|| মুফতি মোস্তফা কামাল ||
১.
লোকটির চুল এলোমেলো। ধূলিমলিন দেহাবয়ব। লিকলিকে শরীর। হাড্ডি-মাংস একাকার। বাতাসের দোলানিতে যেনো উড়ে যাবে দূরে কোথাও। দেখতে কদাকার। তাকে দেখলেই চোখ তাচ্ছিল্য ভরে দূরে ঠেলে দেবে। বিশ্বাস হয়— এই ক্ষীণকায় মানুষটি একাই জাহান্নামে পাঠিয়েছে একশ’রও বেশি মুশরিককে!
তিনি বীর। দুরন্ত সাহসী। রণাঙ্গনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মহানায়ক। তার সম্পর্কে হযরত ওমর রাঃ গভর্নরদেরকে লিখে পাঠান— তাকে যেন কোন বাহিনীর কমান্ডার না বানানো হয়। কেননা, তার শিখরসম সাহস আর বীরত্ব সাধারণ সৈন্যদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে।
নাম তার বারা ইবনে মালিক আল আনসারী। খাদিমে রাসূল হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. এর ভাই। নামে যেমন রয়েছে তার ভারত্ব, তেমনি শিরা-উপশিরায় রয়েছে বীরত্ব। বীর এই যোদ্ধার বীরত্বগাঁথা ফিরিস্তির শেষ নেই। সে এক দীঘল ফিরিস্তি। সব কি আর বলে শেষ করা যায়! বীরত্বের মহিমায় তিনি ইসলামের মর্যাদাকে রেখেছেন অক্ষুন্ন। বিলিয়ে দিয়েছেন প্রাণ। তার বীরত্বের সুদীর্ঘ দাস্তান থেকে একটি মাত্র ঘটনা বলছি। মনোযোগ দিয়ে শোনো।
২.
ঘটনাটি সূচিত হয় নবীজির ওফাতের পর। যখন নবীজি রফীকে আ'লার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। আরবের গোত্রগুলো তখন দলে দলে দ্বীন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা— মুহাম্মদ যেহেতু মারা গেছেন, তার আনীত ধর্মও এখন বিলুপ্ত হয়ে যাবে"। যেভাবে আরবের গোত্রগুলো দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল, সেভাবে আবার ইসলাম থেকে সরে যাচ্ছে। মক্কা, মদিনা, তায়েফ, বিশেষ কয়েকটি গোত্র, বিক্ষিপ্ত কিছু লোক ছাড়া সবাই দ্বীন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। শুরু হলো এক মহা ফিতনা। সাহাবায়ে কেরাম পেরেশান। খোলাফায়ে রাশেদীন পেরেশান। এই ফিতনা দমাতেই হবে। কিন্তু কিভাবে?
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. হাল ধরলেন। বিধ্বংসী এই ফিতনাতে তিনি পাহাড়ের মত অবিচল রইলেন। হৃদয় জুড়ে অদম্য তার প্রত্যয়শিখাটি জ্বলছে— আমি বেঁচে থাকতে আল্লাহর দ্বীনের কোন ক্ষতি হবে, তা কোনভাবেই বরদাশত করবো না"।
সৈন্য প্রস্তুত করতে লাগলেন। আনসার ও মুহাজিরদেরকে এগারোটি বাহিনীতে বিভক্ত করলেন। বাহিনীগুলোর প্রত্যেক কমান্ডারের হাতে দিলেন একটি করে পতাকা। প্রস্তুতি শেষ। এবার বাহিনী পাঠানোর পালা। এই এগারো বাহিনীকে তিনি জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলেন— "যাও! মুরতাদদেরকে হেদায়েত ও সত্যের পথে নিয়ে আসো। বিচ্যুতদের তরবারির ধারে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনো"।
সৈন্যবাহিনী রওনা হলো। সবচেয়ে কঠোর মুরতাদ ছিল বনু হানিফা। সংখ্যায়ও ছিল অনেক বেশি। এরা নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার মুসাইলামাতুল কাযযাবের অন্ধভক্তে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম সেনাদলের আগমন-সংবাদ পৌঁছে গেল মুসায়লামার কানে। যেন আস্তানায় সাইরেন বেজে উঠল! সে তার অনুচর ও বন্ধু মিলে প্রায় চল্লিশ হাজার শক্তিশালী যোদ্ধা একত্রিত করে ফেলল ।
এদের অধিকাংশই তার অনুসরণ করছে গোঁড়ামি বসত। তার উপর ঈমান এনে নয়। এমনকি তাদের অনেকেই বলত— আমার বিশ্বাস তো এটাই যে, মুসাইলামা একজন মিথ্যাবাদী, মুহাম্মদই সত্যবাদী; কিন্তু বনু মুদারের সত্যবাদী অপেক্ষা বনু রাবিয়ার মিথ্যাবাদী আমার কাছে অধিক প্রিয়।
মুসলমানদের প্রথম বাহিনীকে মুসাইলামা পরাজিত করতে সক্ষম হয়। মুসলমানগণ পিছু সরে যান। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু চিন্তিত হলেন। কিভাবে তাকে প্রতিহত করা যায়? তিনি দ্বিতীয় বাহিনী পাঠালেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা.। তিনি মুহাজির ও আনসারদের একত্রিত করলেন। এদের অগ্রভাগে ছিলেন হযরত বারা ইবনে মালিক আল আনসারীর মত কিছু বীর সেনানী।
৩.
