|| শাকের হোসাইন শিবলি ||
এক.
দেশের আলোচিত কওমি মাদরাসাগুলোর মধ্যে চৌধুরীপাড়া মাদরাসা একটি। ১৯৯১-৯২ সালে মাদরাসা শিক্ষাক্রমের সর্বোচ্চ শ্রেণী দাওরায়ে হাদিস চালু হওয়া এবং এই প্রতিষ্ঠানটি এতো স্বল্প সময়ে সাফল্যের শীর্ষ চূড়ায় গিয়ে পৌঁছলো কি করে? মাওলানা ইসহাক ফরিদীর মতো মনীষা যদি হাল ধরেন তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের নেপথ্য কারণ খুঁজে পেতে আর কালক্ষেপণ করতে হয় না।
দুই.
মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসায় পড়া অবস্থায় ভারতের সায়্যিদ আস'আদ মাদানীর আগমন উপলক্ষে সেখানে বেশ কয়েকবারই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ঠিক দেখা হয়েছিল বলা যাবে না বরং দূর থেকে দেখেছিলাম। দেশের একটি আলোচিত মাদরাসার স্বনামধন্য প্রিন্সিপাল এবং একজন খ্যাতনামা লেখকের সঙ্গে আমার মতো অতি সাধারণ একজন ছাত্রের সালাম-মোসাফাহা করা এবং দু-এক বাক্য কথা বলা সে তো সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল।
তিন.
২০০৩-এর মধ্যভাগে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও ইসলামি রাজনীতিকদের নিয়ে 'যুগান্তর' এর জন্য একটি সাক্ষাৎকার সিরিজ শুরু করি। কওমি মাদরাসার সিলেবাস, শিক্ষা কারিকুলাম এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি-সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু প্রথমে এগুলো থাকলেও পর্যায়ক্রমে সমকালীন অন্যান্য বিষয়-আসয়ও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
চার.
'যুগান্তর' এর পক্ষ থেকে ইসহাক ফরিদীর সাক্ষাৎকার নিতে রওয়ানা করি চৌধুরীপাড়া মাদরাসার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে তাঁর হাতে গড়া প্রিয় ছাত্র, লেখক মাওলানা মুজাহিদ হুসাইন ইয়াসীন। তিনি জানালেন, আগেই তাঁর সঙ্গে এ্যাপয়েনমেন্ট করা আছে। ঠিক এগারটায় গিয়ে তাঁর রুমে হাজির হই আমরা দু'জন। একটি সাধারণ ডেস্কের ওপর খাতা-কলম নিয়ে বসা শীর্ণকায় গড়নের মাওলানা ফরিদীকে দেখে কিছুটা চমকেই উঠি। তাঁর চারপাশের অতি সাধারণ অবস্থা দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, ইনিই কি সাক্ষাৎকারদাতা বিখ্যাত সেই ইসহাক ফরিদী? ৮
পাঁচ.
আমি তখন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে, পকেটে রাখা মোবাইলের রিং টোনটি হঠাৎ বেজে উঠল। মোবাইল ফোনটি কানের কাছে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে যে কণ্ঠটি শুনতে পেলাম তা পরিচিত মনে হলো, মুহুর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলাম তিনি আর কেউ নন সপ্তাহ খানেক পূর্বে ঢাকায় কথা বলে আসা সেই ইসহাক ফরিদী। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথা থেকে? তিনি বললেন, মাওলানা মুজাহিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। এরপর বললেন, মাওলানা আপনাকে বহু শুকরিয়া, সাক্ষাৎকারটি ছাপানোর জন্যে। একদিন মাদরাসায় এসে চা খেয়ে যাবেন
ছয়.
