|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
(সূরা সূরা বনি ইসরাইল ও সূরা কাহাফ)
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে কুরআন নাজিল করেছেন, যাতে তারা সৎপথে পরিচালিত হয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে পারে। ১২তম তারাবির অংশে আমরা পাবো, কীভাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের বারবার সতর্ক করেছেন, কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ জাতির পরিণতি কেমন হয়েছে, এবং কিভাবে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তনভাবে চলতে থাকবে।
এই অংশে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর মিরাজের ঘটনা, ইসরাইলিদের অতীত শিক্ষা, আখিরাতের ভয়াবহতা এবং আসহাবে কাহফের ঈমানের পরীক্ষা আলোচিত হয়েছে। পাশাপাশি, পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ীতা ও আল্লাহর হিকমত বোঝার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এসব আয়াত আমাদের জীবন পরিচালনার জন্য অমূল্য দিকনির্দেশনা দেয় এবং শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর পথে অবিচল থাকাই প্রকৃত সফলতা।
১. সূরা বনি ইসরাইল (১-১১১) – ইসরাইলি জাতির ইতিহাস ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা
মিরাজের ঘটনা (১)
- মিরাজের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-কে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে তিনি আসমানে আরোহণ করেন।
- আল্লাহ তাঁর রাসূল (সা.) মিরাজে নিয়ে গিয়ে বিশেষ নিদর্শন দেখেছিলেন।
- মিরাজের ঘটনা নবী (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এবং ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসগুলোর অন্যতম।
বনি ইসরাইলের অবাধ্যতা ও তাদের শাস্তি (২-২২)
- ইহুদিরা বারবার আল্লাহর অবাধ্যতা করায় তিনি তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন।
- সতর্ক করা হয়েছে, যদি তারা আবার দুষ্কর্ম করে, তবে শাস্তিও পুনরায় আসবে।
- নবী (ﷺ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও ইসলামের মহত্বের প্রমাণ।
- ইহুদিদের অতীত ইতিহাস ও আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের প্রতি তাদের অবাধ্যতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
- কুরআনকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামি নৈতিকতা ও আদর্শ জীবনযাপনের দিকনির্দেশ (২৩-৪০)
- পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।
- দরিদ্রদের সাহায্য করা এবং অপচয় না করা।
- মিথ্যা, প্রতারণা ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা।
- নামাজ কায়েম করা এবং ধৈর্যধারণ করা।
অহংকার ও শয়তানের পথ (৪১-৭০)
- ইবলিসের অহংকার ও তার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
- শয়তান সব সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে।
কিয়ামতের দৃশ্য ও শেষ বিচার (৭১-১০৪)
- কিয়ামতের দিন অপরাধীরা অন্ধ হয়ে পুনরুত্থিত হবে।
- যারা সত্যের বিরোধিতা করবে, তারা কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।
আখিরাতের দৃশ্য ও দোয়া (১০৪-১১১)
- কিয়ামতের ভয়াবহতা, নেককারদের পুরস্কার ও অপরাধীদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।
২. সূরা কাহফ (১-৭৪) – ঈমান ও পরীক্ষা
কুরআনের মহিমা ও মানুষের পরীক্ষা (১-৮)
- কুরআন সুস্পষ্ট ও সত্য।
- যারা ঈমান আনে, তারা জান্নাতে থাকবে, আর যারা কুফরি করে, তারা কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।
আসহাবে কাহফের ঘটনা (৯-৩১)
- কয়েকজন যুবক সত্যের পথে অবিচল থেকে আল্লাহর আশ্রয়ে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়।
- আল্লাহ তাদের দীর্ঘকাল নিদ্রায় রাখেন।
- বহু বছর পর আল্লাহ তাদের জাগিয়ে তুলে মানুষের সামনে নিদর্শন স্বরূপ উপস্থাপন করেন।
- এই ঘটনা ঈমানের দৃঢ়তার অনন্য দৃষ্টান্ত।
পার্থিব জীবনের বাস্তবতা (৩২-৫৯)
- দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে ধনী ব্যক্তি নিজের সম্পদ নিয়ে অহংকার করেছিল এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ভুলে গিয়েছিল। ফলে মুহূর্তেই তার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়।
- তার ধ্বংসই শিক্ষা দেয় যে দুনিয়ার সম্পদ ক্ষণস্থায়ী, আল্লাহই সবকিছুর প্রকৃত মালিক।
মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনা (৬০-৭৪)
- নবী মূসা (আ.) জ্ঞান অর্জনের জন্য খিজর (আ.)-এর সঙ্গে সফর করেন।
- সফরে যান, যেখানে তিনি ধৈর্যের পরীক্ষার সম্মুখিন হন।
- তিনি এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হন, যা বাহ্যিকভাবে অন্যায় মনে হলেও এর গভীরে ছিল আল্লাহর বিশেষ হিকমত।
- উক্ত ঘটনাকে মুসা (আ.) বোঝেননি, কিন্তু পরে জানতে পারেন যে, এতে গভীর হিকমত লুকিয়ে আছে।
মূল শিক্ষা ও বার্তা:
- মিরাজের ঘটনা আমাদের নবী (সা.)-এর মর্যাদা ও ইসলামের বিশেষ গুরুত্ব বোঝায়।
- ধৈর্য ও তাকওয়াধারীদের জন্য আল্লাহর রহমত অবশ্যম্ভাবী।
- শয়তানের প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে ঈমানের উপর অটল থাকতে হবে।
- ইহুদিদের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর বিধান মেনে চলতে হবে।
- আখিরাতে সফলতা পাওয়ার জন্য দুনিয়ার লোভে না পড়ে সত্যের পথে থাকতে হবে।
- আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে হবে এবং দুনিয়ার নিয়ে অহংকার করা যাবে না।
- আসহাবে কাহফের মতো ঈমানদারদের আল্লাহ রক্ষা করেন।
- নবী মূসা (আ.)-এর ঘটনা আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বদা মানুষের বোঝার ক্ষমতার বাইরে হতে পারে, তাই বিশ্বাস ও ধৈর্য ধরে রাখা জরুরি।
- ইসলামি নৈতিকতা মেনে চললে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করা সম্ভব।
উপসংহার:
উক্ত অংশে মিরাজের অলৌকিক ঘটনা, বনি ইসরাইলের ইতিহাস, শয়তানের ধোঁকা, ঈমানের পরীক্ষা ও আখিরাতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা উঠে এসেছে। পাশাপাশি আল্লাহর দয়া, ধৈর্য ধরার ফল, কৃতজ্ঞতা ও পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ীতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের আমাদের সবাইকে এসব শিক্ষাগুলো যথাযথভাবে বোঝার এবং জীবনে বাস্তবায়নের এবং সবাইকে উক্ত আলোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সত্যের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন—আমিন!
লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
হাআমা/