|| আদনান মাসউদ ||
গত (১৬ এপ্রিল বুধবার) রাতে যখন হুজুর আমাদের উত্তরার জামিয়াতুল মানহালে এসে পৌঁছেন তখন রাত সাড়ে বারোটা। বাদ আসর হুজুরের প্রথম প্রোগ্রাম ছিল–সমমনা ইসলামি দলগুলোর বৈঠক। বাদ মাগরিব–বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের মতবিনিময়। বাদ এশা–বায়তুল মুমিন মাদরাসায় ইফতিতাহ। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম থাকায় সেখানে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে মাদরাসাতুল হিকমাহর ইফতিতাহি দরস।
সারাদিনের নিয়মতান্ত্রিক সকল জিম্মাদারি, এরপর এতগুলো প্রোগ্রাম। রাত বাজে সাড়ে বারোটা। ক্লান্তির সুস্পষ্ট ছাপ হুজুরের চেহারায়।
এদিকে মানহালের তাকমিল, মেশকাত, ইফতা এবং আদবের তালিবুল ইলমরা হুজুরের দরসের অপেক্ষায়। হুজুর যখন দাওরায়ে হাদিসের রুমে প্রবেশ করছেন, আমি ভাবলাম–হয়তো সর্বোচ্চ ১৫-২০ মিনিট কিছু কথা বলবেন। জামিয়ার রঈস মুফতি কিফায়াতুল্লাহ আযহারী হাফি. বললেন–রাত অনেক গভীর হয়ে গেছে। হুজুর কিছু নসিহত পেশ করবেন।
হুজুর বললেন, ছেলেরা কিছু পড়বে?
আমার মন উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। যাক, তাহলে হুজুরের তাকরির শোনা যাবে। তালিবুল ইলম সহিহ বুখারির প্রথম হাদিসের মতন পাঠ করলো।
হুজুর কথা শুরু করলেন, ভাঙা ভাঙা গলায়। আলোচনা শুরু হলো ‘সহিহ’ শব্দ নিয়ে। ‘সহিহ’ শব্দের ইত্বলাক যেমনিভাবে হাদিসের ওপর হয়, তেমনিভাবে কিতাবের ওপরও হয়। বুখারি-মুসলিমকে কেন সহিহাইন বলে? ছয় কিতাবকে ‘সিহাহ সিত্তাহ’ বলা মুনাসিব? নাকি ‘কুতুবে সিত্তাহ’ নাকি ‘উসুলে সিত্তাহ’? বুখারি কেন সহিহ আবার জামে’ও? মুসলিম কি জামে’ নাকি জামে’ নয়?
এসব ফন্নি আলোচনার মধ্য দিয়ে হুজুর কথা শুরু করলেন ইমাম বুখারির তারাজিমুল আবওয়াব নিয়ে। ‘ফিকহুল বুখারি ফি তারাজিমিহি’। এরপর শুরু হলো আজকের দরসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক পর্ব। মুখাত্বাব তালিবুল ইলমদের মনোযোগ এবং স্বপ্রতিভ উত্তর ততক্ষণে হুজুরের ক্লান্তি যেন মুছে দিয়েছে।
হুজুর আলোচনা শুরু করলেন শাইখুল হাদিস যাকারিয়া রহ. এর ‘আল আবওয়াব ওয়াত তারাজিম’ নিয়ে। লামিউদ্দারারি এবং তাকরিরে বুখারির সাথে তালিবুল ইলমদের তাআরুফ করালেন। শায়খ আব্দুল হাফিজ মক্কী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে 'আল কানযুল মুতাওয়ারি' সংকলনের বৃত্তান্ত তুলে ধরলেন। ফয়জুল বারি রচনা, কাশমিরি রহ. এবং বদরুল আলম মিরাঠি রহ.-এর আলোচনা টানলেন। পরিচয় করালেন– ফাতহুল বারি, উমদাতুল ক্বারি এবং ইরশাদুস সারির সাথেও।
এরপর বললেন, আরেকটা শরাহ আছে ‘ফজলুল বারি’। শাইখুল ইসলাম শাব্বির আহমাদ উসমানী রহ.-এর তাকরির। যা লিপিবদ্ধ করেছেন শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। অনবদ্য সে ইতিহাস তুলে ধরলেন। কী মনোমুগ্ধকর উপস্থাপন। উস্তাজের প্রতি শাগরিদের একনিষ্ঠতা এবং আত্মনিবেদনের ইতিহাস...
আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন দেড়টা পেরিয়ে গেছে। আমি ভাবছিলাম-ছাত্র জমানার মতো যদি এখনো প্রতিদিন হুজুরের দরসে শরিক হতে পারতাম...
পরিচিতজনদের একটা কথা আমি বারবার বলি–মাওলানা মামুনুল হককে এ প্রজন্ম যেন শুধু আন্দোলনের সিপাহসালার মনে না করে। আন্দোলন সংগ্রামের আগে তাঁর প্রথম পরিচয়–তিনি একজন মুহাদ্দিস। যাঁর রক্ত-মাংসে, রগ ও শিরায় মিশে আছে দরসে হাদিস। হাদিসের দরসে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি তাকরির করে যাবেন, ঘণ্টা থেকে ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে... তালিবুল ইলমরা ইস্তিফাদা করতেই থাকবে...
আল্লাহ তায়ালা আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাজে মুহতারামের নেক হায়াতে, উলুমে এবং আমালে খুব বরকত দান করুন। সিহহাত ও আফিয়াত নসিব করুন। উম্মাহর ব্যাপক থেকে ব্যাপক খেদমতে খুব কবুল করুন। হিংসুকে হিংসা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক: উস্তাজুল হাদিস, জামিয়াতুল মানহাল আল কাওমিয়া, উত্তরা, ঢাকা।
এমএম/