তারাবি নিয়ে ১০ হাফেজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা
প্রকাশ: ১১ মার্চ, ২০২৫, ১০:৫১ রাত
নিউজ ডেস্ক

|| নাঈমুর রহমান নাঈম ||

রমজান মাস আত্মশুদ্ধি, ইবাদত ও কুরআনের প্রতি গভীর মনোযোগী হওয়ার এক অনন্য সময়। এই মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো তারাবির নামাজ, যেখানে কুরআনের তেলাওয়াতের মাধ্যমে মুসল্লিরা আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের আশায় রাত কাটান। আর এই পবিত্র দায়িত্ব পালনের মূল কারিগর হলেন হাফেজে কুরআনগণ। যারা পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্যের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য এক অপূর্ব ইবাদতের পরিবেশ তৈরি করেন।

অনেক অভিজ্ঞ হাফেজ যাঁরা বছরের পর বছর তারাবি পড়ানোর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আবার কেউ নতুন হাফেয হিসেবে নতুন ভাবে তারাবির ইমামতিতে যোগ দিয়েছেন। এটি কেবল তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতার পরিচয় নয়, বরং পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহান খেদমত। এই মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা নানান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। কুরআন মুখস্থ রাখা, শুদ্ধ তেলাওয়াত করা এবং দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ইমামতি করা—এগুলো এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

মাহে রমজানে এ বরকতময় মাসে কয়েকজন হাফেজদের সাথে কথা বললে তারা তাদের কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা‌ আওয়ার  ইসলামকে জানিয়েছেন।

১.হাফেজ মাওলানা রায়হান হুসাইন,তিনি দীর্ঘ ১৩ বছর তারারির পড়াচ্ছেন। ইতিপূর্বে তিনি ১০ দিনে খতম তারারি পড়িয়েছেন ৩ বছর। ৬ দিনে খতম পড়িয়েছেন ১বছর , আর ৫ দিনে পড়িয়েছেন ২ বছর। আর বাকি বছরগুলোতে ২৭ দিনে খতম পড়িয়েছেন। এবছরও যশোর একটি জামে মসজিদে ২৭ দিনের খতম পড়াচ্ছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

তারাবির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাফেজ রায়হান হুসাইন জানান,বর্তমান মসজিদের তুলনায় হাফেজ অনেক বেশি হয়ে গেছে। যে কারণে নতুন হাফেজরা তাদের প্রতিভা বিকাশ করতে পারছে না। তাই নতুন হাফেজদের জন্য উচিত, তারা যেন মসজিদের আশাই বসে না থেকে ছোট ছোট জায়গায় করে নিয়ে নিজের তারারি চালু রাখে।

২.হাফেজ কারী ইমাম হুসাইন, তিনি  ৯ বছর যাবত তারারি পড়াচ্ছেন। এবছর যশোর ক্যান্টনমেন্টে তারারি পড়াচ্ছেন। হাফেজ কারী ইমাম হুসাইনের কাছে তারাবিতে সুন্দর ভাবে পড়ার বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারাবির জন্য ইয়াদ রাখার যে বিষয়টা প্রয়োজন তা হলো তেলাওয়াত করা। নিয়মিত তেলাওয়াত করলে তারারি পড়ানো সহজ হয় হাফেজগণের জন্য।

৩.হাফেজ মাওলানা যুবায়ের খান, তিনি প্রায় ৯ বছর যাবত তারারি পড়াচ্ছেন। এবছর তিনি বেনাপোল সীমান্তে এলাকায় তারারি পড়াচ্ছেন।তিনি বলেন,এই নয় বছরের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—কুরআন শুধু মুখস্ত রাখার বিষয় নয়, বরং তা হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। প্রতিটি শব্দ যেন আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত হয়, তবেই এর প্রকৃত সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব। আমার একটা কথা খুব মনে পড়ে,একবার এক বৃদ্ধ আমার তেলাওয়াত শুনে কেঁদে ফেললেন। নামাজ শেষে তিনি এগিয়ে এলেন, আমার হাত দুটো ধরে বললেন, বাবা, তোমার কণ্ঠে কুরআনের যে সুর, তা যেন আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আল্লাহ তোমাকে আরও বরকত দিক!'তার দোয়ার মাঝে আমি যেন এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম।

৪. হাফেজ মাওলানা মুফতি মাহমুদ হাসান, তিনি ১১ বছর যাবত তারারি পড়াচ্ছেন। এই দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা নানা স্মৃতি ও উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ। কখনো আনন্দের মুহূর্ত, আবার কখনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি তার দীর্ঘ তারারি পড়ানো অবস্থায় একটি অভিজ্ঞা জানানিয়েছেন, যে প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে বৃষ্টিতে ভিজে  মসজিদে গিয়ে  গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি তারারির নামাজ পড়িয়েছেন। এবং অনেক সময় তারাবি পড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে অন্ধকারে বা মোমবাতির আলোতে নামাজ আদায় করতে হয়েছে। তবে আল্লাহ তায়ালা রহমতে এখন অনেক স্বাচ্ছন্দে তারারি পড়াচ্ছেন বলে তিনি জানান।

