।। মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বড় মেহেরবানী, তিনি আমাকে ও সফরসঙ্গীদেরকে এখানে হাজির হওয়ার তাওফীক নসীব করেছেন আলহামদু লিল্লাহ। তালিবে ইলম ভাইদের মজমায় বসতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়।
أحب الصالحين ولست منهم/لعل الله يرزقني صلاحا.
হাকীকী অর্থে তালিবে ইলম হতে পারা তো বহুত বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আমি সে রকম তালিবে ইলম না হতে পারলেও আল্লাহ যে আমাকে তালিবে ইলমের মজমায় নিয়ে এসেছেন এবং বসার তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করি-
اللهم لا أحصي ثناء عليك، أنت كما أثنيت على نفسك.(مسلم)
اللهم ما أصبح بي من نعمة أو بأحد من خلقك، فمنك وحدك لاشريك لك، فلك الحمد ولك الشكر. (أبو داود)
اللهم إني أصبحت، أشهدك وأشهد حملة عرشك وملائكتك، وجميع خلقك، أنك أنت الله، لا إله إلا أنت، وحدك لا شريك لك، وأن محمدا عبدك ورسولك. ( أبو داود)
শেষোক্ত দুআটি ফজরের পরে চারবার এবং মাগরিবের পরে চারবার পড়লে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে নাজাত দেবেন। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত দুআগুলো মূলত ঈমান তাজা করার জন্য। তাওহীদের আকীদাকে মজবুত করার জন্য। আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও তাফবীযের সিফাতকে যিন্দা ও তাজা করার জন্য। নেক আখলাকের ফিকির পয়দা হওয়া এবং বদ আখলাকের ওয়াসওয়াসা গায়েব হওয়ার জন্য। এসব সিফাত হাসিলের জন্য আদইয়ায়ে মা’ছুরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য আমাদের উসতায ও মুরব্বীগণ তাকিদ করে থাকেন। অনেক দুআ আছে। সব না হোক, কিছু কিছু হোক, যার জন্য যেটা সহজ হয় নির্বাচন করে ইয়াদ করা। আর নিয়মিত আমল করতে থাকলে এমনিতেই ইয়াদ হয়ে যাবে।
আমি বলছিলাম, আল্লাহর রহমত ফযল ও করমে আমরা তালিবে ইলম। যদিও এই কথা বলতে ভয় হয়। কারণ তালিবে ইলমের যে হুকুক ও আদাব রয়েছে সেগুলো তো আসলে রক্ষা হয় না। এজন্য দাবি হিসেবে নয় বরং শোকর হিসেবে বলছি, আমরা তালিবে ইলম। এই দুআর সঙ্গে- হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হাকীকী তালিবে ইলম বানিয়ে দিন। মাদরাসার হাজিরী খাতায় আমাদের নাম তালিবে ইলম হিসেবে লিখিয়ে দিয়েছেন; অতএব ফেরেশতাদের খাতায়ও আমাদের নাম হাকীকী তালিবে ইলম হিসেবে লিখিয়ে দিন।
اللهم أحيني طالب علم، وأمتني طالب علم،واحشرني في زمرة طلاب العلم.
