মাদানীনগর মাদরাসায় ২ দিনব্যাপী ‘ইসলাহী জোড়’ শুরু
প্রকাশ:
১৫ নভেম্বর, ২০২৪, ০৪:৪২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মাদানীনগরে দু’দিনব্যাপী আত্মশুদ্ধিমূলক মাহফিল শুরু হয়েছে। জামিয়ার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ‘ইসলাহী জোড়’ নামের এই ব্যতিক্রম মাহফিলটি আজ শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) ফজরের পর আম বয়ানের ম্যধ দিয়ে শুরু হয়েছে। আগামীকাল শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাত ৯টায় আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে। আত্মশুদ্ধিমূলক এই মাহফিলটি দেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন শায়খ ইদরীস সন্দ্বীপী রহ. প্রবর্তন করেন। তার তিরোধানের পর তার বড় ছেলে মাওলানা ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপী দা. বা. এর পরিচালনা ভার গ্রহণ করেন। প্রতিবছর নভম্বেরের এই সময় দেশের শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজারো মানুষ মিলিত হয় এই মজমায়। তারা এখান থেকে দ্বীনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও আত্মিক পরিশুদ্ধির পাথেয় লাভ করে। সেজন্য সুশৃঙ্খলভাবে তাদেরকে আমলে জুড়িয়ে রাখা হয়। আত্মশুদ্ধির পাথেয় সংগ্রহ করতে যারা আসেন, তাদেরকে ধর্মীয় মহলে আশিক বলে সম্বোধন করা হয়। আশিক অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালার প্রেম সরোবরে অবগাহনকারী। জামিয়ায় মূলত এই ধরনের আশিকদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। তাদেরকে আল্লাহ প্রেমের সবক নিতে দু’দিন জামিয়ায় অবস্থান নিতে হয়। এ সময় নিয়মতান্ত্রিকভাবে আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য তাদেরকে আমলের উপর উঠানো হয়। আশিকানকে ফজরের আগে তাহাজ্জুদের সময় উঠতে হয়। এ সময় তারা তাহাজ্জুদ পড়ে জিকিরের মশক করেন। পরে ফজরের আজান হলে প্রস্তুতি নিয়ে জামাতের সহিত নামাজ আদায় করেন। ফজরের পর থেকে শুরু হয় আশিকানের উদ্দেশে আম বয়ান। এ সময় তাদেরকে আত্মশুদ্ধিমূলক বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। নাস্তার আগ পর্যন্ত বয়ানের আমল চলতে থাকে। নাস্তার পর প্রত্যেকে নিজ নিজ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সময় জামিয়ার তালিবুল ইলম ও উস্তাজরা তাদের আবাসনস্থানে গিয়ে প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেন। ক্বারী সাহেবরা গিয়ে তেলাওয়াতেরও মশক করান। এভাবে জোহরের আগ পর্যন্ত শেখা-শেখানোর কাজ চলতে থাকে। জোহরের পর আবারো মঞ্চ থেকে বয়ান শুরু হয়। আসর পর্যন্ত নানা উলামায়ে কেরাম দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনা করতে থাকেন। একই ধারাবাহিকতায় আসর ও মাগরিবের পর বয়ানের আমল চলতে থাকে। এই মাহফিলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এশার পর মাহফিলের কোনো কার্যক্রম থাকে না। এলাকার মানুষের যেন কোনো ধরনের কষ্ট না হয়, সেজন্য এশার পরে খাবার শেষে সবাই ব্যক্তিগত আমলে মগ্ন থাকেন। উম্মাহের পরিশুদ্ধির এই অভিনব পন্থার উদ্ভাবনকারী শায়খ ইদরিস সন্দ্বীপীকে ভালোবেসে মুসলিহে উম্মত অভিধায় স্মরণ করা হয়। তিনি ছিলেন হাজারো পথভোলা মানুষের দ্বীনী পথের বাতিঘর। অসংখ্য বিপথগামী মানুষ তার ছোঁয়ায় এসে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছেন। শায়খ সন্দ্বীপী রহ. এর মূল ভিশন ছিল তিনটি। তা হলো দাওয়াত, তালিম (ধর্মীয় শিক্ষা) ও তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি)। এই তিন মিশন বাস্তবায়নে মুসলিহে উম্মত জীবনভর শ্রম দিয়ে গেছেন। দাওয়াত ও তালিমের পাশাপাশি তিনি আত্মশুদ্ধির বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিতেন। তিনি আশিকদের আত্মশুদ্ধির জন্য প্রতিমাসেই বিভিন্ন মসজিদে মাসিক ইসলাহী জোড়ের আয়োজন করতেন। এই মাহফিল স্থানীয় মুসলমানদের দ্বীনী শিক্ষা ও আত্মিক পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আর বছরে দু’দিনব্যাপী ইসলাহী জোড় করতেন। মাসিক ইসলাহী জোড় যেসব এলাকায় হতো, ওসব এলাকা থেকে বিশেষভাবে লোকজন এসে এখানে শরিক হন। এছাড়া শায়খ রহ. এর মুহিব্বিন ও মুতাআল্লিকীনরা যে যেখানে থাকতেন, সেখান থেকে তারাও এসে এই মাহফিলে অংশগ্রহণ করতেন। সে হিসেবে দেখা যায়, প্রতিবছর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুরসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগন