|| মুফতি এনায়েতুল্লাহ্ ||
মৃত্যু মানবজীবনের স্বাভাবিক পরিসমাপ্তির এক কুদরতি প্রক্রিয়া। মানুষ মরণশীল। 'জন্মিলে মরিতে হবে' এটা চিরন্তন সত্যকথা। তারপরও কিছু মানুষের মৃত্যু সমাজকে ভাবিয়ে তোলে। হারানোর বেদনা, কষ্ট ও শূন্যতাকে জাগিয়ে তোলে। নতুন করে ভাবতে শেখায় এ জগৎ-সংসার ও সমাজ নিয়ে। মৃত্যুর কোনো পরিবর্তন নেই। নেই কোন রদবদল। তথাপি মাঝে মাঝে এমনি অকস্মাৎ কারো কারো মৃত্যু এসে যায় যে, তা চোখের সামনে ঘটতে দেখেও বিশ্বাস করা যায় না। বাস্তবিক মৃত্যু হলেও মন তা বাস্তব বলে গ্রহণ করতে রাজি হয় না।
আলোচ্য নিবন্ধে আজ আমরা এমনই এক মহা মনীষীর জীবনালেখ্য নিয়ে আলোচনা করব, যিনি খুব কম সময়ে খ্যাতির শীর্ষে নিজকে আসীন করেছিলেন। আপন মেধা, প্রজ্ঞা, সমাজসেবা, ব্যক্তিত্ব ও সাধনার মাধ্যমে ঈর্ষণীয়ভাবে। তিনি হলেন মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ.।
৬ই জুন। সোমবার। ভোর পাঁচটার দিকে বন্ধু মাওলানা আবু বকর সিদ্দীকের ফোনে যখন জানতে পারলাম যে, মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ. ইন্তেকাল করেছেন। তখন তা বিশ্বাস করাতো দূরের কথা, কথাটার সঠিক-অর্থ উপলব্ধি করার ক্ষমতাও আমার ছিল না। কারণ, মাত্র কয়েকদিন পূর্বে তাঁর সাথে আমার আলাপ। কুশল বিনিময়, ভুবন ভোলা হাসি দিয়ে বিদায় নেওয়া মানুষটি দুনিয়া থেকেই বিদায় নিবে তা কে জানে?
জন্ম
মাওলানা ইসহাক ফরিদী ১৯৫৭ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানাধীন হোগলাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুস সালাম শিকদার।
শিক্ষা
প্রকৃতি ও জন্মগতভাবে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ. নিজ গ্রাম হোগলাকান্দি জামে মসজিদ মাদরাসায় কুরআনুল কারিম হিফজ করেন। হিফজ শেষ করে নারায়ণগঞ্জ জেলার দেওভোগ, ঢাকার ফরিদাবাদ ও যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ, কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে জামিয়া শারইয়াহ্ মালিবাগ মাদরাসা থেকে সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিস পাশ করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে।
কর্মজীবন
সুযোগ্য ও প্রতিভাবান এ বুজুর্গ কর্ম হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন স্বাচ্ছন্দে। শিক্ষাঙ্গণে ঐশ্বরিক জ্ঞান বিতরণ করা হয়। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই জ্ঞানার্জন ও বিতরণের প্রক্রিয়া চলে আসছে। নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তথা মুসলমানদের বস্তুগত ও পার্থিব উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি এক মহান মিশনের সূচনা করেন ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা কাসিমুল উলুম মাদরাসায়।
এখানেই তাঁর কর্মজীবনের শুরু। পরে রাজধানী ঢাকার পীরজঙ্গী ও বারিধারা জামিয়া মাদানিয়াতেও শিক্ষকতা করেন। বিগত চৌদ্দ বছর যাবৎ রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় শেখ জনু হোসেন (জনুরুদ্দীন রহ.)-এর ওয়াকফকৃত জমিতে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ-ই-নূর ও তৎসংলগ্ন চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি মাদরাসা সংলগ্ন নূর মসজিদের খতিব ছিলেন। চৌধুরীপাড়া মাদরাসা ছাড়া তিনি আরও বেশ কয়েকটি মাদরাসার শায়খুল হাদিসের গুরু দায়িত্ব মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে পালন করে যান।
বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন অঙ্গাঙ্গিভাবে। নিজ জেলা মুন্সীগঞ্জের প্রত্যেকটি সামাজিক সংগঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। যোগ্য সংগঠক হিসেবে নিজ এলাকায় তিনি ছিলেন খুব জনপ্রিয় ব্যক্তি। এছাড়া বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট ও ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব এবং খতমে নবুওয়ত আন্দোলন পরিষদ বাংলাদেশ-এর শীর্ষ নেতা ছিলেন। তিনি রাজনীতির ময়দানে তাঁর অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
সাহিত্য কর্ম
সাহিত্য সেবাকে তিনি জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন নি কোনদিন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ- এর একাধিক বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। ২৭ খন্ডে প্রকাশিত ইসলামি বিশ্বকোষের সফল প্রবন্ধকার তিনি। এছাড়া অনুবাদ ও অন্যান্য মৌলিক রচনা মিলিয়ে প্রায় ৭০টির অধিক গ্রন্থের লেখক তিনি। প্রতিথযশা এ ব্যক্তিত্ব দেশের প্রায় সবক'টি মাসিক, সাপ্তাহিক, দৈনিকে সম-সাময়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর মার্জিত সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী লেখা সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছিল।
তাঁর সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি অনেক কঠিন কঠিন কিতাব তাঁকে অনুবাদের জন্য বলেছি। তিনি সেগুলোর অনুবাদও করেছেন। প্রাপ্য সম্মানী না পেয়েও তাঁর মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা বা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যেতো না। তাঁর যুগোপযোগী লেখনী ও সাহিত্যকর্ম ইসলামী জগতের জন্য এক অমূল্য ভান্ডার।
আধ্যাত্মিক সাধনা
ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত তাঁর স্মরণসভায় মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, আধ্যাত্মিকতার জগতে মাওলানার বিচরণ ছিল তা হয়তো অনেকের কাছে অজানা। সুলুক, সাহিত্য ও দরস-তাদরিসের কাজ ও রাজনীতির মাধ্যমে সমাজসেবা করা যে একসাথে সম্ভব তা বাস্তবে দেখিয়েছেন মাওলানা ফরিদী রহ.। তিনি ছিলেন নানুপুরের পীর সাহেবের বিশিষ্ট খলিফা।
ব্যবহারিক জীবনে তিনি ছিলেন সদালাপী, অমায়িক। তাঁর মধুর ব্যবহার আর দিল খোলা হাসি সহজেই সকলের চিত্ত জয় করতে সমর্থ হতো। স্নেহাশীস অনুজ আলেম ও সহকর্মীদের তাঁর প্রিয় ডাক 'মাওলানা'র প্রতিধ্বনি ও সেই ডাকের ঝংকার আজো আমাদের কানে বাজে।
তাঁর লালিত স্বপ্ন
মাওলানা ইসহাক ফরিদী রহ. গত বছর দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক যুগান্তরে এক সাক্ষাৎকারে খোলামেলা কথা বলেছিলেন কওমি মাদরাসার শিক্ষা, সিলেবাস, সংস্কার ও স্বীকৃতি সম্পর্কে। তাঁর এ কথাগুলো ছিল তাঁর লালিত স্বপ্ন যা তিনি বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। গৃহীত সাক্ষাৎকারের কিছু চুম্বক অংশ এখানে প্রত্রস্থ করা হলো।
মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার প্রসঙ্গে
কওমি মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ছাত্রদেরকে রাসূল সা. -এর খাঁটি উত্তরসূরী রূপে গড়ে তোলা এবং যাতে তারা শিক্ষা ও গবেষণার ময়দানে একজন ধীমান গবেষক হতে পারে, রচনা ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একজন বলিষ্ঠ লেখক ও সাংবাদিক হতে পারে, রাজনীতি ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে একজন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ হতে পারে এবং খেদমতে খালকের ক্ষেত্রে একজন নিঃস্বার্থ সেবক হতে পারে। ইহসান ও তাজকিয়ার ক্ষেত্রে একজন আল্লাহ্ ওয়ালা হতে পারে, সে হিসেবেই তাদেরকে গড়ে তোলা দরকার।