তালিবে ইলম কারা ছিলেন? আমাদের আকাবির ও আসলাফ ছিলেন হাকীকী তালিবে ইলম। আমাদেরকে তাঁদের পথ অনুসরণ করতে হবে। নিকটতম যামানার আকাবির এবং এখন আল্লাহ যাঁদের যিন্দা রেখেছেন সকলের অনুসরণ করতে হবে। যাঁদেরকে আল্লাহ যিন্দা রেখেছেন তাঁদের হায়াত দারায করুন এবং আফিয়াত-সালামাতের সঙ্গে রাখুন। আর যাঁরা তাশরীফ নিয়ে গেছেন আল্লাহ তাঁদের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন।
নিকটতম আকাবিরের মধ্যে হাকীকী তালিবে ইলম, যেমন খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমাদ ছাহেব রাহ.। গতকাল একজনের নাম শুনে এলাম, বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, মাওলানা মাসউদুল হক রাহ.। তাঁর শাগরিদরা বলতেন, আসমায়ে রিজাল সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা এত বেশি ছিল, মনে হত যেন সবাই তাঁর চাচাত-জ্যাঠাত ভাই। তাঁকে তুলনা করা হত মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ.-এর সঙ্গে। খতীবে আযম রাহ.-এর সঙ্গে। তিনি তো প্রায় খতীবে আযম রাহ.-এর মুআসির।
তালিবে ইলমের মধ্যে যে সিফাতগুলো থাকতে হয়। এক-দুই সিফাতওয়ালা তালিবে ইলমও তালিবে ইলম। কিন্তু ইলম সবচেয়ে বেশি নাফে হয় সেই তালিবে ইলমের, যার মধ্যে ওই সিফাতগুলো একসাথে পাওয়া যায়, যেগুলো আমাদের আকাবিরের মধ্যে সাধারণত একসাথে পাওয়া যেত।
যেমন তালিবে ইলমের একটা সিফাত হল হিফয। কুরআনের হিফয, হাদীসের হিফয এবং বুনিয়াদী মাসায়েল, বুনিয়াদী উসূল ও কাওয়ায়েদের হিফয। এটা তালিবে ইলমের একটা সিফাত। যেমন পুরো কুরআনে কারীম বা তার বড় অংশ অথবা উল্লেখযোগ্য অংশের হাফেয হওয়া। অনেকগুলো হাদীসের হাফেয হওয়া। এবং মুতুন- মুখতাসার যেসব মতন আছে সেগুলোর- কয়েকটির হাফেয হওয়া। এটা তালিবে ইলমের পুরনো সিফাত। এই যামানায় কমে গেছে। তারপরও মাশাআল্লাহ কমবেশি কিছু তালিবে ইলম আছে। ফিকিরমান্দ উসতাযগণ তাদেরকে মুতাওয়াজ্জিহ করলে বেশ কিছু মাহফুযাত তালিবে ইলমদেরও থাকে আল্লাহর রহমতে। কিছু কাওয়ায়েদ ইয়াদ থাকবে তালিবে ইলমদের। ইসতিলাহাত ইয়াদ থাকবে। যেমন আলআকীদাতুন নাসাফিয়া। ছোট্ট রিসালা। একেবারে শুরু থেকে না হোক, অন্তত-
والعالَم بجميع أجزائه مُحدَث، ...، والمُحدِث للعالَم هو الله تعالى.
এখান থেকে রিসালার শেষ পর্যন্ত। শরহে আকায়েদের কথা বলিনি। সেটা তো তাফতাযানী (৭১২ হি.-৭৯১ হি.) রাহ.-এর। সেটা একটু দীর্ঘ। আমি বলছি মতনটার কথা- ‘মাতনুল আকীদাতিন নাসাফিয়্যাহ’। নাজমুদ্দীন উমর নাসাফী (৪৬১ হি.-৫৩৭ হি.) রাহ.-এর। অনেক বড় ব্যক্তি। ছাহেবে হেদায়ার (৫৯৩ হি.) উস্তায। হাজারেরও বেশি শায়েখ থেকে ইলম হাসিল করেছেন। সেই শায়েখগণের জীবনীর উপর কিতাব লিখেছেন। তাঁর আরো অনেক কারনামা আছে।
আলআকীদাতুন নাসাফিয়া ছোট্ট রিসালা। তালিবে ইলমরা এক বৈঠকেই ইয়াদ করে ফেলতে পারে। তাতে একটি কায়দা আছে-
النصوص على ظواهرها، والعدول عنها إلى معانٍ يدّعيها أهلُ الباطن إلحادٌ.
এটা তো একেবারে বুনিয়াদী কায়দা। যরূরিয়াতে দ্বীনের শীর্ষের কায়দা।
যাহোক তালিবে ইলমের একটি সিফাত হিফয। আরেকটা সিফাত ফাহম। এটা হিফযের সিফাত থেকে আরো বেশি জরুরি। এটা তালিবে ইলমের আহাম সিফাত। ফাহমটা সাফ ও সালীম হতে হবে। সাফ মানে, যার মধ্যে ইনগিলাক বা উক্দা নেই।
وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِیْ.
