ইলন মাস্কের স্টারলিংককে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো এবং তা চালু করার মূল কারণ হচ্ছে ইন্টারনেট শাটডাউন চিরতরে বন্ধ করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আজ মঙ্গলবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা বলেন।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম তাঁর পোস্টে লিখেছেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার ১৬ বছরের শাসনকালে অনেকবার ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। বিক্ষোভ দমন করতে বা বিরোধী কোনো বড় আন্দোলন দমন করার ক্ষেত্রে স্বৈরশাসক ও একনায়কদের প্রিয় একটি হাতিয়ার হচ্ছে ইন্টারনেট শাটডাউন। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় লাখো ফ্রিল্যান্সার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। কেউ কেউ তাঁদের চুক্তি এবং চাকরি চিরতরে হারান।
শফিকুল আলম লিখেছেন, বাংলাদেশের বাজারে স্টারলিংকের আগমনের অর্থ হলো, ভবিষ্যতে কোনো সরকারই ইন্টারনেট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে পারবে না। ইন্টারনেট বন্ধ করার নতুন কোনো চেষ্টায় নিদেনপক্ষে বিপিও প্রতিষ্ঠান, কল সেন্টার ও ফ্রিল্যান্সাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
স্টারলিংক স্যাটেলাইটভিত্তিক দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা। এই সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। এই মার্কিন ধনকুবের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টাও।
১৩ ফেব্রুয়ারি ইলন মাস্কের সঙ্গে ভিডিও কলে আলোচনা করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এই আলোচনায় ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ক্ষেত্র অন্বেষণের পাশাপাশি বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা চালুর বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন তাঁরা। জাতীয় উন্নয়নে এই উদ্যোগের তাৎপর্য তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস স্টারলিংক পরিষেবার সম্ভাব্য প্রবর্তনের জন্য ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। মাস্ক তাতে ইতিবাচক সাড়া দেন। তিনি বলেন, ‘আমি এর অপেক্ষায় আছি।’
প্রযুক্তি খাতের লোকেরা বলছেন, স্টারলিংক বাংলাদেশে এলে দুর্গম এলাকায় খুব সহজে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাবে। ফলে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের পার্থক্য ঘুচে যাবে। গ্রামে বসেই উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফ্রিল্যান্সিংসহ ইন্টারনেটভিত্তিক কাজ করতে পারবেন তরুণেরা। দুর্যোগের পর দ্রুত যোগাযোগ প্রতিস্থাপনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে স্টারলিংক।
স্টারলিংক কী ?
স্টারলিংক হল স্পেসএক্সের একটি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা। যা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সরবরাহের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্থাপিত হাজার হাজার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ মূলত সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দেওয়া হয়। কখনো তার ছিড়ে গেলে বা কোনোভাবে কেটে গেলে নেটসেবা ব্যহত হয়। তাই স্টারলিংকের আগমন দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে বলে ধারণা করছেন প্রযুক্তিবিদরা।
স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে ?
স্টারলিংকের ছোট স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে নির্দিষ্ট স্টেশন ও ব্যবহারকারীর ডিভাইসের সাথে সংযোগ স্থাপন করে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। ব্যবহারকারীদের একটি বিশেষ রিসিভার (স্টারলিংক ডিশ) স্থাপন করতে হয়, যা স্যাটেলাইট থেকে সংকেত গ্রহণ করে।
স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা
ইন্টারনেটের গতি নিয়ে আমাদের অনেকেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।বাংলাদেশে বর্তমানে সাধারণত 4G গতির নেটসেবা পাওয়া যায়। তবে যারা গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন তাদের নেটসেবা খুব নিম্নমানের। আমাদের দেশে শহরাঞ্চলেও ইন্টারনেটের গতি বেশ ধীর। এই ধীর গতির সমস্যা সমাধানের ভাবনা থেকে স্টারলিঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্ক।
মূলত স্পেসএক্সের অধীনে পরিচালিত স্টারলিঙ্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। বর্তমানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হলেও ইলন মাস্কের মতে, স্যাটেলাইট ইন্টারনেটই ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ। স্টারলিঙ্ক মূলত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের (ভূ-স্থির উপগ্রহ) মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার একটি প্রকল্প। স্টারলিঙ্কের মূল লক্ষ্য পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। পৃথিবীর বাইরে ছোট ছোট অনেক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হয়।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের গতি
স্টারলিঙ্ক ছোট উপগ্রহের একটি অ্যারের (সারি) মাধ্যমে সীমাহীন উচ্চ-গতির ডেটা সরবরাহ করা যায়। এর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবিট (১৫০ এমবিপিএস)। স্পেসএক্স এই হার দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
উকলা স্পিডটেস্ট অনুসারে, স্টারলিঙ্ক লিথুয়ানিয়ায় ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৬০ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯১ এমবিপিএস, কানাডায় ৯৭ এমবিপিএস ও অস্ট্রেলিয়ায় ১২৪ এমবিপিএস পাওয়া গেছে। মেক্সিকোতে স্টারলিঙ্কের গতি রেকর্ড করা হয়েছে গড়ে ১০৫ দশমিক ৯১ এমবিপিএস।
স্টারলিংক ইন্টারনেট খরচ
স্টারলিঙ্কের দুই ধরনের সেবা রয়েছে। একটি আবাসিক সেবা। এটা আবাসিক ব্যবহারের জন্য। এক্ষেত্রে হার্ডওয়্যার তথা ডিশ ও রাউটারের জন্য যার মূল্য ৩৪৯ থেকে ৫৯৯ ডলার পর্যন্ত (৪৩ থেকে ৭৪ হাজার টাকা)। মাসিক সর্বনিম্ন ফি ১২০ ডলার (প্রায় ১৫ হাজার টাকা)।
অপরটি বাণিজ্যিক সেবা। এই সেবায় আবাসিক সেবার দ্বিগুণ গতি পাওয়া যাবে। এর জন্য এককালীন চার্জ ২৫০০ ডলার। প্রতি মাসে ফি ৫০০ ডলার। যতই দিন যাবে ব্যবহারকারী বাড়বে এবং এক পর্যায়ে দাম অবশ্যই কমবে।
স্টারলিংক ইন্টারনেটের সুবিধা
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অনেক উচ্চ গতির ইন্টারনেট। তারবিহীন. তাই কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ইন্টারনেটে বিঘ্ন ঘটায় সম্ভবনা নেই।
সাবমেরিন ক্যাবল ও ইন্টারনেট তার ছিঁড়ে সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও স্টারলিঙ্কে সেই আশঙ্কা নেই। এছাড়া যেকোনো জায়গা থেকে এর ব্যবহার করা যায়। কখনও কখনও এর গতি সাধারণত প্রতিশ্রুতির তুলনায় দ্রুত হয়ে থাকে।