রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ ।। ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১ ।। ৯ রমজান ১৪৪৬


৩য় তারাবির নামাজে তিলাওয়াতের সারমর্ম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর

(সূরা আলে ইমরান:৯২-২০০ ও সূরা নিসা:১-৮৭)

পবিত্র কুরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়; এটি মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যেখানে রয়েছে ঈমান, তাকওয়া, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পারিবারিক জীবনের পথনির্দেশনা।

তৃতীয় দিনের তারাবির তেলাওয়াতে সূরা আলে ইমরানের শেষ অংশ ও সূরা আন-নিসার প্রথম অংশ তেলাওয়াত করা হবে। যেখানে ঈমানদারদের পরীক্ষা, উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা, দান-সদকা, পারিবারিক বিধান, সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান, যুদ্ধনীতি ও মুনাফিকদের স্বরূপ বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
এই অংশে মুমিনদের জন্য আল্লাহর ওপর আস্থা, ধৈর্য ও আত্মনিবেদনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। 

উহুদ যুদ্ধের ঘটনাবলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে কেমন বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

অপরদিকে, সূরা নিসায় নারী ও সমাজের দুর্বল শ্রেণির অধিকার সুরক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা ইসলামের সাম্য ও সুবিচারের নীতি প্রতিষ্ঠা করে।

১. সূরা আলে ইমরান (৯২-২০০) – শেষ অংশের সারমর্ম

দান-সদকা ও হালাল রিজিক (৯২-১০৯)

• আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য উত্তম সম্পদ ব্যয় করতে হবে।
• হারাম ও অপবিত্র বস্তু আহার করা নিষেধ করা হয়েছে।
• আহলে কিতাবের একদল সত্য গোপন করে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে।

ঈমানদারদের পরীক্ষা ও উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা (১১০-১৮০)

• মুসলমানরা সর্বোত্তম জাতি, যারা সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে।
• উহুদ যুদ্ধে মুমিনদের দুর্বলতা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
• যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তারা প্রকৃতপক্ষে মৃত নয়, বরং আল্লাহর কাছে জীবিত।
• দুনিয়ার মোহ ও আল্লাহর প্রতি অনাস্থা মানুষকে বিপথগামী করতে পারে।

আল্লাহর প্রতি আস্থা ও মুত্তাকীদের গুণাবলি (১৮১-২০০)

• মুসলমানদের ধৈর্য ধরার ও একতা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
• আল্লাহর সাহায্য ও রহমত মুমিনদের সঙ্গেই থাকে।
• দোয়া: হে আমাদের রব, আমাদের গুনাহ মাফ করো, আমাদের ভুলত্রুটি ঢেকে দাও এবং আমাদের ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করো (সূরা আলে ইমরান:১৯৩)।
• শেষ আয়াতে তাকওয়া, ধৈর্য ও বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।

২. সূরা নিসা (১-৮৭) – প্রথম অংশের সারমর্ম

নারীর অধিকার ও পারিবারিক বিধান (১-১০)

• মানবজাতি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তাই একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি।
• এতিমদের সম্পদ সংরক্ষণের নির্দেশ এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
• বিয়ের বিধান ও নারীদের অধিকার বর্ণিত হয়েছে।
• স্ত্রীদের প্রতি সুবিচার করতে বলা হয়েছে, এবং চার বিবাহের শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে—যদি সমানভাবে ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয়।
উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির বণ্টন (১১-১৪)
• পিতামাতার মৃত্যু হলে সন্তানদের মাঝে কীভাবে সম্পত্তি বণ্টন করতে হবে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
• আল্লাহর দেওয়া বিধান অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির ঘোষণা করা হয়েছে।

বিবাহ ও সামাজিক শৃঙ্খলা (১৫-২৩)

• ব্যভিচারের শাস্তি এবং পবিত্র জীবনযাপনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
• যেসব আত্মীয়দের সঙ্গে বিয়ে করা হারাম, তাদের তালিকা বলা হয়েছে।
• বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্রতা রক্ষা করতে বলা হয়েছে।

বৈধ ও অবৈধ সম্পর্ক (আয়াত ২৪-২৮)

• ইসলাম বিবাহকে পবিত্র ও বৈধ সম্পর্ক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে।
• ব্যভিচার ও অবৈধ সম্পর্ক কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
• মোহর (পণ) নারীর অধিকার এবং বৈধ বিবাহের শর্ত।

মানুষের দায়িত্ব ও আমানত (আয়াত ২৯-৪২)

• অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করা হারাম।
• আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
• এতিমদের প্রতি সদাচরণ করার নির্দেশ।
• নামাজ কায়েম করা, জাকাত দেওয়া, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি আনুগত্যের আদেশ।

পাপ ও ক্ষমার নীতি (আয়াত ৪৩-৫৭)

• নামাজে উপস্থিত হওয়ার আগে পবিত্রতার শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
• গোপন পাপের চেয়ে প্রকাশ্য পাপ বেশি নিন্দনীয়।
• আল্লাহ মুশরিকদের ক্ষমা করেন না, কিন্তু অন্য পাপ ক্ষমা করতে পারেন।
• মুনাফিকদের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে— তারা মিথ্যা বলে, ধোঁকা দেয় এবং দ্বিমুখী আচরণ করে।

ন্যায়বিচার ও মুসলমানদের দায়িত্ব (আয়াত ৫৮-৭০)

• বিচারকদের প্রতি সুবিচার করার নির্দেশ।
• আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্যই প্রকৃত মুক্তির পথ।
• যুদ্ধের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতি ও সতর্কতা গ্রহণের আদেশ।
• মুসলমানদের উচিত মুনাফিকদের চিনতে পারা এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকা।

জিহাদ ও আত্মরক্ষা (আয়াত ৭১-৮৭)

• আত্মরক্ষা ও ইসলামের রক্ষায় যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
• যারা জিহাদ থেকে বিরত থাকে এবং অন্যদের পিছিয়ে দেয়, তাদের সতর্ক করা হয়েছে।
• মৃত্যুর ভয়ে যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে না, তাদের দুর্বল বিশ্বাসের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
• সত্যিকারের মুমিনদের আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার ও বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।

মূল শিক্ষা ও বার্তা:

• আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হালাল উপার্জন ও উত্তম সম্পদ ব্যয় করতে হবে।
• ইসলামী জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করলে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা নিশ্চিত হবে।
• উহুদ যুদ্ধের শিক্ষা হলো—আল্লাহর নির্দেশ মেনে না চললে বিপর্যয় আসতে পারে।
• এতিম, নারী ও দুর্বলদের প্রতি সুবিচার করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা।
• পারিবারিক সম্পর্ক ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, এতে কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন করা যাবে না।
• ইসলামে পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতার কঠোর বিধান রয়েছে।
• আত্মরক্ষা ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা বৈধ।
• মুনাফিকদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
• আল্লাহর বিধানের ওপর অটল থাকলে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করা যাবে।

উপসংহার:

এই শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ। এতে আছে ঈমান, তাকওয়া, ধৈর্য, পারিবারিক সম্পর্কের মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। এই আয়াতগুলো আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলার আহ্বান জানায়। 

ব্যক্তি ও সমাজজীবনে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যেন কুরআনের এই মূল্যবান শিক্ষাগুলো অন্তরে ধারণ করি এবং সেগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করি। 

এতে রয়েছে মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও সামরিক জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার শিক্ষা। আমরা যেন এই শিক্ষাগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারি আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