উক্দা যেমন যবানে হয়, ফাহমেও হয়। কোনো ধরনের অস্পষ্টতা ও প্যাঁচ থাকবে না। এমন ফাহমকে বলে সাফ। হুজুররা অনেকসময় বলেন, ছেলেটার যেহেন সাফ। এই শব্দ আমরা অনেকসময় মাজাযান বলে ফেলি। উৎসাহ দেয়ার জন্য বলে ফেলি। অত গভীরভাবে চিন্তা না করেও বলে ফেলি। এমন হয়। কিন্তু যদি যথাযথ ব্যবহার করা হয় তাহলে এটা কিন্তু অনেক দামি বিষয়। যেহেন সাফ মানে, এর যেহেনে খলত নেই, তাখলীত নেই। বুঝটা পরিষ্কার। খলতওয়ালা বুঝকে বুঝ বলে না। খলত করতে থাকলে তো সেটা ফাহম নয়। খলত করার মানেই হল বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। অতএব উকদা (عقدة) গলক (غلق) ও খলত (خلط) মুক্ত যে ফাহম তাকে বলা হয় সাফ ফাহম। উস্তাযগণ সেটারই চেষ্টা করেন; তালিবে ইলমের মধ্যে যেন ওই ফাহমটা এসে যায়। তখন বলা হবে, এর যেহেন সাফ। এর ফাহম পরিষ্কার।
আর ফাহমটা সালীম হওয়া। সালীম মানে সুস্থ। মুক্ত। কিসের থেকে মুক্ত? ভুল থেকে মুক্ত। অর্থাৎ যথাযথ বুঝেছে। বুঝের মধ্যে কোনো ভুলের মিশ্রণ নেই। ঠিক-ঠিক বুঝেছে।
ফাহম যার সালীম হয় সে কখনো গলত কথা, গলত চিন্তা ও গলত দাওয়াত গিলতে পারে না। ফাহমে সালীম একদিনে পয়দা হয় না। ধীরে ধীরে তৈরি হয়। ফাহম যার সালীম সে কোনো মুনকার কথা মুনকার চিন্তা গিলতে পারবে না। কোনো গলত-সলত দাওয়াত কেউ তাকে দেবে আর সে সেটা গিলে ফেলবে- এটা হতে পারে না।
আজকাল কওমী মাদরাসাগুলোতে নতুন কিছু চিন্তার দাওয়াত দেয়া হয়। কিছু বইয়ের মাধ্যমে কিংবা তাশকীল করে করে নতুন চিন্তার দাওয়াত দেয়া হয়। অনেকে গিলে ফেলেছে সেই দাওয়াত। তাদের ফাহম সালীম নয়, সেজন্য গিলে ফেলেছে। ফাহম সালীম হলে গলত দাওয়াত গিলতে পারত না। কোনো আজীব-গরীব দাওয়াত যদি একজন তালিবে ইলমের কাছে আসে, তার সুওয়াল পয়দা হতে হবে। একটা সুওয়াল হল-
أين الناس عنه؟
তুমি যে দাওয়াত নিয়ে এলে আমি তো কোনো হুযুরের মুখে এই দাওয়াত শুনি না, এতদিন তো শুনিনি, এখন তুমি এটা কোত্থেকে নিয়ে এলে?
এ কথা বাস্তব- কিছু বিষয় এমন আছে, যেগুলোর ব্যাপারে কিতাবে হাশিয়া বা নোট লেখা হয়-
والناس عنه غافلون.
ফাতাওয়া শামীতে আছে বিভিন্ন জায়গায়, আদ্দুররুল মুখতারেও আছে। একটা মাসআলা উল্লেখ করে বলেন-
والناس عنه غافلون.
