|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
আল-কুরআন মানবজাতির জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার এক পরিপূর্ণ হিদায়াত, যা আমাদের জীবন পরিচালনার সর্বোত্তম পথনির্দেশনা প্রদান করে। কুরআনের প্রতিটি আয়াতের মাঝে রয়েছে অগাধ জ্ঞান, হিকমত এবং অনন্ত জীবনের সফলতার দিকনির্দেশনা। আজ ২৬ তম তারাবির তেলাওয়াতে আমরা শুনবো ২৯ তম পারা।
২৯ নম্বর পারায় আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের ভয়াবহতা, মানুষের সৃষ্টি, তাকওয়াপূর্ণ জীবনের প্রতিদান, পাপের শাস্তি এবং ন্যায়বিচারের দৃশ্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এখানে মুমিনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ ও কাফেরদের জন্য কঠিন শাস্তির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই পারার সূরাগুলোর মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর প্রকৃত সাফল্য হলো আখিরাতের মুক্তি। আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করলেই আমরা চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারব।
১. সূরা মুলক:
এই সূরায় আল্লাহ তায়ালার মহাসমর্থন ও তাঁর সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
- আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
- তিনি সমস্ত সৃষ্টির মালিক, জীবন-মৃত্যুর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক।
- জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
- বুদ্ধিমান মানুষের জন্য আসমান-জমিনের নিদর্শনগুলোর মধ্যে উপদেশ রয়েছে।
- যারা আল্লাহর অবাধ্য, তারা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে, আর যারা সত্য গ্রহণ করবে, তারা জান্নাতের নেয়ামত লাভ করবে।
২. সূরা কলম
এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে সমবেদনা জানিয়ে বলেন যে, কাফেররা তাঁকে মিথ্যাবাদী বললেও তিনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।
- সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এবং আল্লাহর শাস্তির বাস্তবতা স্পষ্ট করা হয়েছে।
- রাসূল (সা.)-এর চরিত্রের প্রশংসা এবং তাঁর বিরুদ্ধে মুশরিকদের অপবাদ খণ্ডন।
- অহংকারী, মিথ্যাবাদী ও পাপীদের ধ্বংস অনিবার্য।
- দুনিয়ার ধন-সম্পদ পরীক্ষার উপকরণ মাত্র; যারা ভুল পথে চলে, তারা অনুতপ্ত হবে।
- আল্লাহর নবীদের উপহাস করা হলে, তার ফলাফল কঠিন হয়।
৩. সূরা হাক্কাহ
এই সূরায় কিয়ামতের ভয়াবহ চিত্র এবং পূর্ববর্তী কিছু জাতির ধ্বংসের কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।
- কিয়ামতের দিন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।
- কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং পূর্ববর্তী জাতিদের ধ্বংসের কারণ।
- মানুষের কর্ম অনুযায়ী হিসাব-নিকাশ ও জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ।
- যারা ঈমান এনেছে, তাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে এবং তারা সফল হবে।
- যারা অস্বীকার করেছে, তাদের আমলনামা বাঁ হাতে দেওয়া হবে এবং তারা শাস্তি ভোগ করবে।
৪. সূরা মাআরিজ
এতে কিয়ামতের ভয়াবহতা, মানুষের অবস্থা এবং ধৈর্যশীলদের সফলতা বর্ণনা করা হয়েছে।
- কিয়ামতের দিন ৫০,০০০ বছরের সমান দীর্ঘ হবে।
- কাফেরদের জন্য কঠিন শাস্তি, আর মুমিনদের জন্য জান্নাত নির্ধারিত।
- ধৈর্যশীল ও নামাযি ব্যক্তিরাই প্রকৃত সফল।
- মানুষের প্রকৃত স্বভাব, আল্লাহর রহমতের প্রতি নির্ভরতা এবং নামাজ ও ধৈর্যের গুরুত্ব।
৫. সূরা নূহ
এই সূরায় হযরত নূহ (আ.)-এর দাওয়াত এবং তাঁর জাতির প্রতিক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে।
- হজরত নূহ (আ.)-এর দাওয়াত, তাঁর জাতির অবাধ্যতা এবং তার পরিণতি।
- ইস্তেগফার ও তওবার মাধ্যমে রহমতের দুয়ার খুলে যাওয়ার বর্ণনা।
- ৯৫০ বছর দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর জাতি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
- আল্লাহ তায়ালা তাদের ধ্বংস করে দেন এবং মুমিনদের নৌকায় রক্ষা করেন।
- সত্য প্রত্যাখ্যান করলে শাস্তি অনিবার্য।
৬. সূরা জিন
এতে জিনদের ঈমান আনার ঘটনা এবং তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।
- জিনেরাও কুরআন শুনে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।
- রাসূল (সা.)-এর নবুওতের সত্যতা এবং জিনদের আচার-আচরণ।
- তারা বলে, দুনিয়ায় কারো পক্ষে আল্লাহর বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব নয়।
- নবী ﷺ-কে আল্লাহর পথ প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
৭. সূরা মুজাম্মিল
এই সূরায় রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে তাহাজ্জুদ নামাযের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
- কুরআন তেলাওয়াত ও ধৈর্যের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
- নবী (সা.)-কে তাহাজ্জুদের নির্দেশ এবং ধৈর্যধারণের উপদেশ।
- কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব এবং দাওয়াতি মিশনের চ্যালেঞ্জ।
- দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী; আখিরাতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
৮. সূরা মুদ্দাসসির
এতে নবুওয়াতের দায়িত্ব, কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং কাফেরদের শাস্তির বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
- নবী (সা.)-কে দাওয়াতের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ।
- কিয়ামতের ভয়াবহতা, জাহান্নামের শাস্তি ও সৎকর্মের গুরুত্ব।
- কিয়ামতের দিন কাফেরদের কঠিন পরিণতি হবে।
৯. সূরা কিয়ামাহ:
এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিবসের ভয়াবহতা ও তার অবশ্যম্ভাবিতার কথা বলেছেন।
- কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং তার অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে।
- মানুষের কর্মফল অনুযায়ী পুনরুত্থান এবং হিসাব-নিকাশের বিবরণ পেশ করা হয়েছে।
- পাপীদের কঠিন শাস্তি ও মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতের সুখবর রয়েছে।
- মানুষের আত্মপ্রবঞ্চনা ও কিয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসের নিন্দা জানানো হয়েছে।
- কাফেররা কিয়ামতকে অবিশ্বাস করত, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা শপথ করে বলেছেন যে, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে।
- এখানে মানুষের পুনরুত্থান, হাশরের ময়দানে বিচারের দৃশ্য এবং মুমিন ও কাফেরদের ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- মানুষের আত্মপ্রবঞ্চনার কথা তুলে ধরা হয়েছে, যারা মনে করত যে তারা অনন্তকাল পৃথিবীতে থাকবে।
- কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে নিয়েছেন এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে তাড়াহুড়ো না করার নির্দেশ দিয়েছেন।
- কিয়ামতের দিন মানুষ দুনিয়ার জীবনের জন্য অনুতপ্ত হবে, কিন্তু তখন আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
- পাপীরা কবর থেকে বের হয়ে বলবে—“এই ভয়াবহ দিন থেকে মুক্তির কোনো উপায় কি নেই?”