ইয়ামামার একটি জায়গা। নাম 'নাজদ'। উভয় বাহিনী মুখোমুখি হল সেখানে। যুদ্ধ চলছে। অল্প সময়েই মুসাইলামা ও তার অনুসারীদের পাল্লা ভারী হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনীর পা দুর্বল হতে লাগল। পিছনে সরে যাওয়াই নিরাপদ। চোখের সামনে তার উন্মাদ বাহিনী মুসলমানদের তাবুকে সমূলে ভেঙে ফেললো । মুসলমানরা এখন মহা বিপদের সম্মুখীন। তারা বুঝতে পারল— যদি আজও তারা মুসাইলামার সামনে পরাজিত হয়, তাহলে গোটা আরবে মুসাইলামার জয়জয়কার রব পড়ে যাবে। নতুন ইসলাম গ্রহণকারীগণ বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে।
হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা. বাহিনীর প্রতি মনোনিবেশ করলেন। বাহিনীকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করলেন। তিনি আনসার ও মুহাজিরকে পৃথক পৃথক ভাবে সাজালেন। এলাকা ভিত্তিক লোকদের বিন্যস্ত করলেন। প্রত্যেককে নির্দিষ্ট পতাকার অধীনে একত্রিত করলেন, যাতে করে যুদ্ধের সময় প্রতি দলের পদক্ষেপ জানা যায়। কোন্ দিক থেকে আক্রমণ হচ্ছে তা জানা যায়।
যুদ্ধ শুরু হলো। ভয়ংকর যুদ্ধ। এমন যুদ্ধের দৃষ্টান্ত মুসলমানরা আগে কখনো দেখেনি। ওইদিকে মুসায়লামার বাহিনীও যুদ্ধক্ষেত্রে অটল, অবিচল অবস্থানে। যেন সুদৃঢ় পর্বত।
এই যুদ্ধে মুসলমানরা এমন অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে, যদি তা একত্রিত করা হতো তাহলে মহাকাব্যিক যুদ্ধগুলোর মধ্যে এক বিস্ময়কর মহাকাব্য হয়ে উঠতো।
এসকল বীরদের একজন হলেন— সাবিত ইবনে কায়েস। আনসারদের পতাকাবাহী। তিনি শরীরে সুগন্ধি মাখলেন। কাফন জড়ালেন। জমিনে খনন করলেন গর্ত। তিনি তাতে অর্ধ গোছা পর্যন্ত প্রবেশ করলেন। দাঁড়িয়ে রইলেন অটল পাহাড়ের মত। নিজের জাতির জন্য লড়তে লড়তে একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং শহীদ হন।
আরেকজন হলেন— জাহিদ ইবনে খাত্তাব। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.'র ভাই। চিৎকার করে তিনি মুসলমানদের মাঝে ঘোষণা দিতে লাগলেন— হে লোক সকল! নিজেদের দাঁত শক্ত করে কামড়ে ধরো। ঝাঁপিয়ে পড়ো শত্রুদের ওপর। এগিয়ে চলো সামনে। আল্লাহর কসম! এরপর আর কোন কথা নেই, যতক্ষণ না আমি মুসায়লামাকে পরাস্ত করব অথবা শহীদ হব। শহীদ হয়ে আল্লাহর কাছে উযর পেশ করব"। এরপর তিনি শত্রুর উপর আক্রমণ করেন। আক্রমণ করতে করতে এক পর্যায়ে তিনিও শহীদ হয়ে যান।
আরেকজন হলেন— সালেম। হুজাইফার আজাদকৃত গোলাম। মুহাজিরদের পতাকা বহন করছিলেন। কওমের লোকেরা ভয় পেয়ে গেল— তিনি হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বেন। তার মনোবল ভেঙে যাবে। তারা বলল— আমরা আশঙ্কা করছি, তোমার কারণে আমরা আক্রমণের শিকার হব। তিনি বললেন— যদি আমার কারণে তোমরা আক্রমণে পতিত হও তাহলে আমি কতই মন্দ বাহক! এরপর তিনি বীরদর্পে শত্রুর উপর আক্রমণ করলেন। যুদ্ধ করতে করতে একসময় তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন।
৪.
