মাহে রমাযানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ই'তিকাফ: করণীয় ও বর্জনীয়
প্রকাশ:
২১ মার্চ, ২০২৫, ০২:৩০ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| মুফতি নাজমুল ইসলাম || ই'তিকাফ। একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহসম্মত ইবাদত। এটি মানুষকে আল্লাহর সাথে একান্তে মিলিত হওয়া ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদতে মগ্ন হওয়ার শিক্ষা দেয়। আল্লাহর সাথে মহব্বতের সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ই'তিকাফ। ই'তিকাফ: শাব্দিক ও পারিভাষিক বিশ্লেষণ ই'তিকাফ শব্দটি আরবি, যা আরবি 'আকফ' থেকে উৎপন্ন। এর অর্থ হলো, নিজেকে কোনো স্থানে আবদ্ধ রাখা বা অবস্থান করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ই'তিকাফ বলা হয়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় বিশেষ ব্যক্তির মসজিদের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে সেখানে অবস্থান করা। আর যে ব্যক্তি এভাবে আবদ্ধ থেকে মসজিদে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে, তাকে বলা হয় মু‘তাকিফ বা আকিফ। ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য: আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে- ই'তিকাফের মূল উদ্দেশ্য। নিজের গোনাহ মাফ করে নেওয়ার অন্যতম বড় মাধ্যম হল এই ই‘তিকাফ। হযরত মাসরূক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, প্রত্যেকের জন্য করণীয় হলো, সে এমন কোনো স্থানকে নির্বাচন করবে, যেখানে সে নিজের গোনাহ স্মরণ করে তা হতে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারবে। এক্ষেত্রে ই‘তিকাফ হচ্ছে একটি উত্তম মাধ্যম। ই'তিকাফের মাধ্যমে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ অন্বেষণ করার সুযোগও পাওয়া যায়। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদর অন্বেষণের উদ্দেশ্য তাঁর কাছে স্পষ্ট হবার পূর্বে রামাযানের মধ্যেই দশ দিন ই‘তিকাফ করলেন। দশ দিন অতিবাহিত হবার পর তিনি তাঁবু তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন যে, তা শেষ দশ দিনের মধ্যে আছে। তাই তিনি পুনরায় তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিলেন। তাবু টানানো হলো। এরপর তিনি লোকদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে লোক সকল! আমাকে ক্বদরের রাত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং আমি তোমাদের তা জানানোর জন্য বের হয়েছিলাম। কিন্তু দু’ব্যক্তি পরস্পর ঝগড়া করতে করতে উপস্থিত হলো এবং তাদের সাথে ছিল শয়তান। তাই আমি তা ভুলে গেছি। অতএব তোমরা তা রামাযান মাসের শেষ দশ দিনে অন্বেষন করো। (বুখারী: ২০১৮) ই'তিকাফ: গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফযিলত মাহে রমাযানে যে সকল আমল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তন্মধ্যে ই'তিকাফ হচ্ছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ই'তিকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলকে নির্দেশ দিলাম যে, আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও ই'তিকাফকারীদের জন্য পবিত্র করো।' (সূরা বাকারা: ১২৫) ইখলাসের সাথে ইবাদত বন্দেগী করার সাথে সাথে একমাত্র আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য ইতিকাফ এক চমৎকার প্রশিক্ষণ। সুন্নাহসম্মত পন্থায় দুনিয়া বিরাগী হওয়ার এবং লাইলাতুল কদর তালাশ করার ক্ষেত্রে ই'তিকাফ এর বিকল্প নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর রমজান মাসে ইতিকাফ করতেন। হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ই'তিকাফ করতেন আর তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণ ই'তিকাফ করেছেন। (বুখারি: ১৯৮১) অন্য এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ কর।' (বুখারি: ১০৭২) রমযানের শেষ দশক শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারারাত জেগে থাকতেন ও নিজ পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে জাগাতেন এবং তিনি নিজেও ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নিতেন। (মুসলিম) এদিকে ই'তিকাফকারীর ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মু'তাকিফ সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়। (ইবনে মাজাহ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক সমান দুরত্ব সৃষ্টি করবেন, যা আসমান জমিনের দুরত্ব অপেক্ষা বেশি। (তবারানী শরীফ) বায়হাকির বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে তার জন্য দুইটি হজ্জ ও দুইটি ওমরার সওয়াব লেখা হবে।' (বায়হাকী: ৩৬৮০) এছাড়া ই'তিকাফকারী যদি রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রগুলোতে ইবাদত করে তাহলে অবশ্যই সে লাইতুল কদরের ফযিলত পাবে, যা হাজার রাত্রি অপেক্ষা উত্তম। 