২০০৩ থেকে ২০০৪। সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকে। চায়ের দাওয়াত কবুল করলেও পেশাগত ব্যস্ততার কারণে 'হুজুরের' কাছে আর যাওয়া হয়ে উঠে না। ২০০৪ এর শেষ দিকে একদিন 'হুজুর' নিজেই আমাকে ফোন করলেন। ফোন রিসিভ করে প্রথমেই 'হুজুরের' কাছে যেতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। তিনি বললেন, মাওলানা আমাদেরকে একেবারে ভুলে গেলেন বুঝি। আপনারা অনেক ব্যস্ত সাংবাদিক। ইসহাক ফরিদীর সেই দরাজ কণ্ঠটি তখন কেমন যেন মৃয়মান মনে হলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর আপনি কেমন আছেন এবং কি মনে করে ফোন করলেন? তিনি বললেন, মাওলানা ভালো নেই। আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে। একদিন সময় করে আসেন না। এরপর একদিন চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় গেলাম। গিয়ে দেখলাম সত্যিই তিনি ভালো নেই। আমি হুজুরকে বললাম, হুজুর আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি। বললেন আমার জন্যে শুধু খাছ করে দোয়া করবেন। সেদিনের মতো 'হুজুরের' কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
সাত.
গেল ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ একদিন গিয়ে 'হুজুরের' কাছে হাজির হই। সাক্ষাৎকার সিরিজটি দিয়ে একটি বই করতে চাই-'হুজুরকে এই প্লানিংয়ের কথা জানালাম। প্ল্যানিংয়ের বিস্তারিত শুনে তিনি যার পর নাই খুশি হলেন এবং জানতে চাইলেন, বইটি কবে নাগাদ বের হচ্ছে...। আরও বললেন, আমার জন্য দু'শ কপি বই নিয়ে আসবেন।
মার্চের শেষ দিকে বইয়ের কপি নিয়ে 'হুজুরের' কাছে যাই। বইয়ের কপি হাতে প্রফুল্ল চেহারার 'হুজুরকে দেখে খুব বেশি আপন মনে হলো।জোহরের নামাজ শেষে বাসা থেকে তরকারি এনে এক সঙ্গে ভাত খাওয়ালেন। আমাদের সঙ্গে বসে আট দশ বছরের অমিত চেহারার একটি বালকও ভাত খেল। আমি ওর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমার বড় মেয়ের ঘরের নাতি-তাসনীম। সেই সঙ্গে পারিবারিক অনেক কথাই চলে এলো। হুজুর জানালেন, তাঁর ছয় মেয়ে এক ছেলে। আমি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বড় নাতির বয়স যদি দশ বছর হয় তাহলে আপনি বিয়ে করেছেন কত বছর বয়সে। হুজুর স্বহাস্যে বললেন, চৌদ্দ-পনের বছরে। এরপর কৌতুক মাখা কণ্ঠে আরও বললেন, অল্প বয়সে বিয়ে করেছি বলেই অন্য কোন চিন্তা-ভাবনা করতে হয়নি। সেই অল্প বয়স থেকেই এক ধ্যান এক মনে কাজ করে আসতে পারছি। তাড়াতাড়ির বিয়েতে অনেক ফায়দা আছে বুঝলেন মাওলানা। বিয়ে করেন না কেন এখনও?
আট.
এরপর থেকে 'হুজুরের' সঙ্গে বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও জনসমাবেশে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হয়। টুকটাক কথা-বার্তাও হয়। তবে দু'জনের মাঝে সম্পর্কের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে থাকে একটি মাত্র বই-'সাক্ষাৎকার'। হুজুরকে জানালাম, এক-দেড় মাসের মধ্যে 'সাক্ষাৎকার'-এর প্রায় দশ হাজার কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। এর পরবর্তী সংস্করণের জন্য 'হুজুরের' অংশটির কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনীও করিয়ে নিলাম। সাথে সাথে জানতে চাইলেন, এই সংস্করণটি কবে বের হচ্ছে। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম যে শিগগিরই বের হবে, ইনশাআল্লাহ।
নয়.