সে লক্ষ্যে আমাদের 'আকাবির ও আসলাফ' (পূর্বসূরী বরেণ্য আলেম) যে সিলেবাস তৈরি করে গেছেন এটা বুনিয়াদি (মৌলিক) সিলেবাস বলে আমি মনে করি। তবে যেহেতু সময় ও আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে, মৌসুমের পরিবর্তনের কারণে মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়, এমনিভাবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু আনুষাঙ্গিক বিষয়েরও পরিবর্তন আমি জরুরি বলে মনে করি। মূল বিষয়ে পরিবর্তন দরকার মনে করি না। তবে যে প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষিতে আমি বর্তমানে ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি বিশেষ করে বর্তমানে কম্পিউটার শিক্ষার বিষয়গুলোকে সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করা জরুরী মনে করি।
মাদরাসাগুলোতে বাংলা ভাষায় পাঠদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের পাঠদান প্রক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবে উর্দুই ছিল। ইদানীং আলহামদুলিল্লাহ্ নিরানব্বই ভাগ মাদরাসাতেই বাংলায় পড়াশোনা হয়।। হ্যাঁ উর্দু এবং ফারসি কিতাবগুলো বাংলা হতে পারে। তবে ফারসিকে সিলেবাস থেকে একেবারেই বাদ দেওয়া যাবে না।
কওমি মাদরাসার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হলো, আমি জরুরি মনে করি এ কারণে যে, আমরা যে শিক্ষিত, যদি সরকারের পক্ষে থেকে এই স্বীকৃতিটা না আসে তাহলে এ কথাটা প্রমাণিত হয় না এবং বিশেষভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মকান্ডে আমাদের অংশীদারিত্ব না থাকার কারণে আজকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যে ক্রাইম হচ্ছে এটার মূল কারণ এখানে দ্বীনের অনুপস্থিতি। উলামায়ে কেরামকে যদি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয় এবং তারা যদি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তারা যদি তাদের পরিবেশের লোকদেরকে দ্বীনি চেতনায় সমৃদ্ধ করতে পারে তাহলে আমি মনে করি অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাস, দুর্নীতি খতম হয়ে যাবে। কওমী মাদ্রাসার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়টা যেহেতু একটা জাতীয় বিষয়, কোন ব্যক্তি বিশেষ নয়; বরং জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার ডেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।
বর্তমান সিলেবাস সম্পর্কে তাঁর অভিমত
আমাদের এই সিলেবাস এককালে গণমুখী ও কল্যাণমুখী সিলেবাস ছিল। যখন মুসলমান আল্লাহমুখী ও মসজিদমুখী ছিল। যেদিন থেকে মুসলমান আল্লাহ্ বিমুখ হয়ে গেছে, সেদিন থেকেই আমাদের এই সিলেবাস গণমুখী আর থাকে নি। এটা পতিত সিলেবাসে পরিণত হয়ে গেছে।
আবার যদি মুসলমানদের আল্লাহমুখী করা যায় তাহলে যেমনিভাবে ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ রহ. সহ আরও অনেকেই অল সাম্রাজ্যের চিফ জাস্টিস ছিলেন, আজকের যুগেও উলামায়ে কেরাম বিচার বিভাগসহ সর্ব বিভাগে সফল নেতৃত্ব দিতে সক্ষম বলে আমি মনে করি। এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো, পাকিস্তানের মাওলানা ফজলুর রহমান (জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় সংসদ নেতা) মাওলানা সলিমুল্লাহ্ খান (পাকিস্তান কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান)। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করার তাওফিক দিন।
-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া
এনএ/