৫.হাফেজ  মাওলানা হাসনাইন সারওয়ার,তিনি ১০বছর যাবত তারারি পড়াচ্ছেন। প্রতিবারের ন্যায় এবারো সোনারগাঁও ইসলামিক সেন্টার মাদরাসা মসজিদে তারারি পড়াচ্ছেন। তারারি পড়াতে পেরে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত। কুরআনের সুমধুর বাণী তেলাওয়াতে যে শান্তি ও তৃপ্তি  তিনি পান আর কোন কাজে তা পান না। তারারি কেন্দ্রীক  কুরআন তেলাওয়াতের যে  আবহ ও আমেজ সেটা সারা বছর সবার জীবনে প্রতিফলিত হোক এটাই তার চাওয়া।

৬.হাফেজ আবু নাঈম, তিনি প্রায় ১০ বছর যাবত তারারি পড়াচ্ছেন।  এ ১০ বছরে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে কালীগঞ্জ শিব নগর পশ্চিম পাড়া নিজ জামে মসজিদে তারারি পড়াচ্ছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, বিগত বছরের তুলনায় এবছর খুব স্বাচ্ছন্দে তারারি পড়াতে পারছি এবং মুসল্লিদেরও কোন সমস্যা হচ্ছে না ‘

৭.হাফেজ মুফতি মুহাম্মদ হুযাইফা,তার তারারি বয়সও দীর্ঘ দিন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তারারি পড়িয়েছেন। এবছর মিরপুর-৭ তারাবীহ পড়াচ্ছেন বলে তিনি জানান। এবছরের তারারি নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,এবারের তারারিতে তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। ইতিপূর্বে তারারি নামাজের সময় ক্যারেন্ট চলে যেত ,তাতে নামাজ পড়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো। তবে এবারের অবস্থা আগের তুলনায় অনেকটা ভালো। আশা করি সামনের দিনগুলোতে আরো ভালোভাবে তারারি পড়াতে পারবো। এবং মুসল্লিদেরও কষ্ট হবে না।’

৮.হাফেজ কারী মাওলানা আজিজুল হক,তিনি প্রায় একযুগের কাছাকাছি সময় ধরে তারাবি পড়াচ্ছেন। এবারও কিশোরগন্জ সদরের লতিফাবাদ ইউনিয়নের অষ্টবর্গ জামে মসজিদে তারারি পড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, তারারি পড়ানো কুরআন তেলাওয়াত এর মধ্যেই আনন্দ  খুঁজে পান। তাই তিনি সর্বদা কুরআনের খেলতে লেগে থাকতে চান যেন অন্যরাও তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়। এবং তিনি যেন আল্লামা আনোয়ার শাহ র. এর মতো মৃত্যু পর্যন্ত কুরআনের বাণী প্রচার করে যেতে চান।

৯. হাফেজ মুশফিকুস সালিহীন,তিনি  অনেক বছর যাবত তারারি পড়াচ্ছেন। এবছর চট্টগ্রামের শেরশাহ নগর সোসাইটি জামে মসজিদে খতমে তারাবি পড়াচ্ছেন। তিনি তারারি নিয়ে বলেন,খতমে তারাবির দায়িত্বের যে প্রেসার আছে, সেটা হুফফাজে কিরাম ছাড়া কেউ বুঝবে না।  সেটা খুবই কঠিন হলেও, আমি খুবই উপভোগ করি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার কাছে জীবনের শেষ রামাদান পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালনের তাওফিক চাই’

১০.হাফেজ মো: জুবায়েদ হাসান, তিনি লক্ষীপুরের সন্তান। এবছর তিনি গোরিন নগর জামে মসজিদে এবছর তারাবি পড়াচ্ছেন। কুরআন তেলাওয়াতে তার অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করছেন।

তাছাড়াও আরো অন্যান্য হাফেজগণ জানিয়েছেন, এবারের তারাবীতে অন্যান্য বারের তুলনায় বেশি ভালো লাগছে। হাফেজ মাওলানা মুফতি ইসমাইল হোসেন জানান তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর যাবত ধরে তারারি পড়াচ্ছেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তারারি পড়ান।

তার কাছে নবহাফেজদের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান হাফেজদের তুলনায় পূর্বের হাফেজদের ইয়াদ অনেক বেশি এবং মজবুত ছিলো। এখনকার সময়ে তেলাওয়াত অনেক সুন্দর হয় তবে পড়ানোর মান একদমই কম।

তিনি আরও বলেন, দ্রুত না পড়িয়ে সর্বদা ধীরে পড়ানোর চেষ্টা করা। যাতে করে কোরআনের পূর্ণ হক আদায় করে তারারি পড়া হয় এবং কোন আয়াত বাদ পরলে পরে সেটা পড়ে নেওয়া হয়।’

এনআরএন/