এই বাস্তবতা আলহামদু লিল্লাহ আমাদের জানা আছে। এ কথাও ঠিক- কিছু মাসআলা এমন আছে الناس عنه غافلون। কিন্তু প্রশ্ন হল, الناس-এর ال কি ইসতিগরাকী? ইসতিগরাকী তো নয়। ইসতিগরাকী হলে তিনি কীভাবে তাম্বীহ করছেন? তিনি কি নাসের অন্তভুর্ক্ত নন? অবশ্যই। তাহলে তিনি কীভাবে বললেন ‘ওয়ান নাসু আনহু গাফিলূন?’ এটা ইসতিগরাকী নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল-
أي جمّ غفير من الناس عنه غافلون.
কিন্ত এটা যিনি বলছেন তার বলার মধ্যেও تجوّز আছে, توسّع আছে। তিনি যে ‘গাফিলূন’ বলছেন, কীসের ভিত্তিতে? সবার মতামত নিয়ে বলছেন? তা করেননি। তিনি এ বিষয়টার আম তাযকেরা দেখেন না, শোনেন না। অনেকের মাঝে আমলের ক্ষেত্রেও উদাসীনতা দেখেন। সে কারণে তিনি এ কথাটা বলেছেন। এটা দাওয়াতী ভাষা, ফিকহী ভাষা নয়। ফিকহের কিতাবে লিখছেন কথাটা কিন্তু ভাষাটা দাওয়াতী। অতএব একথা যেমন ঠিক, কিছু জিনিস এমন, যেগুলোর ব্যাপারে অনেকেই বেখবর, তেমনি এ কথাও ঠিক, যারা বা-খবর তারা তো এ সম্পর্কে বেখবর নন। যখন আমরা দেখি, বা-খবর যারা, তাদের ঠিকই এ সম্পর্কে খবর আছে তখন কিছু মানুষ বেখবর হওয়ার কারণে আমরা এই সহীহ বিষয়কে ইনকার করব না এবং এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করব না। والناس عنه غافلون বলেই তো তিনি থেমে যাননি, এর আগে তিনি তার দালায়েল উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তার কথার সিহ্হাত সাবেত হওয়ার পর এখন তিনি মাজাযান والناس عنه غافلون বাড়িয়ে বলে থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। এরকম অবশ্য ঘটে যে, প্রমাণসিদ্ধ কিছু বিষয়ের ইলম কিছু মানুষের থাকে না। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি যেটা ঘটে- নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করা হয়; আর সেসব নবআবিষ্কৃত বিষয়ের ইলম তো তাদেরই থাকবে, যারা এগুলো আবিষ্কার করেছে। যারা এসব গলত কথা আবিষ্কার করছে তারাই তো এগুলো জানবে; অন্যরা এ ব্যাপারে বেখবর থাকবে- এটাই তো স্বাভাবিক। যখন ফেতনার প্রচার শুরু হবে তখন তারা জানতে পারবেন- আচ্ছা এই ফেতনা হচ্ছে।
অতএব ওই ইবারতটা যেহেনে রাখতে হবে-
أين الناس عنه؟
এটা সালাফের কওল। ‘ওয়ান নাসু আনহু গাফিলূন’- এত পুরনো ইবারত নয়। বরং এই ইবারতটা পুরনো। যে কোনো নবআবিষ্কৃত চিন্তা, সালাফের চিন্তার সঙ্গে যার মিল নেই- এরকম চিন্তা বা কথা কেউ আবিষ্কার করলে তার উপর প্রথম প্রশ্ন সালাফ করতেন-
أين الناس عنه؟
অতএব এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। বর্তমানে যারা কওমী মাদরাসাগুলোতে বিভিন্ন গলত দাওয়াত প্রচার করে তারা এই প্রশ্ন করার আগেই জবাব দিয়ে দেয় যে, আমাদের আকাবির বিশেষ একটা পরিবেশে বড় হয়েছেন; তাদের এসব দিকে যেহেন যাওয়া জরুরি নয়। প্রশ্ন হল, আপনার আকাবির যে পরিবেশের আপনি তো সেই পরিবেশেরই। আপনার যেহেন ওই দিকে কীভাবে গেল? আপনার যেহেন যদি যেতে পারে তাহলে আকাবিরের যেহেনও যাবে। কিন্তু যায়নি কেন?