মাদানীনগরে আসেন। প্রতি বছর প্রায় বিশ হাজারের অধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই জোড়ে অংশগ্রহণ করেন। দূর থেকে আগত মেহমানদের থাকা-খাওয়া ও গোসলসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা জামিআর পক্ষ থেকে করা হয়। তাই মুসল্লিদের শুধু থাকার বিছানা, কাপড়-চোপড় ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে আনলেই হয়। মাহফিল উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয় মাদরাসার ক্যাম্পাস, মেহমানখানা ও অন্যান্য ভবনগুলো। জোড়ে আগত জামিআর ফুজালা (শিক্ষাসমাপনকারী) ও যেকোনো শিক্ষাবর্ষে পড়েছে এমন আবনাদের জন্য মাদরাসার দক্ষিণ ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে থাকা-খাওয়া ও মেহমানদারীর সুব্যবস্থা। আর বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মেহমানদের থাকার জন্য জামিয়ার ভবনগুলো ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, যাত্রাবাড়ি ও মিরপুর এলাকার মানুষের জন্য মসজিদের দ্বিতীয় তলার উত্তর পার্শ্ব বরাদ্দ থাকে। নরসিংদী আড়াইহাজার এলাকার মুসল্লিদের জন্য মসজিদের প্রথম তলা ও দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পার্শ্ব ব্যবহৃত হয়। রাজশাহী জেলার মেহমানরা মক্তব বিভাগে (৪র্থ তলা) থাকেন। জামালপুরবাসীর জন্য মক্তব বিভাগ ও উর্দু বিভাগের পূর্ব পার্শ্ব থাকে। গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের জন্য উর্দু বিভাগ (৫ম তলা) দক্ষিণ পার্শ্ব বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বৃহত্তর রংপুর, ভোলা, চট্টগ্রাম নোয়াখালী ও বরিশাল এলাকার মুসল্লিদের জন্য উত্তর ভবনের পঞ্চম তলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারো জোড়ে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করবেন বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিস ও ভারতীয় মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ইসলামী অরাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রধান, আমিরুল হিন্দ আওলাদে রাসূল মাওলানা সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী দা. বা.। জোড়ে আগমন করবেন বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। বিশেষ নসিহত পেশ করবেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস মুফতি ইউসুফ তাওলভী, বাংলাদেশের স্বনামধন্য হাদিস বিশারদ, মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়ার শিক্ষা সচিব ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সম্মানিত খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক, আকবর কমপ্লেক্সের মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস মুফতি দেলোয়ার সাহেব। বিশিষ্ট ইসলাহী ব্যক্তিত্ব ও ফরিদাবাদ মাদরাসার প্রধান মুফতি আবু সাঈদ। এছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েখ জোড়ে ইসলাহী বয়ান পেশ করার কথা রয়েছে। উম্মাহর ঐক্য-সংহতি ও আত্মীক উৎকর্ষের লক্ষ্যে গতানুগতিক মাহফিলের উর্ধ্বে ওঠে ব্যতিক্রমী এই জোড়ের আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা মনীষী মুসলিহে উম্মাহ শায়খ ইদরীস সন্দ্বীপী রহ.। প্রচারবিমুখ এই ব্যক্তিত্বের দেশজুড়ে রয়েছে অনেক অমর কীর্তি। ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মাদানীনগর তাঁর উজ্জ্বল কীর্তিসমূহের অন্যতম। মাদানীনগর ছাড়াও তিনি দেশের আনাচে কানাচে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রায় দেড় শতাধিক দ্বীনী মাদরাসা। এ সকল প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছেন সতন্ত্র একটি শিক্ষাবোর্ড। বর্তমানে দারুল উলূম মাদানীনগরের পরিচালনার দায়িত্ব, দেশব্যাপী ইসলাহী কার্যক্রম, হজরতের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাবোর্ড, ও মাদরাসাসমূহ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন তারই সুযোগ্য সাহেবযাদা হাফেজ মাওলানা ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপী হাফি:। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, শায়খ সন্দ্বীপী রহ. ছিলেন ওই সকল মনীষীদের একজন যারা বাংলাদেশে বহুমত ও পথের অন্তরালে নিভৃতভাবে একইসাথে দাওয়াত, তালিম, তাযকিয়ার সমন্বয়ে দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। হাআমা/ |