আব্দুল কাইয়ুম, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় বেড়িবাঁধের উপর পাকা সড়ক নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইআরডি)। এতে সংরক্ষিত বন এবং বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি টাকার বাণিজ্য করছে বালুখেকো একটি প্রভাবশালী মহল। ড্রেজার মেশিন দিয়ে বনের ভেতর এবং বেড়িবাঁধ সংলগ্ন থেকে এলাকা বালু উত্তোলনে বড় বড় দিঘী তৈরি হয়েছে। এতে একদিকে উজাড় করা হচ্ছে বনভূমি, অপরদিকে ঝড়-বন্যা, জলোচ্ছ্বাসকালীন ঝুঁকিপূর্ণ ফাঁদ তৈরি হয়েছে। এসব বিষয় স্থানীয়রা সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোন সুফল পায়নি। উল্টো সাব ঠিকাদার মামলা হামলার ভয় দেখাচ্ছেন।
জানা গেছে, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত লাগোয়া উপকূলীয় বেড়িবাঁধের উপর পাকা সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। পর্যটক দর্শনার্থীদের চলাচলের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখেই দ্রুত পরিসরে এ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ওয়েডিং অ্যান্ড এস্টেনথিং প্রজেক্টের আওতায় কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের দুই দিকে ৪৮ নং পোল্ডারের বেড়িবাঁধের উপর ১৬ ফুট প্রশস্ত মোট ১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় ‘মোঃ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
প্রথম পর্যায়ে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের চৌরাস্তা থেকে শুরু করে গঙ্গামতি (৩৩ কানি) পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে বালু ভরাটের কাজ শুরু করা হয়। এ বালু ভরাট কাজের দায়িত্ব দেয়া হয় কবির হোসেন নামে স্থানীয় এক বালু ব্যবসায়ীকে। সড়ক নির্মাণ ও প্রশস্তকরণ কাজে লোকাল বালু কিনে ট্রাকে করে নিয়ে সড়কে ব্যবহারের কথা থাকলেও করা হচ্ছে- তার উল্টোটা।
বিধি বহির্ভূতভাবে কুয়াকাটা সংরক্ষিত বন উজাড় করে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে সেই বালু ব্যবহার করা হচ্ছে সড়কে। এতে বনের সরল জমিসহ শত শত গাছ কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বনের মধ্যে বড় বড় দিঘীর সৃষ্টি হয়েছে। বন কর্মকর্তারা এতে বাধা দিলে শুনছে না তাদের কথা। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ভূমি প্রশাসন থেকে শুরু করে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও কোন সুরাহা হয়নি। বন বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয়রা বন ধ্বংসের প্রতিবাদ করলে তাদের হামলা-মামলাসহ জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা জানায়, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সংরক্ষিত বন সমুদ্র উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করছে। বন না থাকলে বেড়িবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের করাল গ্রাসে চলে যেত গ্রামের পর গ্রাম। সেই বনভূমি ধ্বংস করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছে।
পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা জানান, বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণ কাজের জন্য একটি প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী চক্র গঙ্গামতি ও মম্বিপাড়া এলাকা থেকে সরল জমি ও বন কেটে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। এতে বাধা দিলে তারা তা শুনছে না। বালুখেকো প্রভাবশালীদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে আইনি সহযোগিতা চাইলেও তারা পাচ্ছেন না। এই বন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উপজেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউল ইসলাম বলেন, তিনি শুনে এসিল্যান্ডকে পাঠিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া দিয়েছেন।
তবে উপজেলা প্রশাসনের বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল ফকির অভিযোগ করে বলেন, আমি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসক, ভূমি কর্মকর্তাসহ বন বিভাগকে একাধিকবার জানানোর পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকারি অর্থ দিয়ে কাজ হচ্ছে যেখানে, সেখানে যদি সরকারি জমি থেকেই বালু উত্তোলন করা হয়- তাহলে এটা সাগর চুরি। আমার দাবি, যাতে এই ঠিকাদারকে কোনো প্রকার টাকা না দেয়া হয় এবং যেসব জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করা হয়েছে, সেসব ভরাট করে দেওয়া হোক। নতুবা অচিরেই এই বেড়িবাঁধ আর রক্ষা হবে না।
স্থানীয় বাবুল মুন্সী আক্ষেপ করে বলেন, প্রশাসন যদি সঠিকভাবে কাজ করতো কখনোই বনের এবং বেড়িবাঁধের পাশ থেকে বালু উত্তোলন সম্ভব হতো না। তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় বেড়িবাঁধ মূলত ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। বেড়িবাঁধের পাশ থেকে বালু উত্তোলন করে আমাদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিল। বেড়িবাঁধের পাশে যে দিঘীগুলো তৈরি করা হয়েছে তা একসময় ভরাট হবে ওই একই বালু মাটি দিয়েই। তাহলে উপকার হলো কি?
তবে বালু উত্তোলন চলাকালে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মচারীদের মাঠ পর্যায়ে তদারকি করতে দেখা গেলেও এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।
তিনি জানান, ঠিকাদার কোথায় থেকে বালু আনলো তা মনিটরিং করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা দেখি, লেয়ার বাই লেয়ার কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। সরকারি নিয়মের বাইরে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই। যদিও উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ একটি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। সেখান থেকে বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব- কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা।
অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে কি পদক্ষেপ নেবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা জানান, আমি এ বিষয়ে জেলা এক্সিয়েন মহোদয়কে জানাবো। এ নিয়ে আমার কার্য সহকারী জেনারেল অফিসার সুপারভিশন কন্ট্রিবিউটকে পাঠাবো। তারা যেন বিষয়টি খতিয়ে দেখেন।