|| নাজমুল হুদা মজনু ||
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুমিনের জীবনের সব ক্ষেত্রে অনেক কাছে থাকেন; কাছে আছেন। তাঁকে ডাকলেই তিনি সাড়া দেন। তার কাছে চাইতে কোনো মাধ্যম লাগে না। এর অর্থ এই নয় যে, সুন্নাহ লাগবে না; বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইবাদতের জন্য মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ ও পন্থার বিকল্প নেই।
আর কখনো আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য এই নয় যে, বান্দাকে কষ্ট দেয়া অথবা আজাব-গজব দিয়ে তাকে ধ্বংস করা। তাইতো আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে সুন্দর করে প্রতিপালনের জন্য তাঁর হাবিবের অনুসরণ-অনুকরণ আবশ্যক করেছেন। কুরআন- সুন্নাহর আলোকে চলাই সিরাতুল মুস্তাকিম; অর্থাৎ সহজ-সরল পথ। তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে একটু যাচাই-বাছাই করে নেন। এভাবে একসময় সমাজ-সংসারে মানুষ সংশোধনের পথ ধরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রিয় বান্দার তালিকায় নিবন্ধন লাভ করে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন–
আমি অবশ্যই তােমাদের পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি এ কথা জেনে নেবাে, কে তােমাদের মাঝে (সত্যিকারভাবে) আল্লাহর পথের মুজাহিদ আর কে তােমাদের মধ্যে (জিহাদের ময়দানে) ধৈর্য ধারণকারী (অবিচল), যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তােমাদের খোঁজখবর (ভালাে করে) যাচাই-বাছাই করে না নেবাে (ততক্ষণ পর্যন্ত আমার এ পরীক্ষা চলতে থাকবে)।
যারা কুফরি করে এবং (অন্য মানুষকে) আল্লাহর পথে আসা থেকে বিরত রাখে এবং তাদের কাছে হেদায়াতের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরও যারা আল্লাহর রাসূলের বিরােধিতা করে, তারা কখনাে আল্লাহ তায়ালার কিছুমাত্র ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হবে না; (বরং এ কারণে) অচিরেই আল্লাহ তায়ালা তাদের যাবতীয় কর্ম নিষ্ফল করে দেবেন।
হে (মানুষ), যারা ঈমান এনেছো, তোমরা (সর্বাবস্থায়) আল্লাহর আনুগত্য করাে, (শর্তহীন) আনুগত্য করাে (তাঁর) রাসূলের, (বিদ্রোহ করে) কখনাে তােমরা নিজেদের কাজকর্ম বিফলে যেতে দিয়াে না।
যারা (নিজেরা) আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করে এবং (অন্য মানুষকেও) যারা আল্লাহর পথে আসা থেকে ফিরিয়ে রাখে, অতঃপর এ কাফের অবস্থায়ই তারা মরে যায়, আল্লাহ তায়ালা এসব লোককে কখনাে ক্ষমা করবেন না।
অতএব তােমরা কখনাে হতােদ্যম হয়ে পড়াে না এবং (কাফেরদের) সন্ধির দিকে ডেকো না, (কেননা) বিজয়ী তাে হচ্ছো তােমরাই, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সাথেই রয়েছেন, তিনি কখনাে তোমাদের কর্মফল বিনষ্ট করবেন না।
(মুহাম্মাদ : ৩১-৩৫)
সবসময় সব যুগেই কিছু অবিশ্বাসী অভাগা চক্র মুমিনদের ক্ষতি করার জন্য ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তারা মূলত নিজেদেরই ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। আর এতে ইন্ধন জোগায় ইবলিশ শয়তান। তবে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া মুমিন বান্দাদের আল্লাহ তায়ালাই রক্ষা করেন।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলেন, (হে নবী,) তুমি (এদের আরাে) বলাে, তােমরা আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করাে, আনুগত্য করো আল্লাহর রাসূলের (হ্যাঁ), তােমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও (তাহলে জেনে রেখো), আল্লাহ তায়ালার দ্বীন পৌঁছানাের যে দায়িত্ব তার ওপর দেয়া হয়েছে তার জন্য সে দায়ী, (অপর দিকে আনুগত্যের) যে দায়িত্ব তােমাদের ওপর দেয়া হয়েছে তার জন্য তােমরা দায়ী, যদি তােমরা তাঁর কথামতো চলাে তাহলে তােমরা সঠিক পথ পাবে, রাসূলের কাজ হচ্ছে (আল্লাহ তায়ালার কথাগুলাে) ঠিক ঠিক মতাে পৌঁছে দেয়া। (আন-নূর : ৫৪)
দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্তর্যামী; তিনি মানুষের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবকিছুই অবগত। তাই মনে রাখতে হবে– রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য মানেই আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ পালন করা।