অতএব প্রথম ও সাধারণ একটা প্রশ্ন-
أين الناس عنه؟
কিন্তু এই প্রশ্ন তালিবে ইলমরা করে না। আরে, তুমি নতুন দাওয়াত গ্রহণ করছ এই প্রশ্ন না করেই?
নতুন দাওয়াত দুই প্রকার। একটা হল পুরনো জিনিসের নতুন দাওয়াত। আরেকটা হল দাওয়াতটাও নতুন, জিনিসটাও নতুন। দাওয়াতটাও নতুন জিনিসটাও নতুন- এটা দ্বীন নাকি?
ফাহমে সালীম ওই ফাহম, যেটা শুযূয মুক্ত। যে ফাহমের মধ্যে এমন কোনো জিনিস মাখলুত হয়নি, যেটা শরীয়তের মেযাজ ও উম্মতের তাওয়ারুসের বিপরীত। যে ফাহম এমন জিনিস গ্রহণ করে না, তাকে বলে ফাহমে সালীম।
তালিবে ইলমের একটি আহাম সিফাত যেমন হিফয তেমনি আহাম একটি সিফাত হল ফাহম। ফাহমটা সাফ হওয়া এবং সালীম হওয়া। হিফয আর ফাহম এই দুইটার সমন্বয়ে তালিবে ইলম ধীরে ধীরে তারাক্কি করবে। এই দুই সিফাত আস্তে আস্তে তৈরি হয়। এই দুই সিফাত যত বাড়বে তালিবে ইলমের তত তারাক্কি হবে।
তালিবে ইলমের আরেকটি সিফাত ফিকরে আরজমান্দ। দারুল উলূম দেওবন্দের আকাবিরের মধ্যে অনেক সিফাত আছে। এর মধ্যে দুইটি সিফাত বেশি মশহুর। ফিকরে আরজমান্দ ও দিলে দরদমান্দ। ফিকরে আরজমান্দ মানে আ‘লা ফিকির। উৎকৃষ্ট ও সমুন্নত চিন্তা। স্থূল চিন্তা বা তুচ্ছ চিন্তা- এটা তালিবে ইলমের ভাবনা নয়। তালিবে ইলম ভাববে ভালোটা। যেখানে যেটা ভালো এবং যেখানে যেটা সুন্দর তালিবে ইলম সেটাই ভাববে। কোনো জিনিসের মূল্যায়ন বা তলবের ক্ষেত্রে ভাববে ভালোটা। যেটা ভালো, যেটা সুন্দর সেটা। তার ফিকির হবে ফিকরে আরজমান্দ, আ‘লা ফিকর। সাতহী ফিকির নয়। তালিবে ইলমের ফিকির সাতহী হবে না। স্থূল হবে না। কথাগুলো একেবারে পরিচিত তালিবে ইলমদের কাছে; ইবারত হয়ত ভিন্ন হতে পারে। এখানকার মুরব্বীগণ কোন্ কথা কোন্ ইবারতে বলেন জানি না। সেজন্য কোনো এক ইবারতে বলছি। তবে কথাগুলো তালিবে ইলমদের কাছে পরিচিত।
মেছাল আসলে কথা সাফ হয়। তাই ছোট্ট একটা মেছাল দেই। আমরা অনেকসময় বাসে যাতায়াত করি। কখনো বাসে ভিড় থাকে। বাসে ভিড় দেখলে বিরক্ত লাগে কি না? বিরক্ত লাগে। অর্থাৎ অতিরিক্ত মানুষ দেখলে বিরক্ত লাগে। এত মানুষ কোত্থেকে এল? প্রশ্ন হল, অতিরিক্ত মানুষটা কে? অন্যরা, নাকি আমি? নিজের ব্যাপারে কিন্তু যেহেনে আসে না যে, আমি অতিরিক্ত। আমি না থাকলে অন্যরা আরো স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারত। নিজের ব্যাপারে এই ভাবনাটাই হল আ‘লা ফিকির। পক্ষান্তরে আমিই মূল; আমি ছাড়া এত মানুষ উঠল কেন- এটা হল স্থূল চিন্তা।
একটা ঘটনা। একজন হুজুর সিএনজিতে যাচ্ছেন। সিএনজিতে সাধারণত পেছনে তিনজন বসে আর সামনে দুইজন। সব জায়গায় তো সামনে বসার ফযীলত নেই। সিএনজিতে পেছনের ফযীলত বেশি। এতে রাহাত ও ইকরাম বেশি হয়। পেছনে জায়গা না থাকলেই সামনে বসা হয়। কখনো এরূপ পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে, পেছনের লোক সামনে যেতে হয়। তো এমন একটা হালত তৈরি হল যে, পেছনের একজনকে সরতে হবে। কথার কথা, একজন মুরব্বী আসলেন, যার সামনে বসা কঠিন। তাহলে এখন একজনকে তো সামনে যেতে হবে। কিন্তু কে যাবে? এখানে তো সামনে বসার ফযীলত নেই; তাই কেউ সামনে যেতে চায় না। তবু একজন গিয়েছেন। যিনি গিয়েছেন তিনি সমঝদারির কাজ করেছেন তাই না? তিনি হলেন সেই হুজুর। তবে তার যেহেনে আসল, আমাকে যদি এরা চিনত তাহলে আমাকে আর সামনে পাঠাত না। তারা তো আর পাঠায়নি; উদ্দেশ্য হল, আমার যাওয়ার প্রয়োজন হত না; বরং তারাই সামনে চলে যেত আর আমাকে ইকরামের সঙ্গে পেছনে বসাত। এই চিন্তাটা স্থূল। সঠিক চিন্তা হল, আমাকে চেনে না- এ কারণেই তো আমি সিএনজিতে জায়গা পেয়েছি। বাস্তবেই যদি এরা আমাকে চিনত যে আমি কী, আমার ভেতরটা কী, তাহলে এতক্ষণ আমার সিএনজিতে বসে থাকারও সুযোগ হত না। এটা হল আ‘লা চিন্তা। এটা যদি প্রথমে না এসে পরে আসে, তাহলেও আলহামদু লিল্লাহ। এরকম শত জিনিস আছে আমাদের চব্বিশ ঘণ্টার যিন্দেগীতে। একেক সময় একেক পরিস্থিতি আসে; সেগুলোকে আমরা দুইভাবে চিন্তা করতে পারি। একটা হবে স্থূল, আরেকটা হবে গভীর। তবে সব বিষয়েই তালিবে ইলমের ফিকিরটা হতে হবে আ‘লা। সাতহী ফিকির হলে চলবে না।
এই যে মানুষ ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে- এটাকে আপনি দুইভাবে চিন্তা করতে পারেন। এক ভবিষ্যত তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আরেক ভবিষ্যত হল মৃত্যুর পর থেকে। ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা ভালো; কোনো আপত্তি নেই। এমনকি মওতের আগ পর্যন্ত যে ভবিষ্যত সেটা নিয়েও যদি তরীকামত ভাবে তাতেও আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু আমি মওতের পরের যে ভবিষ্যত এবং আসল যে ভবিষ্যত সেটা নিয়ে ভাবলাম না। কুরআন মাজীদে আছে-
وَ لْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ.
প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক, আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। -সূরা হাশর (৫৯) : ১৮
আগামী দিনের জন্য ভাবছ, কিন্তু আসল আগামী দিনের জন্য কি ভাবছ? আসল ভবিষ্যতের জন্য ভাবা- এটা আ‘লা চিন্তা। আর ফিকিরটাকে চোখের সামনের ভবিষ্যতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলাটা হল স্থূল চিন্তা। মোটকথা তালিবে ইলমের ফিকিরটা হতে হবে আ‘লা ফিকির।
আমি যা বলতে চেয়েছি, আশা করি সেটা পরিষ্কার হয়েছে। এটা কি নতুন কথা? পুরনো কথা। তালিবে ইলমের ফিকিরটা আ‘লা হতে হবে। সবকিছুর মধ্যেই এই খেয়ালটা রাখতে হবে। স্থূল কোনো চিন্তা যেন আমার দিল-দেমাগে জায়গা না করতে পারে। আসা-যাওয়া করতে পারে। ওয়াসওয়াসা আসতে পারে। এতে সমস্যা নেই। মানুষ তো দুর্বল। কিন্তু স্থূল চিন্তা দিল-দেমাগে স্থির হয়ে যাবে এটা তালিবে ইলমের শান হতে পারে না। স্থূল চিন্তাকে দূর করতে হবে। তালিবে ইলমের চিন্তায় গভীরতা থাকতে হবে, উৎকর্ষের গুণ থাকতে হবে। এটা হল ফিকরে আরজমান্দ। ফিকরে আরজমান্দওয়ালা ব্যক্তিদের মধ্যে দিলের ব্যাধি থাকে না; আস্তে আস্তে সাফ হয়ে যায়।
অন্য কোনো তালিবে ইলমকে তারাক্কি করতে দেখলে আমার দিল সংকুচিত হবে, নাকি খোশ হবে? খোশ হবে। মুনাফাসাত ভালো জিনিস। কুরআনে আছে-
وَ فِیْ ذٰلِكَ فَلْیَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُوْنَ.