একদিন বললেন, কি ব্যাপার মাওলানা, আপনার লেখা-টেখা এখন আর দেখি না? মুজাহিদের লেখা তো দেখি। হুজুরকে জানালাম, 'যুগান্তর' ছেড়ে প্রকাশিতব্য নতুন দৈনিক 'সমকাল'এ আমি যোগ দিয়েছি। তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আমি তাকে সব জানালাম। শুনে বললেন, আমি দোয়া করি। আল্লাহ আপনাকে অনেক বড় বানাক। এরপর বললেন, মাওলানা আমি কিন্তু আপনার পাতায় লিখতে চাই। বললাম, হুজুর আমিও তো চাই যে, আপনাদের মতো লেখকরা দৈনিকগুলোতে আসেন, তিনি বললেন ভাই, আমরাও চাই কিন্তু কারও ওপর যে নির্ভর করতে পারি না। লেখা দেই একরকম আর পত্রিকায় ছাপা হয় অন্যরকম। সেজন্য পত্রিকাগুলো থেকে আমার আস্থা উঠে গেছে। তবে আপনার প্রতি আমার আস্থা আছে। এরপর একটি লেখা বের করে দিয়ে বললেন, মাওলানা, পারলে এই লেখাটা ছেপে দিবেন এবং আরও বললেন, মাওলানা, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে এবং আমি জানি এটা কেবল আপনার দ্বারাই সম্ভব।
বললেন, ইসলামি লেখক-কলামিষ্টদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক একটি গ্রন্থ করতে হবে। আমি বললাম হুজুর এটা তো অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয় বহুল কাজ। তিনি বললেন, মাওলানা, টাকার ব্যবস্থা আমি করবো। আপনি শুধু প্রকল্পটা হাতে নিন। আমি হুজুরকে কথা দিলাম চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
দশ.
একদিন বললেন, মাওলানা, পারলে দেওভোগ এবং বাড্ডা মিফতাহুল উলুমে পঞ্চাশ করে একশ' কপি 'সাক্ষাৎকার' পাঠিয়ে দেন। আমি ছাত্রদের বলে দেব। বললাম, বাড্ডা এবং দেওভোগ মাদরাসায় কি আপনি যান? বললেন, আমি তো দু'জায়গায় বুখারি পড়াই। শুনে বিস্মিত হলাম। বলে কি? 'হুজুর' তিনটি মাদরাসায় বুখারি পড়ান। একাধিক মাদরাসা পরিচালনা করেও অবিশ্রাম, অবিশ্রান্ত ধারায় যিনি লিখে যান দিবা-নিশি, কি রাজনীতি আর কি ওয়াজের মাহফিল, সব জায়গায় যার সরব উপস্থিতি এতো এক বিরল ও বিস্ময়কর প্রতিভা দেখি।
কথা প্রসঙ্গে আরেক দিন বললেন, মাওলানা, আবু দাউদ মুহাম্মদ যাকারিয়া (চ্যানেল আই-এর 'ইসলাম কি বলে' অনুষ্ঠানের পরিচালক) টিভিতে প্রোগ্রাম করার জন্যে আমাকে কয়েকদিন অনুরোধ করেছেন। আমি যাইনি। হুজুর আপনি যাননি কেন? বললেন, মাওলানা, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক কিছু করতে মন চায় কিন্তু আর করা হয়ে উঠে না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় হক্কানি আলেমরা ঢুকুক। এই সাইডগুলো তাদের দখলে চলে আসুক।
এগার.
রাজধানীর একটি তিনতারা হোটেলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী স্মরণে অনুষ্ঠিত শোক সভার মঞ্চে মাওলানাকে দেখেও দেখা না করে চলে আসি। পরে পল্টনে জমিয়তের নতুন অফিস দেখতে গিয়ে সেখানে মাগরিব পড়ি। মাগরিবের সুন্নাতের সালাম ফেরানো শেষ হতেই দেখি দরজায় 'হুজুর দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়! কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করলেন, মাওলানা, 'সাক্ষাৎকার-এর নতুন এডিশন বের হয়েছে? বললাম, না, এখনও বের সমঠুন এডিশন বের হয়েছে? বললাম হয়নি। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি বের করে ফেলেন।
বার.
'হুজুরের' দেয়া এ্যাসাইন্টমেনটিও করতে পারলাম না। সাক্ষাৎকারের নতুন এডিশন এখনও বের হয়নি। শুধু ছাপতে পেরেছি তাঁর লেখাটি তাও তাঁকে স্মরণ করে! 'হুজুর' কিছু না বলে এতো তাড়াতাড়ি এভাবে চলে গেলেন কেন?
-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া
এনএ/