২য় তারাবির নামাজে তিলাওয়াতের সারমর্ম (সূরা বাকারা ২০৪-২৮৬)
প্রকাশ: ০২ মার্চ, ২০২৫, ০৫:০৯ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||

পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম পথনির্দেশ, যা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তারাবির নামাজে প্রতিদিন আমরা এই মহাগ্রন্থের তেলাওয়াত শ্রবণ করি, যা আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করে এবং সঠিক পথের দিশা দেয়। দ্বিতীয় দিনের তারাবিতে সূরা আল-বাকারা ও সূরা আলে ইমরানের গুরুত্বপূর্ণ আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয়েছে, যেখানে রয়েছে ঈমান, আত্মনিবেদন, পার্থিব ও আখিরাতের জীবনবিধান এবং অতীত উম্মতদের শিক্ষণীয় ইতিহাস।

এই অংশে মুনাফিকদের প্রতারণা ও পরিণতি, তালাক ও পারিবারিক বিধান, অর্থনৈতিক আদেশ-নিষেধ, তালুত ও জালুতের যুদ্ধ এবং বদর যুদ্ধের আলোচনা এসেছে। পাশাপাশি, আল্লাহর একত্ববাদ, কুরআনের সত্যতা, মরিয়ম (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর প্রকৃত পরিচয়, এবং আহলে কিতাবদের প্রতারণার বিষয়ও উন্মোচিত হয়েছে।

১. সূরা আল-বাকারা (২০৪-২৮৬) সারমর্ম

মুনাফিকদের কপটতা ও পরিণতি (২০৪-২১০)

  • কিছু লোক বাহ্যিকভাবে ভালো কথা বলে, কিন্তু তারা আসলে দুষ্ট ও ইসলামবিরোধী।
  • তারা সমাজে ফিতনা সৃষ্টি করে এবং ধ্বংসের কাজ করে।
  • আল্লাহ মুত্তাকীদের ধৈর্য ধরার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ইসলামের পথে অবিচল থাকার তাগিদ দিয়েছেন।

হারাম-হালাল ও পারিবারিক বিধান (২১১-২৪২)

  • বনি ইসরাইলের অতীত অন্যায় ও আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকারের কাহিনি এসেছে।
  • তালাক, ইদ্দত, পুনরায় বিবাহ, নারীদের অধিকার, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক বিধান বর্ণিত হয়েছে।
  • দান-সদকার গুরুত্ব এবং সুদের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

তালুত ও জালুতের যুদ্ধ (২৪৩-২৫২)

  • বনি ইসরাইল একসময় নবীর কাছে রাজা চেয়েছিল, আল্লাহ তাদের জন্য তালুতকে (Saul) নির্বাচিত করেন।
  • তালুতের ছোট বাহিনী বিশাল জালুতের (Goliath) বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং আল্লাহর সাহায্যে বিজয় লাভ করে।
  • নবী দাউদ (আ.) জালুতকে হত্যা করেন এবং আল্লাহ তাঁকে নবুয়ত ও রাজত্ব দান করেন।

ঈমান, নামাজ, দোয়া ও ইসলামিক অর্থনীতি (২৫৩-২৮৬)

  • আল্লাহ বলেন, কিছু নবীকে অন্যদের তুলনায় উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন।
  • আয়াতুল কুরসিতে (২:২৫৫) আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, একত্ববাদ ও শক্তিমত্তা বর্ণিত হয়েছে।
  • সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং দান-সদকার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
  • সবশেষে দোয়া শেখানো হয়েছে: "رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا" (হে আমাদের রব, যদি আমরা ভুলে যাই বা ভুল করি তবে আমাদের ধরবেন না) – (২:২৮৬)।

২. সূরা আলে ইমরান (১-৯১) সারমর্ম

আল্লাহর একত্ববাদ ও কুরআনের গুরুত্ব (১-১৩)

  • আল্লাহ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা।
  • কুরআন সত্য এবং পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সত্যায়নকারী।
  • বদর যুদ্ধের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে—যেখানে ঈমানদাররা ছোট বাহিনী নিয়েও আল্লাহর সাহায্যে বিজয় লাভ করেছিল।

