শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা নেতানিয়াহুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইসরায়েলি নাগরিক গ্রেপ্তার 'উলামায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব'   নিউইয়র্কে যাদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার গাজাজুড়ে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ২৮ ফিলিস্তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত 'ঢাবি ও জাবির হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে' ঢাবিতে যুবক হত্যায় ছাত্রলীগ নেতাসহ ৩ জন আটক কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে বিসিএস এ অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া বৈষম্য: মুফতী ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই  সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ঢাকায় সাংবাদিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ

হামাস কর্তৃক শিশু হত্যার প্রমাণ দিতে পারছে না ইসরায়েল


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি : সংগৃহীত

গত ৭ অক্টোবর সকালে ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গ্রুপ হামাস। এরপর কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে হামাস যোদ্ধাদের হাতে ইসরায়েলি শিশুদের শিরশ্ছেদের ভয়ংকর খবর, ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হতে থাকে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। অবধারিতভাবেই একটি হিংসাত্মক ও তিক্ত যুদ্ধে এসব খবর ও অনলাইন কনটেন্ট বিশেষভাবে উসকানি হিসেবে কাজ করেছে। 

এই উসকানির সর্বশেষ প্রতিফলন দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের উইল কাউন্টিতে ছয় বছরের ফিলিস্তিনি এক শিশুকে ২৬ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন বাড়ির মালিক। শিশুটির মাও গুরুতর আহত। ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের ক্ষোভ থেকেই এ হামলা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন সেই ব্যক্তি। তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

ইসরায়েলি শিশুদের শিরশ্ছেদ করে হত্যার ছবি, ভিডিও ও সংবাদ প্রতিবেদনগুলো কিন্তু কেউ-ই কোনো স্বাধীন সূত্র থেকে নিশ্চিত হতে পারেনি। সব তথ্যই সরবরাহ করেছে ইসরায়েলে সামরিক বাহিনী ও সরকার। খবরগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হতে না পেরে কিছু কিছু অবশ্য পরে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। 

শিশুদের শিরশ্ছেদ করা নিয়ে সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল দাবিটি এসেছিল গত বুধবার রাতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তখন বলেছিলেন, তিনি সন্ত্রাসীদের হাতে শিশুদের শিরশ্ছেদের ফটোগ্রাফিক প্রমাণ দেখেছেন। হোয়াইট হাউস অবশ্য পরে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন শিরশ্ছেদ সম্পর্কিত যেসব সংবাদ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোতে ফটোগ্রাফিক প্রমাণ অন্তর্ভুক্ত বা উল্লেখ করা হয়নি। 

তবে বাইডেনের সেই বিবৃতি পশ্চিমা অধিকাংশ গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল। পরে কেউ কেউ গাজায় প্রতিশোধমূলক ইসরায়েলি হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ন্যায্যতার সপক্ষে এসব খবরের উল্লেখ করেছেন।

হামাসের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত কিছু ছবিতে শিরশ্ছেদকারী সৈন্যদের দেখানো হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গত বৃহস্পতিবার হামাসের হাতে নিহত ও পুড়িয়ে ফেলা শিশুদের ছবি পোস্ট করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত শিশুদের শিরশ্ছেদের দাবির সমর্থনে কোনো ছবির প্রমাণ কেউ হাজির করেনি। 

শিশুদের শিরশ্ছেদ এবং নারীদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে হামাস। হামাস বলছে, এগুলো সর্বৈব মিথ্যা।

সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই যেকোনো তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে গণমাধ্যমের ব্রেকিং নিউজে এই প্রবণতা এখন বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। ফলে ভুল বা মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃত তথ্য মুহূর্তের মধ্যে বৃহত্তর দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছে যায়। কখনো কখনো সোশ্যাল মিডিয়াই হয়ে ওঠে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের খবরের প্রাথমিক উৎস। সেগুলোতে প্রভাবিত হন রাজনীতিক, অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী শ্রেণি-পেশার মানুষ। সবচেয়ে সমস্যার বিষয় হলো, তাৎক্ষণিক পাওয়া এসব খবরের ফলোআপে পূর্বের তথ্য প্রত্যাহার বা প্রসঙ্গ যোগ করা হলেও সেগুলো আর আগের দর্শক-শ্রোতাদের কাছে সাধারণত পৌঁছায় না। ফলে প্রথম পাঠক বা শ্রোতা ভুল তথ্যই বিশ্বাস করতে থাকেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিবৃতিটি মূলত ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে একাধিক সংবাদ প্রতিবেদন ও মন্তব্যের ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সেই সব দাবি পরে হয় প্রত্যাহার করা হয়েছে, নয়তো তাঁদের দাবির পক্ষে সুর নরম হয়েছে। 

হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মতো ভুল তথ্য অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের অতিরঞ্জিত গল্প পরে প্রায়ই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ইসরায়েলি শিশুদের শিরশ্ছেদ সম্পর্কিত দাবিগুলো সবই এসেছে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে। এগুলো যাচাই করা কঠিন। এগুলোর স্বচ্ছতার বিচার করার সুযোগ না থাকায় এ ধরনের খবর এখনো অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে সেগুলো সূত্র হিসেবে উল্লেখও করছে। 

মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির একজন ডিসইনফরমেশন গবেষক আলেক্সি আব্রাহামস যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার দরকার নেই, ঘটনা হিসেবে এটি আপনার প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভয়ংকর। এটা অবশ্যই সাধারণ উদ্বেগের বিষয় যে, খবরটি এরই মধ্যে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলবে।’

