উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (৩)
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট, ২০২৪, ০৫:৪৩ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দীন ||

গত কিস্তির পর থেকে…

উজবেকিস্তানের খাদ্য-খাবার

উজবেকিস্তানে রুটি এবং নুডলসই অধিক প্রচলিত খাদ্য। উজবেক রন্ধনশৈলীকে ‘নুডলসে সমৃদ্ধ’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। উজবেকিস্তানে প্রচুর পরিমাণে ভেড়া থাকায় মাটন (Mutton/ভেড়ার মাংস) খুব জনপ্রিয় মাংস এবং এটি বিভিন্ন উজবেক খাবারের অংশ হিসেবে থাকে।

উজবেকিস্তানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খাবারের আইটেম হল পিলাভ বা পালভ। এটাকে উজবেকদের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় খাবার বলা হয়। কেউ কেউ বলে ওশ। বুখারা অঞ্চলে একে বলে শোশ সোফী (sosh sofi), আরবিতে বলে রুঝ বুখারী (رز بخاري)। ইংরেজি নাম পিলাফ। ভেড়ার মাংস, চাল, গাজর ও পিয়াজ দিয়ে তৈরি বিরানী ধরনের এই খাবারটি বেশ মুখরোচক। ছাগলের মাংস, গরুর মাংস বা ঘোড়ার মাংস দিয়েও পিলাভ তৈরি হয়। এই খাবারটি পাবেন তাশখন্দ, বুখারাসহ অন্যান্য শহরের যে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে। শুধু এই খাবারের জন্য স্বতন্ত্র রেস্টুরেন্টও রয়েছে। বুখারায় sosh sofi সাইনবোর্ডে অনেক স্বতন্ত্র রেস্টুরেন্ট দেখেছি। বুখারার লোকদের দাবি তাদের এলাকার পিলাভই শ্রেষ্ঠ। যাহোক উজবেকিস্তান সফরে গেলে পিলাভের স্বাদ পরখ করতে ভুলবেন না।

উজবেকিস্তানে আমাদের দেশের মতো রান্না করা সবজি বা ঝোলবিশিষ্ট ব্যঞ্জন কোথাও পাবেন না। ঝোলবিশিষ্ট মাছের ছালুন তো মোটেই না। কোথাও রেস্টুরেন্টে মাছ পেলেও তা হবে তেলে ভাজা কড়কড়ে এবং মসলা ছাড়া, যা খেয়ে বাঙালিদের মাছের রসনা তৃপ্ত হবে না। একান্তই সবজি ঝোল পেতে চাইলে রেস্টুরেন্টে 'শুরওয়া'-এর অর্ডার করবেন, তাহলে সবজি, গোসত ও চর্বিযুক্ত এক ধরনের পাতলা ঝোলবিশিষ্ট ব্যঞ্জন পাবেন, যাকে স্যুপও বলা যেতে পারে। শামুচা পাওয়া যায়। ওরা বলে শোমচা। পুরোটাই গোসতের কিমা দিয়ে ভরা থাকে। অনেকটা আমাদের রুচির কাছাকাছি হয়। তবে মনে রাখবেন উজবেকরা ঝাল মোটেই খায় না। একেবারে ঝাল ছাড়া যাদের চলেই না, তারা যাওয়ার সময় কাচা মরিচ বা তেলে ভাজা শুকনো মরিচ সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তাও নিতে না পারলে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় Green Chilli (কাচা মরিচ)- চেয়ে দেখবেন। পেতেও পারেন। পেলেও আমাদের দেশের কাচা মরিচের মতো সুস্বাদু পাবেন না। আর একটা কথা বলে রাখি। উজবেকিস্তানের কোন রেস্টুরেন্টেই ভাত পাবেন না। তাই যতদিন উজবেকিস্তানে থাকবেন, ভাতের রোজা চলতে থাকবে। শুধু চলবে রুটি আর কাবাব, রুটি আর কাবাব। সাথে সালাদ এবং বিভিন্ন ফল-ফ্রুটও রাখতে পারেন। হয়তো মাঝেমধ্যে শুরওয়া বা পিলাভ কিম্বা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কোন ফাস্টফুড। ভাতপাগলরা যাওয়ার আগেই সফরের দিনগুলোতে ভাতের রোজা চলবে বলে মনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে প্রস্তুত করে নিয়ে যাবেন।

উজবেকিস্তানের মুদ্রা
উজবেকিস্তানের মুদ্রার নাম সোম (som)। কেউ কেউ উচ্চারণ করে সুম (sum)। বর্তমানে (২০২৪ ইং) আমাদের এক টাকা= ১০৩ সোম। তার মানে ১ টাকায় পাওয়া যায় ১০৩ সোম। তাহলে ১০০ টাকায় ১০,৩০০ সোম। ১০০০ টাকায় ১,০৩,০০ সোম। ওদেশে সর্বনিম্ন মুদ্রার নোট হচ্ছে এক হাজার সোমের নোট। আর সর্বোচ্চ দুই লক্ষ সোমের নোট।

আমরা তাশখন্দ এয়ারপোর্টে নেমে ওখান থেকে কিছু ডলার ভেঙ্গে সোম নিয়ে নেই। প্রতি ১০০ ডলারে আমরা পেয়েছিলাম ১২ লক্ষ ২৫ হাজার সোম। পরবর্তীতে সমরকন্দে এক মানি এক্সচেঞ্জে ডলার ভাঙ্গালে পাই প্রতি ১০০ ডলারে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার সোম।

