রমজান: ধৈর্য, সহমর্মিতা ও আত্মশুদ্ধির মাস
প্রকাশ:
০৩ মার্চ, ২০২৫, ১১:১৩ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| শায়খ ড. উসামা বিন আব্দুল্লাহ খাইয়াত || (২৯-০৮-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ২৮-০২-২০২৫ ঈসায়ি তারিখে বাইতুল্লাহ শরীফে প্রদত্ত জুমার খুতবা) রমজানুল মোবারকের সুন্দর ও মহিমান্বিত মুহূর্তগুলোর সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য মূলত এদেরকে যথাযথভাবে স্বাগত জানানোর মধ্যে নিহিত। পরিপূর্ণ আনন্দ ও অকুণ্ঠ সুখের সাথে গ্রহণ করাই এগুলোর মাহাত্ম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে মহিমান্বিত ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই পবিত্র রমজান মাস, যা আল্লাহ তাআলা এ উম্মতকে দান করেছেন। তিনি এই মাসের রোজা ও নামাজকে জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ বানিয়েছেন এবং তাতে নেক আমলের প্রতিযোগিতা করার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের সুযোগ প্রদান করেছেন। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের উচিত, এই মহান মাসের আগমনের গুরুত্ব অনুধাবন করে একে যথাযথভাবে গ্রহণ করা। তারা যেন আন্তরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে এ মাসের বরকত ও সুযোগগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগায়। এটি অর্জিত হতে পারে সত্যনিষ্ঠ পথ অনুসরণ করার মাধ্যমে, সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করার মনোভাব ধারণ করার মাধ্যমে ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অনুসরণ করার মাধ্যমে। বিশেষত আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণ করে—যিনি নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদতে পূর্ণতা লাভ করেছিলেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর সব কাজ একনিষ্ঠভাবে করতেন। রোজার উপকারিতা ও এর সুফল এত বেশি যে, তা গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো মানুষের জিহ্বাকে সংযত করা, মন্দ কথা ও অশ্লীল বাক্য থেকে বিরত রাখা। এই গুণই একজন পরিপূর্ণ ঈমানদারের পরিচায়ক।হযরত আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلاَ اللَّعَّانِ وَلاَ الْفَاحِشِ وَلاَ الْبَذِيءِ অর্থাৎ, 'মুমিন কখনো দোষারোপকারী ও নিন্দাকারী হতে পারে না, অভিস্পাতকারী হতে পারে না, অশ্লীল কাজ করে না এবং কটুভাষীও হয় না।' (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৯৭৭) এই শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মুমিনের উচিত এ ব্যাপারে যত্নবান হওয়া। কেননা মানুষের জিহ্বা থেকে উৎসারিত অশুভ বাক্য অনেক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে—এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে, বিপর্যয় সৃষ্টি হয় ও মানুষের মধ্যে অনৈক্য বাড়ে। তাই প্রত্যেকের উচিত, জিহ্বার নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রা. বলেন, হে আল্লাহর নবী! আমরা যে কথা-বার্তা বলি এগুলোর ব্যাপারেও কি পাকড়াও (জবাবদিহি) হবে? বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَاذُ وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلاَّ حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ অর্থাৎ, 'হে মুআয! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক! মানুষকে কেবল জিহ্বার কথার কারণেই অধঃমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।' (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬১৬) مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ অর্থাৎ, 'যে ব্যক্তি ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রমজানের সিয়াম পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।' (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৩৮) রোজাদারের সবসময় মনে রাখা উচিত যে, মুসলমানকে গালি দেওয়া বা কটু কথা বলা পাপ। এটি আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘন ও নিজের ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার এক বড় কারণ। যখন কেউ রাগ ও বিদ্বেষের বশে অপমানজনক কথা বলে, তখন সে নিজের ঈমান ও চরিত্রকে কলুষিত করে ফেলে। এটি শুধু নিজের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বরং মুসলিম সমাজের সৌহার্দ্য নষ্ট করে ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দুর্বল করে দেয়। মহান আল্লাহ বলেছেন, اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَ اَخَوَیۡکُمۡ অর্থাৎ, 'মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর।' (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১০) রোজা রাখার সময় খারাপ কথা বলা আরও বেশি গর্হিত ও নিষিদ্ধ। এ জন্য আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেছেন, الصِّيَامُ جُنَّةٌ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَجْهَلْ وَإِنْ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ مَرَّتَيْنِ অর্থাৎ, 'সিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তাহলে সে যেন দুই বার বলে, আমি রোজা পালন করছি।' (সহিহ বুখারী, হাদিস: ১৮৯৪) একজন রোজাদারের উচিত, নিজেকে এই শিক্ষার কথা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া, যাতে সে রাগ ও অপমানের মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখতে পারে। অন্য ভাইদেরও এ বিষয়ে সচেতন করা উচিত, যাতে তারা ভুল পথে না যায় এবং আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে। এই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো—নিজের জিহ্বাকে সংযত করা, খারাপ কথার জবাবে খারাপ কথা না বলা ও ঝগড়ার মাধ্যমে শত্রুতা সৃষ্টি না করা। কেননা এসব দ্বন্দ্ব ও কটু কথা শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কই নষ্ট করে না, বরং পুরো সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে দেয়। یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ۙ অর্থাৎ, 'হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্যে সিয়ামের বিধান দেওয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।' (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩) আলেমগণ বলেছেন, রোজা হলো সেই শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, যা একজন মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার পথে পরিচালিত করে। একজন রোজাদার নিজের ভালোবাসার চেয়ে আল্লাহর ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পানাহার ও ব্যক্তিগত চাহিদা ত্যাগ করে। এজন্য মহান আল্লাহ রোজাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ অর্থাৎ, 'আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা শুধুমাত্র আমার জন্য। আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।' (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯০৪) মহাগ্রন্থ আল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পবিত্র রমজানুল মোবারক এর মাহাত্ম্য, মহিমা ও তাৎপর্য উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَبَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَالۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَہِدَ مِنۡکُمُ الشَّہۡرَ فَلۡیَصُمۡہُ ؕ وَمَنۡ کَانَ مَرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیۡدُ اللّٰہُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَلَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ۫ وَلِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّۃَ وَلِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ وَلَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ অর্থাৎ, 'রমজান মাস, এতে মানুষের পথনির্দেশ, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তা চান আর যা তোমাদের জন্যে কষ্টকর তা চান না। আর তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে ও তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করানোর কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।' (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫) রমজান শুধু উপবাসের মাস নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, সহমর্মিতা ও দানশীলতার শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে মানুষের মনের ভেতরে থাকা ভালো গুণাবলি জাগ্রত হয় ও মন্দ প্রবৃত্তিগুলো দমন করা যায়। সত্যিকারের রোজাদার ঝগড়া করে না, কাউকে গালি দেয় না, কারো সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়ায় না, বরং ধৈর্যের সাথে সবকিছু সহ্য করে। এ কারণেই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ অর্থাৎ, 'রোজাদারের জন্য রয়েছে দুটি আনন্দ: একটি ইফতারের সময় ও অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৯৭) রমজান আমাদের জন্য এসেছে—বরকত, ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস হিসেবে। এটি আল্লাহর জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকার মাস। এই মাসে আল্লাহ আমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করেন, পাপ মোচন করেন, দোয়া কবুল করেন ও আমাদের প্রতিযোগিতা দেখে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন।সুতরাং, বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে এই সুযোগকে কাজে লাগায়, আর হতভাগা সেই ব্যক্তি, যে রমজান পেয়েও ক্ষমা অর্জন করতে পারে না। তাই, হে কল্যাণপ্রত্যাশী! তুমি এগিয়ে আসো, আর হে পাপের পথিক! তুমি থেমে যাও। অনুবাদ: আবদুল কাইয়ুম শেখ এমএইচ/ |