কিন্তু তাদের সবার বীরত্ব হযরত বারা ইবনে মালিক এর বীরত্বের সামনে ম্লান হয়ে যায়। শোনো তবে তার কথা।
হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দেখলেন যুদ্ধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধ চরম পর্যায়ে। রণাঙ্গন জুড়ে তখন উত্তাল ঢেউ । তিনি মনোনিবেশ করলেন হযরত বারা ইবনে মালেক রা. এর প্রতি। বললেন— হে আনসারী যুবক! তাদেরকে সাহায্য করো!
হযরত বারা ইবনে মালিক ফিরলেন। কওমের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন— হে আনসারী যোদ্ধাগণ! এখন থেকে তোমরা কেউ মদিনায় ফিরে যাওয়ার চিন্তাও করো না। আজ থেকে মনে করবে তোমাদের কোন মদিনা নেই। ঘর নেই। বাড়ি নেই। তোমাদের আছে শুধু একমাত্র আল্লাহ তাআলা। এরপর জান্নাত"।
আক্রমণ করলেন হযরত বারা রা.। সাথে সাহাবায়ে কেরাম। তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। বীরদর্পে। একাই একশ। দুই দিকে কচুকাটা করে মাঝখান দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শত্রুদের গরদানে ছুরি চালাচ্ছেন একেরপর এক। মুসাইলামা ও তার সাথীদের পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। নড়বড়ে হয়ে গেল তার দল। তারা এক বাগানে আশ্রয় নিল। ইতিহাসে যে বাগান "হাদিকাতুল মউত" মৃত্যুর বাগান নামে পরিচিত। এত এত মৃত্যু সেদিন ওই বাগানে হয়েছিল, যার কারণে এর নামই হয়ে গেছে ‘মৃত্যুর বাগান’।
মৃত্যুর এই বাগান ছিল বিশাল বিস্তৃত। উচ্চ প্রাচীর বিশিষ্ট। মুসাইলামা ও তার বাহিনী দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতর থেকে ফটক বন্ধ করে দিল। ভেতর থেকে তীর বর্ষণ করছে মুসলমানদের উপর। বৃষ্টির মতো ।
এমন সময় মুসলমানদের নিঃশঙ্ক সাহসী বীর হযরত বারা ইবনে মালেক রাঃ অগ্রসর হলেন। ঘোষণা করলেন- হে আমার যোদ্ধারা! আমাকে ঢালের উপর রাখো। সেই ঢালকে বর্ষার উপর তোলো। এরপরে বাগানের দরজার কাছে নিক্ষেপ করো। হয়তো আমি শহীদ হবো, না হয় তোমাদের জন্য দরজা খুলে দিব।
চোখের পলকে হযরত বারা রা. গিয়ে বসলেন ঢালের উপর। তিনি ছিলেন হালকা পাতলা শরীরের। দশটি বর্ষা তাকে উপরে তুললো। নিক্ষেপ করল বাগানে। মুসাইলামার হাজার হাজার সৈন্যের মাঝখানে। যেন তিনি বজ্রের মত গিয়ে পড়লেন বাগানের দরজার সামনে। তিনি লড়ে যাচ্ছেন। বীর বিক্রমে। তরবারী চালাচ্ছেন বীরদর্পে। চোখের পলকে দশজনকে জাহান্নামে পাঠালেন। খুলে ফেললেন দরজার শক্ত কপাট।
বাইরে শহিদী তামান্নায় মুসলিমবাহিনী অপেক্ষা করছিল। তাদের সামনে যেন খুলে গেল বেহেশতের সোনালি দেরাজ। উদ্যমী মুসলিম সেনা স্রোতের মত প্রবেশ করতে লাগলো ভেতরে। তরবারির আগুণ ঝরাতে লাগল চারদিকে। মুসায়লামাসহ বিশ হাজার মুরতাদের শিরচ্ছেদ হলো মুহুর্তে। বিজয়ের তাকবির ধ্বনিতে মুখরিত হলো মৃত্যুর বাগান। মৃত্যুঞ্জয়ী উপাধিতে অলঙ্কৃত হলো এক সাহসী নাম— বারা ইবনে মালেক আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু।
লেখক: শিক্ষক,বাইতুল আমান মদীনাতুল উলুম মাদরাসা
খিলগাঁও, ঢাকা।
এমএম/