এ বিষয়ে প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক। -সূরা তাতফীফ (৮৩) : ২৬
কে কার আগে যাবে, এটার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সব তালিবে ইলমের মধ্যে এই প্রতিযোগিতামূলক মেহনত থাকা চাই। এটা খুব ভালো। কিন্তু প্রতিযোগিতা হলে কেউ আগে কেউ পরে তো হবেই। কখনো বরাবরও হতে পারে। কিন্তু আমি যদি পিছে পড়ি, তাহলে আমি কি আমার উপর নারাজ হব, না যে তালিবে ইলম এগিয়ে গেছে তার উপর নারাজ হব? আমার উপর নারাজ হব। সে আগে যাওয়ার কারণে আমার মনে কষ্ট লাগলে সেটা স্থূল চিন্তা। আর আ‘লা চিন্তা হল, হায়! আমি পিছে থেকে গেলাম। নিজেকে দোষ দেওয়া আর অন্যের ব্যাপারে খুশি হওয়া যে, মাশাআল্লাহ সে মেহনত করেছে, সে আগে গিয়েছে। মনে কষ্ট আসতে পারে -মানুষ তো- কিন্তু সেটাকে দূর করে ফেলতে হবে। আল্লাহর শোকর আদায় করা। বা-তাকাল্লুফ, মনে চাইছে না তবু বলেন, আলহামদু লিল্লাহ, খুশি হলাম আপনি আগে গিয়েছেন। মনে খুশি হননি তবু বলেন। তাহলে মনের এই দুর্বলতাটা দূর হয়ে যাবে। আর নিজেকে তিরস্কার করে বলবেন যে, আমি পেছনে পড়ে গেছি।
ফিকরে আরজমান্দ পুরো জিন্দেগীর বিষয়। জিন্দেগীর সকল শাখায় এটা কার্যকর। এটা আমাদের আকাবিরের শিআর। তালিবে ইলমের মাঝে এই সিফাত আস্তে আস্তে বাড়তে হবে।
এই হল ফিকরে আরজমান্দ। আর দিলে দরদমান্দ সম্পর্কে বলা আসলে আমার যবানে সাজে না। ওগুলোও সাজে না, তারপরও একটা...। কিন্তু দিলে দরদমান্দ সম্পর্কে বাহার হাল এখানকার দিলওয়ালা হুজুর যারা আছেন, তাঁরাই বলবেন, বলে থাকেন এবং আরো বলবেন। এটা তালিবে ইলমের আরেকটা সিফাত।
কয়টা সিফাাত বললাম? হিফয, ফাহম, ফিকরে আরজমান্দ এবং দিলে দরদমান্দ। তালিবে ইলমকে এসব সিফাত হাসিল করতে হবে।
যাইনুদ্দীন ইরাকী রাহ. (৭২৫ হি.-৮০৬ হি.) সম্পর্কে তাঁর উসতায জামালুদ্দীন ইসনাবী (الإسنوي) রাহ. (৭০৪ হি.-৭৭২ হি.) বলেছেন-
إن ذهنه صحيح، لا يقبل الخطأ.