মুমিন ও কাফেরদের পার্থক্য (১৪-৩২)

  • দুনিয়ার আরাম-আয়েশের প্রতি আসক্তি মুমিনদের জন্য পরীক্ষা।
  • মুমিনরা আল্লাহর পথে জীবন ব্যয় করে, আর কাফেররা দুনিয়ার সুখকে মুখ্য মনে করে।
  • আল্লাহর অনুগতদের জন্য জান্নাত প্রস্তুত করা হয়েছে, আর অবাধ্যদের জন্য জাহান্নাম।

মরিয়ম (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর সত্যতা (৩৩-৬৩)

  • মরিয়ম (আ.)-এর জন্ম ও তাঁর নিষ্কলুষ চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
  • ঈসা (আ.)-এর অলৌকিক জন্ম ও তাঁকে নিয়ে ইহুদি-খ্রিস্টানদের বিভ্রান্তি দূর করা হয়েছে।
  • তিনি আল্লাহর একজন নবী, তবে আল্লাহর পুত্র নন।

আহলে কিতাবের সত্যতা অস্বীকার ও তাদের প্রতারণা (৬৪-৯১)

  • আহলে কিতাবদের সত্য গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
  • তারা কিভাবে আল্লাহর আয়াত পরিবর্তন করেছে এবং নবীদের হত্যা করেছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে।
  • যারা সত্য জানার পরও গোপন করে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তারা কঠোর শাস্তি পাবে।

মূল শিক্ষা ও বার্তা:

  • আল্লাহর পথেই প্রকৃত সাফল্য, দুনিয়ার মোহ ধোঁকা মাত্র।
  • সুদ ও অন্যায় লেনদেন সমাজ ধ্বংস করে, তাই ইসলাম তা কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
  • ঈসা (আ.) আল্লাহর নবী, তিনি কোনোভাবেই আল্লাহর পুত্র নন।
  • বদর যুদ্ধের ঘটনা মুসলিমদের ধৈর্য ও আল্লাহর সাহায্যের শিক্ষা দেয়।
  • সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কঠিন পরিস্থিতিতেও মুমিনদের অবিচল থাকতে হবে।

পরিসমাপ্তি

দ্বিতীয় দিনের তারাবির তেলাওয়াত আমাদের সামনে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিধানসমূহ তুলে ধরেছে। এখানে মুনাফিকদের প্রতারণা ও তাদের পরিণতি, পারিবারিক জীবনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক আদর্শ, যুদ্ধের নীতি ও আত্মত্যাগের শিক্ষা রয়েছে। তালুত ও জালুতের যুদ্ধ, বদর যুদ্ধের শিক্ষণীয় দিক, ঈসা (আ.)-এর প্রকৃত পরিচয় এবং আহলে কিতাবদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এই অংশ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সত্য ও ন্যায়বিচারের পথ কঠিন হলেও, আল্লাহর সাহায্য ও নির্দেশনা অনুসরণ করলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী। যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তারা পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনে সফল হবে। অন্যদিকে, যারা আল্লাহর বিধান অমান্য করে ও সত্যকে গোপন করে, তারা ধ্বংসের পথে যাবে। এই শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃত সফলতা একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যে রয়েছে। যারা সত্যের পথ অনুসরণ করবে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ, আর যারা আল্লাহর বিধান অমান্য করবে, তারা কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হবে। অতএব, আমরা যেন কুরআনের এই মূল্যবান শিক্ষাগুলো হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি।

আমরা যেন এই মহামূল্যবান শিক্ষাগুলো হৃদয়ে ধারণ করি, নামাজ, দোয়া ও আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে নিজেদের জীবন গড়ে তুলি এবং কুরআনের আলোকে চলার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের এই মহিমান্বিত শিক্ষাগুলো অনুধাবন ও বাস্তবায়নের তাওফিক দান করুন—আমিন।

লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ। মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর।

আরও পড়ুন : ১ম তারাবির নামাজে তিলাওয়াতের সারমর্ম (সূরা বাকারা: ১-২০৩)

হাআমা/