- যারা ঈমান এনেছিল, তারা আল্লাহর রহমত লাভ করবে, আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে।
১০. সূরা দাহর (আল-ইনসান):
এই সূরায় মানুষের সৃষ্টি, দায়িত্ব এবং জান্নাত ও জাহান্নামের পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
- মানুষের সৃষ্টি, তার জীবনের উদ্দেশ্য এবং তার সামনে থাকা দুটি পথ—সৎকর্ম ও অসৎকর্ম।
- আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীলদের জন্য জান্নাতের নেয়ামত ও সম্মান।
- সত্যিকারের মুমিনের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ পুরস্কার।
- নামাজ, দান-সদকা এবং ধৈর্যের গুণাবলী।
- আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষকে পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে দেখা যায়, কে সৎকর্ম করে এবং কে পথভ্রষ্ট হয়।
- মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতের অপূর্ব নেয়ামতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে—তাদের জন্য থাকবে জান্নাতের ফল, দুধ, মধু, সুগন্ধি পানীয় এবং প্রশান্তির পরিবেশ।
- মুমিনদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে—তারা দরিদ্র, ইয়াতিম ও বন্দিদেরকে খাদ্য দান করে এবং কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে।
- কাফেরদের কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যারা দুনিয়াতে সত্যকে অস্বীকার করেছিল।
- মানুষের উচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
সূরা মুরসালাতের সারমর্ম:
এই সূরায় কিয়ামতের ভয়াবহতা ও শাস্তির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বারবার বলা হয়েছে—"وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِلْمُكَذِّبِينَ" অর্থাৎ, “সেই দিন মিথ্যারোপকারীদের জন্য ধ্বংস!”
- কসমের মাধ্যমে শুরু করে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী এবং এটি অবশ্যই সংঘটিত হবে।
- পূর্ববর্তী উম্মতদের অবাধ্যতার পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে।
- সত্য-মিথ্যার স্পষ্ট পার্থক্য এবং মুমিনদের জন্য জান্নাতের সুখবর।
- পাপীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে।
- দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ কৃতজ্ঞ হয় এবং সঠিক পথ অবলম্বন করে।
- আল্লাহ তায়ালা প্রবল বাতাস ও ঝড়ের শপথ করেছেন, যা দুনিয়ার শক্তির ক্ষুদ্রতা এবং আল্লাহর মহাশক্তির ইঙ্গিত দেয়।
- কিয়ামতের দিনে যারা সত্যকে অস্বীকার করেছিল, তাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
- মুমিনদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে, যেখানে তারা শান্তি ও নিরাপত্তার জীবনযাপন করবে।
- পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে, যারা আল্লাহর নবীদের অস্বীকার করেছিল।
- শেষ অংশে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন মানুষের কোনো অজুহাত গ্রহণ করা হবে না, সেদিন আল্লাহর চূড়ান্ত বিচার হবে।
উপসংহার
২৯ নম্বর পারার মূল বার্তা হলো—আল্লাহর পথে অবিচল থাকা, নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দুনিয়ার জীবনের পরিবর্তে আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হওয়া। নবীদের দাওয়াতি জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত সত্যের ওপর অবিচল থাকা এবং আল্লাহর শাস্তি ও প্রতিদানকে সামনে রেখে জীবন গঠন করা। এই পারার আয়াতগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় যে, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিয়ামত একদিন আসবেই, এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কর্মের হিসাব দিতে হবে। তাই আমাদের উচিত নেক আমল করে জান্নাতের পথ প্রশস্ত করা এবং কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর হুকুম মেনে চলা।
এই পারার সূরাগুলো আমাদের সামনে কিয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্য, মানুষের কর্মফল অনুযায়ী পরিণতি, জান্নাতের নেয়ামত ও জাহান্নামের শাস্তি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এই পারার মাধ্যমে আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে যে কেউ পথভ্রষ্ট হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর দেওয়া হিদায়াত অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়।
আমাদের উচিত এই পারার শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করা এবং কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা থেকে মুক্তির জন্য আমল বৃদ্ধি করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
হাআমা/