মতো অসম্মানজনক কিছু নয়।

৬. মানব পাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অবস্থান

পতিতাবৃত্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মানব পাচার, শিশু শোষণ, এবং নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও সহিংসতা। এই অপরাধগুলো মানবতাবিরোধী। ইসলাম এসব শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয় এবং চায় যেন সমাজে সকল ব্যক্তি নিরাপদ ও সম্মানিত জীবনযাপন করতে পারে।

ইসলাম পতিতাবৃত্তিকে হারাম ঘোষণা করেছে কেবল যৌন সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়, বরং মানুষের মর্যাদা, সমাজের শৃঙ্খলা, পরিবারের স্থায়িত্ব এবং নৈতিক পরিবেশ রক্ষা করার জন্য। এটি একটি ঐশী হিকমা যা মানুষকে নিচু প্রবৃত্তির দাস না বানিয়ে তাকে সম্মানিত জীবনের পথে পরিচালিত করে।

তাই একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত—এই ঘৃণিত পেশা থেকে নিজেকে এবং সমাজকে দূরে রাখা, যারা এই পথে বাধ্য হচ্ছেন তাদের জন্য সহমর্মিতা ও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা, এবং ইসলামী মূল্যবোধকে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া।

লেখক :মিডিয়া রিসার্চার, ইসিএসএসআর, সংযুক্ত আরব আমিরাত

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