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিঃসন্দেহে আজ যারা তােমার কাছে বায়াত করছে, তারা তাে প্রকারান্তরে আল্লাহর কাছেই বায়াত করল; (কেননা) আল্লাহর হাত ছিল তাদের হাতের ওপর, তাদের কেউ যদি এ বায়াত ভঙ্গ করে তাহলে এর (ভয়াবহ) পরিণাম তার নিজের ওপরই এসে পড়বে, আর আল্লাহ তায়ালা তার ওপর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা যে পূর্ণ করে, তিনি অচিরেই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন।
(আরব) বেদুইনদের যারা (তােমার সাথে যােগ না দিয়ে) পেছনে পড়ে থেকেছে, তারা অচিরেই তােমার কাছে এসে বলবে (হে নবী), আমাদের ধনসম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদের ব্যস্ত করে রেখেছিল, অতএব তুমি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাে (হে মুহাম্মাদ, তুমি এদের কথায় প্রতারিত হয়াে না), এরা মুখে এমন সব কথা বলে যার কিছুই তাদের অন্তরে নেই; বরং তুমি (এদের) বলে দাও, আল্লাহ তায়ালা যদি তােমাদের কোনাে ক্ষতি কিংবা কোনাে উপকার করতে চান, তাহলে কে তােমাদের ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছা থেকে তাঁকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে; তােমরা যা যা করছো আল্লাহ তায়ালা কিন্তু সে সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেফহাল রয়েছেন। (আল ফাতাহ : ১০-১১)
যেকোনো অবস্থায় আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণ- অনুসরণ মুমিনের জীবনের পরম পাথেয়। সালাত-সিয়াম এবং মুমিনের জীবনের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে সবসময় সুন্নতে রাসূল পালন করা অবশ্য করণীয়। সুন্নাহ ব্যতীত যেকোনো আমল পরিত্যাজ্য।
এ ব্যাপারে আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতা করল। আর যে আমিরের (নেতার) আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমিরের অবাধ্যতা করল, সে আমারই অবাধ্যতা করল। প্রকৃতপক্ষে ইমাম (নেতা) হলেন ঢালস্বরূপ। তার পেছন থেকে যুদ্ধ করা হয়, তার দ্বারা (শত্রুদের কবল থেকে) নিরাপত্তা পাওয়া যায়। সুতরাং শাসক যদি আল্লাহর প্রতি ভয় প্রদর্শনপূর্বক প্রশাসন চালায় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে এর বিনিময়ে সে সাওয়াব (প্রতিদান) পাবে। কিন্তু সে যদি এর বিপরীত কর্ম সম্পাদন করে, তাহলে তার গুনাহও তার ওপর কার্যকর হবে। (বুখারি-২৯৫৭)
মুসলিম উম্মাহর শান্তি-সংহতির জন্য বিশ্বাসীদের যেমন পরস্পর সম্প্রীতির প্রয়োজন তেমনি অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রেরিত মহান বাণী কুরআনুল কারিমে। সেই সাথে তিনি মুমিনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছেন।
মুহাম্মাদ আল্লাহ তায়ালার রাসূল; অন্য যেসব লােক তাঁর সাথে আছে তারা (নীতির প্রশ্নে) কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর, (আবার তারা) নিজেদের মধ্যে একান্ত সহানুভূতিশীল, তুমি (যখনই) তাদের দেখবে, (দেখবে) তারা রুকু ও সাজদাবনত অবস্থায় রয়েছে, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করছে, তাদের (বাহ্যিক) চেহারায়ও (এ আনুগত্য ও) সাজদার চিহ্ন রয়েছে; তাদের উদাহরণ যেমন (বর্ণিত রয়েছে) তাওরাতে, (তেমনি) তাদের উদাহরণ রয়েছে ইঞ্জিলেও, (আর তা হচ্ছে) যেমন একটি বীজ যা থেকে বেরিয়ে আসে একটি (ছােট্ট) কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মােটাতাজা হয় এবং (পরে) স্বীয় কাণ্ডর ওপর তা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায়, (চারাগাছটির এ অবস্থা তখন) চাষির মনকে খুশিতে উৎফুল্ল করে তােলে, (এভাবে একটি মুমিন সম্প্রদায়ের পরিশীলনের ঘটনা দ্বারা) আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের মনে (হিংসা ও) জ্বালা সৃষ্টি করেন; (আবার) এদের মাঝে যারা (আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের ওপর) ঈমান আনে এবং নেক আমল করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য তাঁর ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
(আল-ফাতাহ : ২৯)
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
এনএ/