বাংলাদেশের চেয়ে উজবেকিস্তানের মুদ্রার মান কম হওয়া এটা নিশ্চিত করে না যে, উজবেকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বা অনুন্নত দেশ। (বাস্তবে উজবেকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা কি সে আলোচনায় আমি যাচ্ছি না।) বস্তুত মুদ্রার মান কম বা বেশি হওয়া বিশেষ একটা পলিসি নির্ভর। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান প্রভৃতি বহু দেশের মুদ্রার মান আমাদের মুদ্রার চেয়ে কম। তাই বলে ওসব দেশ আমাদের চেয়ে দুর্বল বা অনুন্নত নয়। আমাদের ৮০ পয়সায় জাপানের ১ ইয়েন পাওয়া যায়। আমাদের ১ টাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ১২ ওন পাওয়া যায়। ১ টাকায় উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১৬ ওন পাওয়া যায়। আর 1 টাকায় ইরানী রিয়াল পাওয়া যায় প্রায় পৌনে পাঁচশ। যাহোক উজবেকিস্তানের সোমের মূল্যমান উল্লেখ করলাম।

উজবেকিস্তান গিয়ে প্রথম প্রথম সবকিছুর দাম শুনে একটু আগুনের সেকা লাগত। হাফ লিটার একটা পানির দাম হাজার বারশ' সোম। বাপরে বাপ বলে কি! পরে হিসেব করে দেখলাম দশ টাকার মতো হয়। একদিন বিকেলে চার জন একটা হোটেলে একটু কাবাব চা নাস্তা করলাম। বিল কত? এক লক্ষ পচাত্তর হাজার সোম। মানে সতেরশ' টাকা। মজা লেগেছিল সমরকন্দে এক হোটেলের বিল পরিশোধ করার সময়। হোটেলটিতে আমরা তিন জন তিন দিন ছিলাম। তিন বেডের একটা রুম। চেক আউটের সময় ভাড়া মোট কত জিজ্ঞেস করলে জানাল, থ্রি মিলিয়ন থ্রি লাখ। অর্থাৎ, তেত্রিশ লক্ষ সোম। একটু বড়লোক বড়লোক ভাব বোধ হল। মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা দিয়ে থাকা! আসলে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা নয়, মিলিয়ন মিলিয়ন সোম। তিন মিলিয়ন তিন লাখ তথা তেত্রিশ লক্ষ সোম আমাদের টাকায় বত্রিশ হাজারের মতো। তাতে প্রতিদিন জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজারের মতো পড়ে। তা সেটা যে মানের হোটেল ছিল আমাদের দেশে হলে ভাড়া আরও বেশি হত। তদুপরি ওদেশে একটু মানসম্পন্ন হোটেলে ভাড়ার মধ্যে সকালের নাস্তা (Breakfast)ও অন্তর্ভুক্ত থাকে। বুফে সিস্টেমে নাস্তার ব্যবস্থা। একদিন গণনা করে দেখেছিলাম বিভিন্ন রকমের রুটি, নুডলস, বিভিন্ন রকমের তাজা ফ্রুট, বিভিন্ন রকমের ড্রাই ফ্রুট, বিভিন্ন রকমের শরবত, কোল্ডড্রিংস, বিভিন্ন রকমের সালাদ, চা, কফি, গোসত ও ডিমের তৈরি নানান পদসহ প্রায় ষাট রকমের আইটেম। সবটাই মানসম্মত ও ফ্রেশ আইটেম। অনেকে এই ব্রেকফাস্ট এমনভাবে সারে যে, দুপুরে আর খাওয়ার মতো ক্ষিদে অনুভব হয় না। এদিকটা চিন্তা করলে থাকার ভাড়া তো অনেক কমে যায়। তাই উজবেকিস্তান গিয়ে হোটেল ভাড়া করার সময় ভাড়ার মধ্যে ব্রেকফাস্টও ইনক্লুড কি না বুঝে নিবেন। ব্যয়সাশ্রয়ী হবে।

উজবেকিস্তান গিয়ে প্রথম প্রথম কোনকিছু কিনতে গেলেই হিসেব কষে বের করতে হয় এত হাজার বা এত লক্ষ সোম মানে কত টাকা। অনেকে তো রীতিমত মোবাইলের ক্যালকুলেটরে গিয়ে হিসেব বের করে দেখে। যেমন প্রথম প্রথম যারা হজ্জ বা উমরায় যায় তারা রিয়াল খরচ করতে গেলেও প্রথমে হিসেব করে দেখে কত রিয়ালে কত টাকা দাঁড়ায়।

সোম থেকে সহজে টাকার পরিমাণ বের করার জন্য আমি একটা সূত্র এরকম দাঁড় করিয়ে নিয়েছিলাম যে, সোমের প্রত্যেক নোট থেকে শেষের দু'টো শূন্য বাদ দিলে মোটামুটি টাকার পরিমাণ বের হয়ে আসে। যেমন: ১০০০ সোম অর্থ (এক হাজার থেকে দু'টো শূন্য বাদ দিলে) ১০ টাকা (প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও একটু কম।)। ১০০০০ হাজার থেকে দু'টো শূন্য বাদ দিলে ১০০ টাকা। ১০০০০০ থেকে দু'টো শূন্য বাদ দিলে ১০০০ টাকা।

চলবে...

আরো পড়ুন: উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (১)

আরো পড়ুন: উজবেকিস্তানে কয়েক দিন (২)

কেএল/