|| মোস্তফা কামাল ||
বাইতুল আমান মদীনাতুল উলূম মাদরাসা
খিলগাঁও, ঢাকা।
আনাস ইবনে মালিক। জীবনের এক গোলাপময় সন্ধিক্ষণে উপনীত। উপনীত মধুর শৈশবে। মমতাময়ী মা গুমাইছা। রাদিআল্লাহু আনহা। ছোট্ট হৃদয়ে দিলেন শাহাদাতের তালকীন। কোমল হৃদয় পূর্ণ হলো নবীজির ভালবাসায়। ইসলামের নবী। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালোবাসায়। শাহাদাতাইনওয়ালার জন্য গভীর আবেগ কেড়ে নিলো ছোট্ট আনাসের মন। এ কি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়! না, কখনো কখনো চোখের আগেই কান ভালোবেসে ফেলে।
বুকের শত তামান্না তার। হৃদয়ের রাজাধিরাজ নবীজির টানে ছুটে যাবেন মক্কায়। প্রভাতের পাখিরা যেখানে গুঞ্জরণ তুলে কালিমার। শাহাদাতের। ঘোষণা করে— এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। অথবা তিনি আসবেন পূণ্যভূমি মদিনায়। তার সাক্ষাতে ধন্য হবে ছোট্ট আনাসের ব্যাকুল প্রাণ।
বেশিদিন অতিবাহিত হয়নি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথী সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু পা বাড়ালেন। সৌভাগ্যময় পূণ্যভূমি ইয়াসরিবের দিকে। আনন্দে ভরে গেলো ইয়াসরিবের প্রতিটি ঘর। প্রতিটি অন্তর। প্রতিটি চোখ তাকিয়ে থাকে মদীনার পথে। প্রতিটি হৃদয় মিশে যায় ইয়াসরিবের পথে। যে পথ বুকে বয়ে আনছে দোজাহানের সরদার ও সিদ্দিকে আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মোবারক পদযুগল।
প্রতিটি উষালগ্ন অতিবাহিত হয়। যুবকেরা বুকের শত আবেগ দিয়ে ঘোষণা করে— মুহাম্মাদ আসছেন! মুহাম্মাদ আসছেন! সাথে যায় ছোট ছোট বাচ্চারাও। আনাসও যায় তাদের সাথে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। ফিরে আসে। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে।আপন নীড়ে। নিজের ঘরে।
আলো ঝলমল এক সুরভীত প্রভাত। ইয়াসরিবের কিছু লোক ঘোষণা করতে লাগল চিৎকার করে— "মুহাম্মাদ ও তার সাথী মদিনার নিকটবর্তী হয়েছেন। লোকেরা ছুটলো পথের দিকে। পড়িমরি করে। ভাগ্যবান যে পথ হেদায়েতের নবীকে বুকে করে নিয়ে আসছে। সে পথের দিকে। যেনো বিশাল এক ময়দানে লোকেরা দলে দলে নেমেছে প্রতিযোগিতায়। তাদের মাঝে অংশগ্রহণ করেছে পাখির মত ছোট্ট শিশুর একটি দলও। চেহারায় তাদের খুশির ঝিলিক। আনন্দ তাদের কোমলমতি হৃদয়গুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। বাচ্চাদের এই দলের অগ্রনায়ক আনাস ইবনে মালিক।
আগমন করলেন প্রিয় নবী ও সিদ্দিকী আকবর রাদিয়াল্লাহু আনহু। উচ্ছ্বাসপূর্ণ উত্তাল জনতা। মাঝ দিয়ে চলছেন দুই সাথী। পর্দাবৃত নারী আর কোমলমতি বাচ্চা মেয়েগুলো উঠলো বাড়ির ছাদে। দূর থেকে তারা দেখছেন। দুই সাথীকে। দুই তারকাকে। বলছেন— কারা তারা? কারা তারা?
দিনটি ছিল তাদের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর জীবনে একশত'রও বেশি বছর এই দিনটিকে স্মরণ করেছেন।
নবীজি মদিনায় অবস্থান করছেন। একদিন নবীজির দরবারে উপস্থিত হলেন আনাসের মা গুমাইসা। সাথে তার কলিজার টুকরা। সামনে সামনে হাঁটছে। মাথার চুলগুলো বাতাসে দুপাশে দোল খাচ্ছে।
গুমাইসা এসে অভিবাদন জানালেন নবীজিকে। বললেন— সবাই তো আপনাকে কিছু না কিছু উপহার দিল। কিন্তু আমি আপনাকে কী উপহার দেব! আমার যে ছোট্ট আনাস ছাড়া আর কিছুই নেই! ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি তাকে গ্রহণ করুন। তাকে আপনার খেদমতে নিয়োজিত করুন।
হাসিমুখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করলেন ছোট্ট এই শিশুকে। তার মাথায় বুলিয়ে দিলেন মোবারক হাত। আর্দ্র আঙ্গুলে স্পর্শ করলেন তার কপালের চুল। তাকে নিজের পরিবারের করে নিলেন।
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যেদিন নবীজির খেদমতে সৌভাগ্যবান হলেন, সেদিন তিনি জীবনে দশ তম বছরে উপনীত। নবীজির তত্ত্বাবধানে থাকলেন আমৃত্যু। নবীজির সোহবতে তার কেটে গেল মোট দশটি বছর। এই সময়ে তিনি অর্জন করে নিয়েছেন নিজের আত্মিক পরিশুদ্ধির যত গুণ। বক্ষে সংরক্ষণ করেছেন প্রিয় নবীজির হাদিস। জেনেছেন নবীজির এমন সব অগোচর বিষয় ও উত্তম চরিত্র যা জানতে পারেনি অন্য কেউ।
নবীজির এমন কিছু উত্তম চরিত্রের নিদর্শন তিনি অবলোকন করেছেন, কোন পিতার সন্তান যা অবলোকন করার সৌভাগ্য লাভ করেনি। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন— তিনি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। সুবিশাল হৃদয়ের অধিপতি। তার হৃদয়টা পূর্ণ ছিল স্নেহ আদরে। মমতায়। ভালবাসায়।
একদিন নবীজি আমাকে পাঠালেন কোন এক কাজে। কিন্তু আমি চললাম অন্যদিকে। বাচ্চারা মাঠে খেলাধুলা করছে। আমিও চলে গেলাম তাদের সাথে। খেলাধুলা করার জন্য। গেলাম না যেই উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন। আমি তাদের কাছে উপস্থিত। হঠাৎ যেন পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। কেউ দাঁড়িয়ে আছে আমার পেছনে। তিনি আমার কাপড় ধরলেন। ফিরে তাকালাম। দেখলাম— নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম মুচকি হাসছেন। আমাকে বলছেন— যেখানে বলেছিলাম গিয়েছো কি? আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। বললাম— ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখনই যাচ্ছি। আল্লাহর শপথ! দশ বছর আমি তার খেদমত করেছি। আমার কোন কাজের জন্য কখনো তিনি বলেননি— কেন এটা করেছ? কেন ওটা করনি?
এমএম/