শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৬ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টা খুশি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| নাজমুল হুদা মজনু ||

প্রতিটি মানুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি এই যে, সে অনবরত অন্য মানুষের পক্ষ থেকে নম্রতা ভদ্রতা অমায়িক সহজ সরল সুন্দর ও সুকোমল আচার-ব্যবহার কামনা করে।

কিন্তু তার নিজের পক্ষ থেকে অন্য মানুষের প্রতি কঠিন কর্কশ কটুকথা কিংবা বক্র ব্যবহারের ব্যাপারে যারপরনাই

অন্ধ বধির ও উদাসীন। আমরা পরস্পর কত কঠোর কত নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ হামেশাই করে থাকি। অথচ আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কত মহৎ মন-মনন দয়া মায়া মমতাময় অনিন্দ্য সুন্দর অনন্য স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী। তাঁর নিপুণ গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, আর আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু করুণা রূপেই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া-১০৭)

আজ আমাদের চার পাশে মানুষের প্রতি মানুষের আচার ব্যবহার এত জঘন্য যে, ইবলিশ শয়তান‌ও হার মানে।

আমাদের চলা বলা কাজকর্ম ঘরে বাইরে অফিসে আদালতে মাঠে ঘাটে ক্ষেতে খামারে অযাচিত অবাঞ্ছিত হয়ে নব্য জাহেলিয়াতের অন্ধকার অমানিশায় নিমজ্জিত করে ফেলেছে। কারণ আজকে আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ ও  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্মল নিষ্কলুষ জীবনাদর্শ মহান ধর্ম ইসলাম ছেড়ে আজন্ম দুশমন দুরাচার ইয়াহুদি-নাসারাদের ঘৃণিত মত-পথ পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিপথে চলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ধোঁকাবাজি চালবাজি, মানুষকে ঠকিয়ে আমরা পাশবিক সুখ অনুভব করি। ভেজাল কথা ভেজাল খাবার ভেজাল লেনদেন ভেজাল মন- মানসিকতা আমাদের ওপর ভালোভাবে জেঁকে  বসেছে। কাজে কথায় দু'নম্বরি করা যেন আমাদের ধ্যান জ্ঞান নেশা পেশা হয়ে পড়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ থেকে আমরা আজ যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছি।  আমাদের এত দুর্নীতি দুষ্কর্ম-দুর্নামের কারণে আমরা আজ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!

পরস্পর লেনদেনের সময় কী ধরনের আচরণ করতে হবে আল্লাহর হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা আমাদের শিখিয়ে গেছেন; কিন্তু সেই শিক্ষা ভুলে আমরা ঘুষখোর সুদখোর বাটপাড় বদমাইশ চোরচোট্টায় পরিণত হয়েছি।

আমরা ইদানিং কারো কাছ থেকে নিজে কোনো কিছু নেয়ার সময় একটু বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করি অপর দিকে কাউকে কিছু দেয়ার সময় একটু কম দিয়ে ঠকিয়ে তৃপ্তি অনুভব করি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে তিনি বলেন,

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, 'সেই ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ রহম করুন! যে বিক্রি করার সময়, কেনার সময় এবং স্বীয় অধিকার চাওয়ার সময় সহজ ও নরম পন্থা অবলম্বন করে।' (বুখারি ২০৭৬)

আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগতের শ্রেষ্ঠ মানব, শ্রেষ্ঠ রাসূল হওয়া সত্ত্বেও মানুষের প্রতি পরম স্নেহশীল, দয়াবান ও অভূতপূর্ব দরদি ছিলেন। তাই এ ব্যাপারে কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। হে ঈমানদাররা! তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করো এবং তাকে উত্তমরূপে অভিবাদন করো তথা (দরুদ ও সালাম পেশ করো।) (সূরা আহজাব-৫৬)

মুখে আশেকে রাসূল বলতে বলতে কোনো কোনো ভাই-বন্ধু বেহুঁশ-বেকারার। অথচ আমরা দয়ার নবীর আদর্শ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। মানুষের প্রতি মানুষের মায়া মমতা প্রীতি ভালোবাসা অনুরাগ অনুকম্পা আজ আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে।

একসময় পরস্পর এমন সুন্দর সদয় সম্প্রীতি ছিল আমাদের মাঝে; ট্রেনে বাসে লঞ্চে স্টিমারে যাত্রীদের মধ্যে চেনা অচেনা নির্বিশেষে কথাবার্তা ভাববিনিময় আপ্যায়ন-প্রতি আপ্যায়ন–  এসব আনন্দময় রেওয়াজ অভ্যাস বিরাজ করত। তা যেন আজ সোনার হরিণ!  আজকাল যানবাহনের গায়ে লেখা থাকে– 'কেউ কারো কিছু খাবেন না এবং কেউ কাউকে কিছু খাওয়াবেন না'। হায় এরই নাম আধুনিকতা ও মানবতা!

কুরআন-হাদিসের সুগভীর মর্ম ভুলে গিয়ে আমরা এক ভয়াল জনপদের বিপদসঙ্কুল পথে ঘুরপাক খাচ্ছি। ফলে

আমরা আজকে একজন আরেকজনকে দেখলে ভয় পাই; আশঙ্কা করি না জানি কী হয়! আর উচ্চপদস্থ-ঊর্ধ্বতন হলে তো কথাই নেই! কারণ আমরা আজ আমাদের জীবন মরণের মূল্যবান সনদ পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে শিক্ষা নিতে সাংঘাতিকভাবে কৃপণতা করি।

আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহু  বলেন, এক লোক নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে কথা বলতে এলো। তখন ভয়ে সে কাঁপছিল। নবীজি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, শান্ত হও। আমি কোনো রাজা-বাদশাহ নই। আমি একজন সাধারণ নারীর সন্তান। (সুনানে ইবনে মাজাহ- ৩৩১২)

হাদিস গ্রন্থে শিক্ষণীয় এরকম অনেক কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমন‌ই একটি হাদিস আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে– তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, একদিন এক ব্যক্তি রাস্তায় চলার পথে অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হলো। তারপর একটি কুয়া দেখতে পেয়ে তাতে সে নেমে পড়ল এবং পানি পান করল। উপরে উঠে এসে সে দেখতে পেল একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে আর পিপাসার দরুন ভেজা মাটি চেটে খাচ্ছে। লোকটি (মনে মনে) বলল, এই কুকুরটির তেমনি পিপাসা পেয়েছে, যেমনি আমার পিপাসা পেয়েছিল। তারপর সে কুয়ার মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা পানি ভর্তি করে এনে কুকুরটিকে পান করাল। আল্লাহ তার এই কাজ কবুল করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবিরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! পশুদের ব্যাপারেও কি আমাদের পুণ্য রয়েছে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, প্রাণী মাত্রের সেবার মধ্যেই পুণ্য আছে। (বুখারি-২৪৬৬)

উল্লিখিত হাদিস আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, কেবল মানুষ নয়; যেকোনো সৃষ্টির সেবা করলে স্রষ্টা খুশি হন। আর যার প্রতি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খুশি হন নিঃসন্দেহে তার জন্য দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির দুয়ার খুলে যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