বদনজর সত্য, এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াও সত্য। বদনজর বা কুদৃষ্টির প্রভাবে ব্যক্তি বা জিনিসের অনিষ্ট হয়। ইমাম কুরতুবি রহ. লিখেছেন, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের শীর্ষ আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে, বদনজর এবং এর মাধ্যমে ক্ষতিসাধিত হওয়া প্রমাণিত সত্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর কাফেররা যখন কোরআন শোনে, তখন তারা যেন তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা আপনাকে আছড়ে ফেলবে এবং বলে, এ তো এক পাগল।’ (সুরা কলম: ৫১)
আয়াতে ‘তাদের দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়ে ফেলবে’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে— ‘তোমার প্রতি বদনজর দেবে।’ অর্থাৎ তারা তোমাকে হিংসার প্রতিফলন ঘটিয়ে রোগী বানিয়ে দেবে, যদি তোমার প্রতি আল্লাহর হেফাজত না থাকে। আয়াতটি প্রমাণ বহন করে যে, আল্লাহর হুকুমে বদনজরের কুপ্রভাবের বাস্তবতা রয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৪/৪১০)
উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা বদনজরের প্রভাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। কেননা নজরের প্রভাব সত্য।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৫০৮)
তবে, বিশ্বাস রাখতে হবে—কুদৃষ্টির মধ্যে এমন শক্তি (প্রভাব) স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই দান করেন। তাই কোনো মুসলিম বদনজরের শিকার হলে তার উচিত—আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাঁরই কাছেই আশ্রয় চাওয়া।
সাহাবি আবু সহল ইবনে হুনাইফের একটি বিখ্যাত ঘটনা রয়েছে। একবার গোসল করার জন্য তিনি কাপড়-চোপড় খোলেন। তাঁর গৌরবর্ণ ও সুঠাম দেহের ওপর আমের ইবনে রবিআর দৃষ্টি পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে—আমি আজ পর্যন্ত এমন সুন্দর ও কান্তিময় দেহ দেখিনি। তৎক্ষণাৎ সহল ইবনে হুনাইফের দেহে ভীষণ জ্বর এসে যায়। মহানবী সা. এ সংবাদ পেয়ে আমের ইবনে রবিআকে আদেশ দেন, সে যেন অজু করে অজুর পানি থেকে কিছু অংশ পাত্রে রাখে। তারপর তা যেন সহল ইবনে হুনাইফের দেহে ঢেলে দেওয়া হয়।
আদেশ মোতাবেক কাজ করা হলে সহল ইবনে হুনাইফ রক্ষা পেলেন। তাঁর জ্বর চলে গেল। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। এ ঘটনায় মহানবী সা. আমের ইবনে রবিআকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ নিজের ভাইকে কেন হত্যা করতে চায়? তোমার দৃষ্টিতে যখন তার দেহ সুন্দর প্রতিভাত হয়েছিল তখন তুমি তার জন্য বরকতের দোয়া করলে না কেন? মনে রেখো, বদনজর লেগে যাওয়া সত্য।’ (মুআত্তা মালেক: ১৭১৪)
এ হাদিসের আলোকে বদনজর থেকে আত্মরক্ষার ২টি প্রক্রিয়া জানা যায়।
১. কারও সৌন্দর্য, ধন-সম্পদ বা কোনো প্রকার উন্নতি কিংবা বিস্ময়কর কিছু দেখলে তার জন্য কল্যাণের দোয়া করা উচিত। শুধু এতটুকুও দোয়া করা যায় যে— ‘বারাকাল্লাহু ফিহি’। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা এতে বরকত দান করুন। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘মাশাআল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলা উচিত। এতে কুদৃষ্টির প্রভাব ধ্বংস হয়।
২. যার কুদৃষ্টি পড়ে, তার হাত-পা ও মুখমণ্ডল ধৌত করা পানি রোগীর দেহে ঢেলে দিলে বদনজরের অনিষ্ট দূর হয়।
বদনজর থেকে পরিত্রাণের উপায়ও বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। যেমন—আবু সাঈদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. একবার কোনো রোগে আক্রান্ত হলেন। তখন ফেরেশতা জিবরাইল আ. নবীজি সা.-এর কাছে এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি কি অসুস্থতা বোধ করছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন জিবরাইল আ. বললেন—
بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللهُ يَشْفِيكَ بِاسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ
উচ্চারণ: ‘বিসমিল্লাহি আরকিকা, মিন কুল্লি শাইয়িন ইয়ু’যিকা, ওয়া মিন কুল্লি আইনিন ও ওয়া হাসিদিন আল্লাহু ইয়াশফিকা, বিসমিল্লাহি আরকিকা।’ অর্থ: ‘আল্লাহর নামে আপনাকে ফুঁক দিচ্ছি; যেসব জিনিস আপনাকে কষ্ট দেয়, সেসব প্রাণের অনিষ্ট কিংবা হিংসুকের বদনজর থেকে আল্লাহ আপনাকে শিফা দিন; আল্লাহর নামে আপনাকে ফুঁ দিচ্ছি।’ (মুসলিম: ৫৫১২)
সুতরাং দোয়াটি পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার ফুঁ দিলে ধীরে ধীরে বদনজরের প্রভাব কেটে যাবে ইনশাল্লাহ।
আরেকটি উপায় হচ্ছে—সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস তিনবার পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ফুঁ দেওয়া। আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা. (সুরা ফালাক ও নাস অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজ ভাষায়) জিন ও বদনজর থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। যখন সুরা দুটি অবতীর্ণ হলো, তখন ওই সুরা দুটির মাধ্যমে আশ্রয়প্রার্থনা করতে লাগলেন, বাকি সব পরিহার করলেন।’ (তিরমিজি: ২০৫৮)
ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একটি দোয়া পড়তে হবে। যেটি বদনজর থেকে রক্ষার জন্য নবীজি সা. ছোটদের কোলে নিয়ে পড়ে ফুঁ দিতেন। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে এমন অনেক বর্ণিত হয়েছে। হাসান ও হুসাইন রা.-কে রাসুলুল্লাহ সা. এই বাক্যগুলো পড়ে ফুঁক দিতেন—
أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لامَّةٍ
উচ্চারণ: ‘উইজুকুমা বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইতানিন ওয়া হাম্মাতিন ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন।’
অর্থ: ‘আমি তোমাদের উভয়কে আল্লাহর কালামের আশ্রয়ে রাখতে চাই সবধরনের শয়তান হতে, কষ্টদায়ক বস্তু হতে এবং সব ধরনের বদনজর হতে’। (বুখারি: ৩৩৭১)
উপরোল্লিখিত আলোচনায় লক্ষণীয়, যেকারও ওপর বদনজর লাগতে পারে। তাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর দোয়া-দরুদ পড়া, সুরা ফালাক ও নাসের মাধ্যমে মানুষ ও জ্বিনের যাবতীয় অনিষ্টতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে বদনজর থেকে হেফাজত রাখুন। আমিন।
এনএ/