|| নাজমুল হুদা মজনু ||
রমাদান মাসে সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য হলো মু'মিনের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে তাকওয়া অর্জন করা। স্বচ্ছ হৃদয় ব্যতীত আল্লাহর ভালোবাসা সুদূর পরাহত। আল্লাহ তায়ালার ভয় ও রহমতের আশায় বিনম্রচিত্তে তার ইবাদত করার স্পৃহা জাগরূক করার মোক্ষম সুযোগ মাহে রমাদান। তাই তো পবিত্র রমাদানকে স্বাগত জানিয়ে মুমিনের হৃদয়ে উচ্চারিত হয়— আহলান সাহলান মাহে রামাদান!
মহান আল্লাহ বলেন, 'হে মু’মিনরা! তোমাদের জন্য সিয়াম ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।' (আল-বাকারাহ-১৮৩)
সৌভাগ্যবান বান্দা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালনকারী, রাতের বেলা সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে থাকে আখিরাতের ভয় ও নিজের রবের রহমতের আশায়।’ (সূরা আজ-জুমার-৯)
রমাদানে রাত জেগে সালাত আদায়ের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা.-এর হাদিসেও তাগিদ দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত— তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমাদানের রাতে ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (বুখারি-৩৭)
আল্লাহ তায়ালার মুমিন বান্দাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— দয়াময় আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে তারা নিয়মিত রাত জেগে সালাত আদায় করে। রাতের ইবাদত সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, 'আমাদের বরকতময় রব প্রতি রাতের শেষ- তৃতীয়াংশে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন। তিনি বলেন, কে আমার কাছে দোয়া করবে আমি তার দোয়া কবুল করব, কে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দেবো, কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব।' (বুখারি)
মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনুল কারিমে রাতের সালাতের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, 'আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করবে, এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।' (বনি ইসরাঈল-৭৯)
রমাদান মাসে কিয়ামুল লাইল অর্থাৎ রাতে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করার বিষয়ে হাদিসে এসেছে,
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, 'যে ব্যক্তি রমাদান মাসে পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের আশায় কিয়াম (সালাত) আদায় করে আল্লাহ তার আগের সব পাপ ক্ষমা করে দেন।' (বুখারি)
হাদিসে আরো এসেছে— আয়েশা রা. কে রমাদান মাসে আল্লাহর রাসূলের কিয়ামুল লাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. রমাদানে কিংবা রমাদান ছাড়া অন্য সময়ে ১১ রাকাতের বেশি সালাত পড়তেন না। তিনি চার রাকাত করে সালাত পড়তেন, এ চার রাকাতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন না! এরপর আরো চার রাকাত সালাত আদায় করতেন, এ চার রাকাতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন না। এরপর তিন রাকাত (বিতর) সালাত পড়তেন। (বুখারি ও মুসলিম)
আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অন্বেষণকারী কিংবা নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারা শুধু সালাত-সিয়াম পালন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। তারা অনবরত অগ্রসর হন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে। দুনিয়ার যেখানেই মুসলিমদের ওপর আক্রোশ ও আক্রমণ হয় সেখানে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করেন।
কারণ ইসলাম কায়েমের জন্য ও আল্লাহর হুকুম পালনে যেখানে বাধা আসে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা মহান আল্লাহর চিরন্তন নির্দেশ। আর এর ধারাবাহিকতা চলবে কিয়ামতের আগ পর্যন্ত।
তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের এ কি হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে সেসব অসহায় নর-নারী ও (দুস্থ) শিশু সন্তানদের (বাঁচানোর) জন্য লড়াই করো না, যারা (নির্যাতনে কাতর হয়ে) ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের মালিক, আমাদের জালেমদের এই জনপদ থেকে বের করে (অন্য কোথাও) নিয়ে যাও, অতঃপর তুমি আমাদের জন্য তোমার কাছ থেকে একজন অভিভাবক (পাঠিয়ে) দাও, তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য একজন সাহায্যকারী পাঠাও! (আন্-নিসা : ৭৫)
অসহায় নারী-শিশুরা জালিমের জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে ফরিয়াদ করছে; কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে কী ভূমিকা রাখছি?
আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন, যেসব মানুষ পরকালের বিনিময়ে এ পার্থিব জীবন ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিক্রি করে দিয়েছে, সেসব মানুষের উচিত আল্লাহ তায়ালার পথে লড়াই করা, কারণ যে আল্লাহর পথে লড়াই করবে, সে এ পথে জীবন বিলিয়ে দেবে কিংবা সে বিজয় লাভ করবে, অচিরেই আমি তাকে (এ উভয় অবস্থার জন্যই) বিরাট পুরস্কার দেবো। (আন্-নিসা : ৭৪)
মনে রাখতে হবে, ইসলামের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ। আর তা সংঘটিত হয় পবিত্র মাহে রমাদানে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'স্মরণ করো! যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন, তারা সংখ্যায় অল্প। যদি তিনি তাদের সংখ্যায় বেশি দেখাতেন তবে তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি করতে; কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরের খবর জানেন।' (সূরা আনফাল : ৪৩)
পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস রমাদানে আমরা যদি কুরআনে বর্ণিত দয়াময় আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ পালনে সচেতনভাবে সচেষ্ট হই তাহলেই আমাদের সিয়ামব্রত পালন করা সফল ও সার্থক হবে।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক
এনএ/