'কদরের রাত্র হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।' (সূরা ক্বদর: ০৩) ই'তিকাফের প্রকারভেদ: ই'তিকাফ তিন প্রকার: ১. ওয়াজিব ইতিকাফ, যা ই'তিকাফকারী নিজের উপর ওয়াজিব করে নেয়। আর তা হলো মান্নতের ই'তিকাফ। একদা হযরত উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমি জাহেলী যুগে মসজিদুল হারামে এক রাত্রি ই'তিকাফ করার মান্নত করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তোমার মান্নত পূর্ণ করো। (বুখারি: ২০৩২) ২. সুন্নাত ইতিকাফ, যা রমাযানের শেষ দশকে পালন করতে হয়; এই ইতিকাফ সুন্নাতে মু'আক্কাদা আলাল কিফায়া। মহল্লাবাসীর কোনো একজন আদায় করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ আদায় না করে তাহলে মহল্লাবাসী প্রত্যেকেই গুনাহগার হবে। এই ই'তিকাফ ২১ রমজানের রাত থেকে আরম্ভ হয় আর ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলে শেষ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর এই ই'তিকাফ করতেন বলেই এটাকে সুন্নত ই'তিকাফ বলা হয়। ৩. নফল ইতিকাফ, উপরে বর্ণিত দুই প্রকারের ই'তিকাফ ব্যতিত বাকী সকল ধরণের ই'তিকাফ নফল ই'তিকাফ বলে গণ্য হবে। এই ই'তিকাফ যে কোনো সময় করা যায়। নির্দিষ্ট সময় বা রোজার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই যখনই কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন নফল ই'তিকাফের নিয়ত করা উচিত। যাতে ই'তিকাফের সওয়াবটা অর্জিত হয়ে যায়। ই'তিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত: ১. নিয়ত করা: ২. মুসলিম হওয়া: ৩. পবিত্র হওয়া: ৪. রোযাদার হওয়া: ৬. ই’তিকাফ মসজিদে হওয়া: আয়াতে আল্লাহ তাআলা ই’তিকাফের স্থান হিসেবে মসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই ই’তিকাফ হতে হবে মসজিদে। ই'তিকাফ ব্যাপকভাবে যে কোনো মসজিদে অবস্থান করেই করা যায়। তবে এতেও সন্দেহ নেই যে, ফযিলতের অধিকারী ৩টি মসজিদ; মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদুল আকসাতে ই'তিকাফ করা সবচেয়ে উত্তম। প্রসঙ্গত বলতে হয়, ইতিকাফ সহিহ হওয়ার জন্য মসজিদ হওয়া শর্ত। কাজেই পাঞ্জেগানা নামায আদায়ের স্থানটি যদি শরঈ মসজিদ হয় (অস্থায়ী নামাজ ঘর না হয়) তাহলে সেখানে সুন্নত ইতিকাফ করা যাবে। ই'তিকাফকারী শুধু জুমার নামায আদায়ের জন্য বের হয়ে নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে নামাজ শেষে দ্রুত ই'তিকাফের মসজিদে ফিরে আসবে। তবে খতমে তারাবি আদায়ের জন্য বের হওয়া জায়েজ হবে না। বরং তিনি যেই মসজিদে ইতিকাফ করছেন সেখানেই তারাবি আদায় করবেন। খতমে তারাবির ব্যবস্থা না হলে সুরা তারাবি আদায় করবেন। খতমে তারাবির জন্য বের হলে ই'তিকাফ ভেঙ্গে যাবে। মহিলাদের ইতিকাফের কিছু শর্ত: ক. স্বামী থাকলে ই'তিকাফের জন্য তাঁর অনুমতি নিতে হবে। ইতকাফ বাতিল হওয়ার কারণসমূহ: ১. শরয়ি ও মানবীয় ওযর ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া: ২. স্ত্রী সহবাস করা: ৩. পাগল হওয়া: ৪. হায়েয-নেফাস হওয়া: মহিলাদের হায়েয বা নেফাস শুরু হলে ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যায়। কারণ ইতেকাফে পবিত্রতা একটি শর্ত। ৫. শিরক-কুফর করা: কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে শিরক বা কুফর করলে বা মুরতাদ হয়ে গেলে ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, তুমি শিরক করলে তোমার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। (সূরা যুমার: ৬৫) ই‘তিকাফকারীর জন্য বৈধ কাজ: ১. তাঁবু টানানো: ২. শরয়ি প্রয়োজনে বের হওয়া: ৩. স্ত্রীর সাথে কথা বলা: ৪. পানাহার করা ও ঘুমানো: ই'তিকাফকারীর জন্য করণীয়: (যে সকল ইবাদত দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে পারবে, সেগুলোর একটা লিস্ট দেয়া হলো) যে সকল কাজ করা যাবে না: ১. ব্যবসার উদ্দেশ্যে মসজিদে ক্রয় বিক্রয় করা যাবে না। পারিশ্রমিক দিয়ে এতেকাফ করানো কোনো কোনো এলাকায় প্রচলন আছে যে, এলাকাবাসী কেউ ই'তিকাফ না করলে কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে খাবার ও পারিশ্রমিক দিয়ে ই'তিকাফ করানো হয়। এ কাজটি মোটেও ঠিক নয়। পারিশ্রমিকের মাধ্যমে ই'তিকাফ করালে ই'তিকাফ সহীহ হয় না। পরিশেষে বলা যায়, ই'তিকাফের মতো একটি ফযিলতপূর্ণ ও বরকতময় ইবাদত হোক কেবল আল্লাহ তাআলার জন্য, তারই সন্তুষ্টি অর্জনই হোক এটির মূল লক্ষ্য। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ই'তিকাফ করার মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমীন। এমএইচ/ |