|| গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী ||
তামাশাবৃত পৃথিবীকে আলোকিত করতে জ্বলে অনেক প্রদীপ। ক্ষণকালীন এ প্রদীপগুলো নিজের সর্বসত্তাকে অকুণ্ঠ চিত্তে বিকিরণ করে আলোয় উদ্ভাসিত করে ধরীত্রিকে। প্রদীপালোকে সকল আঁধার বিদূরিত হয়। আলো ঝলমল হয়ে ওঠে তামাম জাহান।
তেমনি সমাজের নিষ্প্রদীপ মানুষদেরকে পৃথিবীর মিথ্যা মোহ থেকে বিমুক্ত করে চির সফলতা ও মুক্তির সত্যালোকে উদ্ভাসিত করার অভিপ্রায়ে যুগের পথিকৃতেরা প্রজ্জোলিত হন ঐশী ইলমের জ্ঞান প্রভা করে। সমাজ ও সমাজের মানুষকে সে পবিত্র করে। গড়ে ওঠে চেতনাদীপ্ত এক আলোর মিছিল।
পূণ্যাত্তা রাহবারদের সোনালী ধারার প্রস্রবণ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে বহমান। বর্ণালী এ মহান কাফেলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন ক্ষণজন্মা সাধক, প্রতিভাধর আলেমেদীন আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ.। দিগ্বীজয়ী এ মহামানব নিরলস অধ্যবসা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর সাধনার ফলে অতি স্বল্প সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সারিতে নিজের নাম অংকিত করতে সক্ষম হন। যা নিঃসন্দেহে এক বিরল দৃষ্টান্ত। সমাজের সংকীর্ণমনা মানুষের হিংসা- বিদ্বেষ শত্রুতা ও পরশ্রীকাতরতার তিক্তময় সকল বেড়াজাল ছিন্ন করে তিনি সর্বদা দৃঢ় পদে এগিয়ে চলেছেন সম্মুখপানে। পৌছতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রতিটি পদক্ষেপের লক্ষ্যাভিষ্ঠে। জয় করেছিলেন এ পৃথিবী। তিনি ছিলেন এক সফল মানুষ।
তাঁকে যতবার দেখেছি সর্বদা তাঁর চেহারায় দেখতে পেয়েছি নবোদ্যমে উজ্জীবিত এক বিপ্লবী সিপাহসালারের রুদ্রাকৃতি। তাঁর জীবন ছিল বর্ণিল ও রাসূলাদর্শের রৌশন সিতারায় প্রজ্জ্বোল ও প্রদীপ্তময়। জাগাতে চেয়েছেন আলসে ঘুমে মত্ত বীরের জাতিকে। তাইতো কখনও বয়ানের ময়দানে, কখনও লিখনীর ময়দানে, আবার কখনও আধ্যাত্মিকতার ময়দানে ছুটাছুটি করেছেন। সকল ময়দানেই উম্মতকে মুক্তির পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর দেখানো পথে ইলমে নববীর জ্ঞানাবিজ্ঞ অসংখ্য সৌভাগ্যবান আলেম যার উজ্জ্বল প্রমাণ।
জাতির এত প্রয়োজনীয় ও বড় আপন এ মানুষটির প্রয়াত অনেককেই মেনে নিতে কষ্ট হয়। তারপরও মহান প্রভুর সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হয়। তাঁর শাহাদাতের শোকময় খবর শুনলাম ৫ই জুন বাদ ফজর সাত মসজিদে। খবর শুনে সকলেরই শোকশপ্ত হৃদয়ের গভীর থেকে কাঁপা কণ্ঠে বের হয়েছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইল্লা ইলাইহি রাজিউন)।
মসজিদ হতে বের হতেই জামিয়া রাহমানিয়ার ছাত্ররা বিস্ময়াভূত হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল। শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সকলেই। কারো মুখে কোন কথা নেই। তখনকার বেদনাক্লিষ্ট সে অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। অনেক ছাত্রকে দেখেছি যারা কোনদিন এ মনীষীর সাথে সাক্ষাত করতে পারে নি, ছিল না কোন ব্যক্তিগত পরিচয়, তারপরও তাদের চোখ থেকে অনবরত প্রবাহিত হয়েছে তপ্ত অশ্রুধারা। নিঃসন্দেহে আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. আলেম-উলামা ও ছাত্র-জনতার হৃদয় জমিনে এক অনন্য মাকাম তৈরি করে নিয়েছিলেন।
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. নিজের অসুস্থতা সত্ত্বেও বার বার জানতে চেয়েছেন জানাযা কখন হবে? তিনি কখন রওয়ানা দিবেন? হজরতের এই উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা দেখে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ইসহাক ফরিদী রহ. শায়খের কত প্রিয় মানুষ ছিলেন। দুপুর ১টা শায়খের সাথে পৌঁছলাম মরহুমের স্মৃতিধন্য চৌধুরীপাড়া মাদরাসায়। গাড়ি থেকে নামার পর একটি কথাই বার বার মনে পড়ছিল, এত সেই মাদরাসা এখানে এলে প্রতিবারই যার সাথে সাক্ষাত হয়েছে, যার অমায়িক স্নেহ, অকৃত্রিম ভালবাসা ও হাসিমাখা ব্যবহারে, হৃদয়ের টানে বার বার এসেছি, সেই মানুষটিতো আজ আর নেই। তিনি চলে গেছেন দূরে-বহুদূরে। তাইতো আজ মাদরাসাটিকে মনে হচ্ছে আত্মাহীন এক দেহ। সন্তানহারা মা।
সদা হাস্যোজ্জ্বল ঝাঁকড়া মাথায় শুভ্র টুপি পরিহিত, কাঁধে সবুজ রুমাল, দীপ্তিময় সেই হর্সোৎফুল্ল ইসহাক ফরিদী রহ. আর কোনদিন মাদরাসা দফতরে বসবেন না। কারও সাথে সাক্ষাত করবেন না। যার নামের শেষে সর্বদা দামাত বারাকাতুহুম বলতাম, এত অল্প সময়ে তাঁর নামে রহ. বলতে হবে তা কখনো ভাবিনি। পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিতে পারেন কিন্তু লাখো মানুষের মন- মাজারে তেমনি জীবন্ত, যেমন জীবন্ত তার জান্নাতি কবরে। পরিশেষে বিখ্যাত কবি আলতাফ হোসেন হালীর কাব্য দিয়েই শেষ করছি:
যুগ যামানা বদলে দিতে চাইনা অনেক জন এক মানুষই আনতে পারে জাতির জাগরণ। এক মানুষই বিপদকালে বাঁচায় কাফেলায় ক্ষুদ্র ডিঙ্গা বাঁচায় জাহাজ অসীম দরিয়ায়। এমনি করে চলছে কোথায় রাত্রি দিন ও মন একটি বাতি জ্বালাতে পারে হাজার বাতির প্রাণ।
আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. ছিলেন কবির এই অমর পংক্তিমালার মূর্ত প্রতীক।
-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া
এনএ/