|| আল্লামা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রহ. ||
'জীব মাত্রই মরণশীল' এটিই এ পৃথিবীর সবচেয়ে বাস্তব সত্য। বাঙ্গালি কবি এ কথাটিকে এভাবে প্রকাশ করেছেন যে,
জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে?
চিরস্থির কবে নীর
হায়রে জীবন নদে।
কুরআনের বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণা- 'তোমরা যখন যেখানে যেভাবেই থাক না কেন, সুরক্ষিত দুর্গেই অবস্থান কর না কেন, মৃত্যুর হীম শীতল হস্ত তোমাদেরকে স্পর্শ করবে' (সুরা নিসা, আয়াত, ৭৮) কুরআন মাজজিদের এ ঘোষণা মনে প্রাণে দৃঢ় বিশ্বাস করা সত্ত্বেও অনেক সময় ব্যক্তির মেধা, কীর্তি ও অবদানের কারণে তাঁর মৃত্যুকে মেনে নিয়ে অবোধ মনকে প্রবোধ ও সান্ত্বনা দেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠে।
শেখ জনুরুদ্দীন র. দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদরাসার সফল মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (যাকে রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতে মনে বড়ই কষ্ট হয়।) এ ধরনের এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি ছিলেন। বোখারি শরিফের সফল অধ্যাপনা, সেই সাথে দক্ষ ও বিচক্ষণ প্রিন্সিপাল হিসাবে এতো বড় একটি মাদরাসার পরিচালনার দূরূহ কাজ আঞ্জাম দেওয়ার পাশাপাশি ছোট-বড় অর্ধশতাধিক ধর্মীয় পুস্তক তিনি রচনা করেছেন।
ফাতাওয়ায়ে আলমগীরীর মত দূরহ-দুর্বোধ্য ও বিরাট গ্রন্থের সফল অনুবাদে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে যাওয়া, ধর্মীয় রাজনীতির ময়দানে তাঁর সফল ও সরব পদচারণা, তৎসঙ্গে বছরের প্রায় ছয় মাস কাল যাবত নিত্যদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামি সভা, সমাবেশ, জলসা, সেমিনারে দুই তিন ঘন্টা ধরে কুরআন হাদিস ও যুক্তি নির্ভর সারগর্ভপূর্ণ উচ্চমানের বক্তৃতা প্রদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন একাডেমিক প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিভিন্ন অধিবেশনে নিয়মিত যোগদান করে বিভিন্নমুখী কর্মতৎপরতায় সীমাহীন সাফল্য প্রদর্শনের কারণেই আজকে আমাদেরকে তাঁর মৃত্যুর কঠোর বাস্তবতাকে মেনে নিতে কষ্টবোধ হচ্ছে।
যদিও মৃত্যুর কোন বয়স নেই তবুও আট চল্লিশ বছরের স্বল্প সময়ে তিনি যে বিভিন্নমুখী দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, আল্লাহ তায়ালা এর সাদাকায়ে জারিয়ার সাওয়াব তাঁর আমলনামায় কিয়ামত দিবস পর্যন্ত দান করতে থাকবেন বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
তিনি চিটাগাং জেলার নানুপুরে এক ধর্মীয় ইসলাহি জোড়ে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। পথিমধ্যে কুমিল্লার চান্দিনায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করে হাদিসে নববীর মর্ম অনুসারে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছেন এটাই আমাদের সান্ত্বনা।
মাওলানা ইসহাকের ইন্তেকালে হৃদয়ে এতটাই চোট পেয়েছি যে, তাঁর প্রতি অনুরাগ-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা, যোগ্য আলেমেদীন হিসাবে শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট পন্থা ও প্রকৃত ভাষা আজ আমি হারিয়ে ফেলেছি। বিরাম-বিশ্রামহীন নিরলসভাবে ইসলামি খিদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে এবং তাকওয়া-ত্বাহারাত ও জিকির-আযকারে নিজেকে লিপ্ত রেখে তিনি যে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তাঁর উপমা খুঁজে পাওয়া ভার।
সদাহাস্য, মিষ্টভাষী এই লোকটি তাঁর নিরলস কর্মতৎপরতা ও আদর্শবাদিতা দ্বারা দেশের মান্যবর সকল উলামায়ে কিরাম, আপন আসাতিযায়ে কিরাম, ছাত্র-তালিবে ইলম, সহপাঠী, সহকর্মী ও বন্ধু-বান্ধব হতে শুরু করে জনসাধারণের হৃদয় সিংহাসনে তিনি যে কতটুকু স্থান দখল করেছিলেন, সেদিন তাঁর জানাযায় শরীক হওয়া হাজারো ভক্ত মানুষের নীরবে অশ্রু বিসর্জন সে কথাই প্রমাণ করে দিয়েছে।
নম্র, ভদ্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, সীমাহীন মেধা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও বিভিন্নমুখী প্রতিভার অধিকারী প্রাণপ্রিয় এ ছাত্রের কর্মতৎপরতা দেখে বড়ই আশান্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, দেশ ও মুসলিম মিল্লাতের এ দুর্দিনে জাতির সামনে ভবিষ্যতের জন্য এক বলিষ্ঠ ও দক্ষ কাণ্ডারী রেখে যেতে পারব।
আশা ছিল যে, তাঁর এ সকল গুণাবলী ও খিদমত আমাদের আমলনামাতেও সাদাকায়ে জারিয়া হিসাবে গণ্য হবে আরো বহু বছর ধরে; কিন্তু মানুষের সকল আশাই তো আর সফলতার মুখ দেখে না। তিনি মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমালেন পরপারে।
তাঁর মৃত্যুতে এ দেশের ধর্মীয় অঙ্গনে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হল তা কখনো পূরণ হবে কি না জানি না। তবে তাঁর অবদানের কথা জাতি স্মরণ করবে যুগ যুগ ধরে, লেখা থাকবে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে।
সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালা তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উঁচু মাকাম দান করুন এই দোয়া জানিয়েই শেষ করছি।
-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া
এনএ/