গত বুধবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর একজন মুখপাত্র মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, হামাসের হামলার পরে দক্ষিণ ইসরায়েলে শিশু ও অল্প বয়সীদের ‘মাথা বিচ্ছিন্ন’ অবস্থায় পাওয়া গেছে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল নাগাদ একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, সরকার শিরশ্ছেদের দাবির বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি। 

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শিরশ্ছেদের দাবির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার অবস্থায় তাঁরা ছিলেন না। 

এ সম্পর্কিত অনেক খবর ইসরায়েলি সৈন্য এবং ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকেই এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইডিএফের একজন মুখপাত্র গত মঙ্গলবার বিজনেস ইনসাইডারকে বলেন, সৈন্যরা শিরশ্ছেদ করা শিশুদের লাশ খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু পরদিন বুধবার তাঁরা বলেছেন, এই দাবির বিষয়ে তাঁরা কোনো তদন্ত বা প্রমাণ হাজির করবেন না। বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ আইডিএফের একজন মুখপাত্র এক্স প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা একটি ভিডিওতে বলেন, দাবির প্রতি আইডিএফের ‘তুলনামূলক আত্মবিশ্বাস’ রয়েছে। 

গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের একটি গ্রুপের সঙ্গে কথোপকথনে আইডিএফের জাতীয় অনুসন্ধান ও উদ্ধার ইউনিটের প্রধান কর্নেল গোলান ভাচ বলেন, তিনি একটি শিশুর লাশ মাথা কাটা অবস্থায় পেয়েছেন। 

কাতারের হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক ওয়েন জোনস ভুল তথ্য নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি এনবিসি নিউজকে বলেন, তিনি দেখেছেন যে ‘৪০টি শিশুর শিরশ্ছেদ’ করার অভিযোগের উৎসটি মূলত একটি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচারিত ভাইরাল ক্লিপ। 

ব্যক্তিমালিকানাধীন ইসরায়েলি নিউজ আউটলেট আই ২৪ নিউজের (i 24 NEWS) একজন সংবাদদাতা নিকোল জেডেক ওই ভিডিওতে বলেন, ইসরায়েলি সৈন্যরা তাঁকে বলেছেন, তাঁরা ‘মাথা কাটা শিশু’ খুঁজে পেয়েছেন। ভিডিওটি এক্স প্ল্যাটফর্মে ১ কোটির বেশিবার দেখা হয়েছে। আরেকটি টুইটে জেডেক লিখেছেন, সৈন্যরা তাঁকে বলেছিল, তাদের ধারণা ৪০টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। 

মার্ক ওয়েন জোনস বলেন, ‘এখানে দুটি আলাদা তথ্য। কিন্তু কোনোভাবে সেই দুটি তথ্য সংযুক্ত হয়ে একটি গল্পে পরিণত হয়েছে—“৪০টি শিশুর শিরশ্ছেদ করা হয়েছে”। আর ব্রিটেনের ছয় বা সাতটি সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় এই খবর ছাপা হয়েছে।’ 

আইডিএফের একজন মুখপাত্র ডোরন স্পিলম্যান গত মঙ্গলবার এনবিসি নিউজকে বলেন, তিনি আই ২৪ নিউজের প্রতিবেদনটির সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেননি। 

ইসরায়েলের বেসামরিক জরুরি প্রতিক্রিয়া সংস্থা জাকার দক্ষিণাঞ্চলের অপারেশন প্রধান ইয়োসি ল্যান্ডউ সিবিএস নিউজকে বলেন, তিনি শিরশ্ছেদ করা শিশু, বাবা-মা এবং শিশুদের লাশ দেখেছেন। তাদের নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের হাত বাঁধা ছিল। তিনি বলেন, ‘এবং আরও অনেক কিছু (দেখেছি), এসব আপাতত বর্ণনা করা যাবে না। কারণ এসব বর্ণনা করা খুবই কঠিন।’ 

এভাবে কোনো উৎস ছাড়া এবং অস্পষ্ট দাবিগুলো অনলাইনে ভাইরাল হয়ে গেছে। এগুলো হামাসের নিষ্ঠুরতা এবং হীনতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ‘হামাস কি শিশুদের হত্যা করেছে?’ এ ধরনের সার্চ এখন গুগলে রীতিমতো ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। 

বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এসব অসমর্থিত তথ্যের উল্লেখ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে হামাসের নিন্দা করছেন। ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে তাঁরা সাফাই গাইছেন। এর মধ্যে রয়েছেন হলিউডের ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’ তারকা নোয়াহ স্ন্যাপ, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ, রিপাবলিকান মাইক ম্যাককল, এমনকি ইসরায়েলি ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবী য়ুভাল নোয়া হারারিও এসব তথ্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে হামাসের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করছেন। এই সেলিব্রেটি ব্যক্তিদের সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ ফলোয়ার। ফলে এর প্রভাব কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়! 

অধ্যাপক মার্ক ওয়েন জোনস দেখেছেন, ‘৪০টি শিশুর শিরশ্ছেদ করা হয়েছে’—এ ধরনের দাবি প্রচার করা প্রধান অ্যাকাউন্টগুলো সবই আই ২৪ নিউজের এবং ইসরায়েলের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট। 

জোনস বলেন, ‘শিশুর গল্প খুব আবেগপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে এগুলো এমন গল্প যা একটি অত্যন্ত নৃশংস প্রতিক্রিয়াকে যৌক্তিক করে তুলতে ব্যবহার করা যেতে পারে।’

সুত্র: এনবিসি ও আল জাজিরা 

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