অর্থাৎ তার যেহেন সাফ-সালীম। সে গলত কথা গিলতে পারে না। সুতরাং একজন গলত কথা বলবে আর তালিবে ইলম সেটা গিলে ফেলবে, একটু তাওয়াক্কুফও হবে না- এটা কেমন কথা। একটা গলত কথা, গলত চিন্তা, গলত দাওয়াত আসলে তালিবে ইলমের মধ্যে এই ভাবটা আসতে হবে যে, এটা কেমন কথা হল? আচ্ছা আমি হুজুরদেরকে জিজ্ঞেস করব। হুজুরদের সামনে পেশ করব। অথচ অনেকের এই অনুভূতিটাই নেই; বরং হুজুরদের থেকে দূরে রাখবে। বলবে, হুজুররা এসব বুঝবেন না। তারা পুরনো মানুষ। বেখবর মানুষ। তারা এসব বুঝবেন না। যারা একথা বলে, ওদেরকেই কিছুদিন পর তাদের ছাত্ররা একথা বলবে। তারা পুরনো হওয়ার কারণে বেখবর হয়ে গেছেন, বুঝবেন না; তুমিও তো একদিন পুরনো হবে। তুমি কয়দিন আর জোয়ান থাকবে। কয়েকদিন পর তোমারও তো বয়স হবে। তখন তোমার শাগরিদরাও এই কথা বলবে। এগুলো হল আমারাতুল ফিতান। গলত দাওয়াতের আলামত। খাসিয়াত বলিনি। কোনো সহীহ কথাও কখনো কেউ এই শিরোনামে পেশ করে। করা উচিত নয়। কিন্তু এটা যে গলত দাওয়াতের একটা আলামত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আকাবিরের ব্যাপারে বদগুমানি পয়দা করা ও বদ যবানি করা এটা ফেতনার আলামত। ওই দাওয়াতকে যদি তুমি শরীয়তের আদিল্লা ও কাওয়ায়েদে শরীয়তের আলোকে বিশ্লেষণ কর, দেখবে ওটা গলত। সহীহ দাওয়াতওয়ালা সাধারণত এরকম শিরোনাম গ্রহণ করে না। কখনো জযবা এসে গেলে কেউ করে, কিন্তু সেটা মুকতাদা হয় না। গলত দাওয়াতই সাধারণত এই পোষাকে আসে।
চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের কট্টর সালাফী ও সাহাবা বিদ্বেষীদের কিছু নযরিয়া, সাধারণ সালাফীরা যেটাকে গ্রহণ করে না, সেগুলোকে কওমী মাদরাসায় ঢুকাচ্ছে কিছু লোক; তাহকীকের নামে, ইলমের নামে। এগুলো এদের আবিষ্কার নয়। নেটে ঢুকে মাওয়াদ-তোহফা এনে সেগুলো বিতরণ করে।
ليس من كدِّه ولا من كدِّ أبيه.
এগুলো তাদের মেহনত নয়। এগুলো আল্লাহর রহমতে আমরা অনেক আগে দেখেছি এবং দেখে রেখে দিয়েছি। এগুলো প্রচারযোগ্য নয়। এই আফকার ইশাআতযোগ্য নয়। সেই আফকার এখন তারা মুজাদ্দিদ সেজে, মুজতাহিদ সেজে প্রচার করছে। তালিবে ইলমের ফাহম যদি সালীম হয় তাহলে সে এই দাওয়াত কবুল করতে পারে না।
যাইহোক, তালিবে ইলমের অনেক সিফাত। আজকে এই চারটাই থাকল। ফাহম, হিফয, ফিকরে আরজমান্দ এবং দিলে দরদমান্দ। আল্লাহ তাআলা এই চারটা সিফাত এবং তালিবে ইলমের অন্যান্য সিফাত আমাদেরকে নসীব করুন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[গত ২৮-০৫-১৪৪৩ হি. মোতাবেক ০৪-১২-২০২১ ঈ. বাদ ফজর জামিয়া মাদানিয়া ফেনীর তালিবে ইলমদের উদ্দেশে প্রদত্ত বয়ান]
-লেখাটি মাসিক আলকাউসার থেকে নেওয়া
এনএ/