বাংলাদেশ বোটানিক্যাল সোসাইটির পরিবেশ বিষয়ক ওয়েবিনার
প্রকাশ: ৩০ জুন, ২০২৪, ১১:৫০ রাত
নিউজ ডেস্ক

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও বিশ্ব মরুকরণ দিবসের প্রতিপাদ্যকে জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ওয়েবনিয়ার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ বোটানিক্যাল সোসাইটি (আহ্বায়ক কমিটি)।

গত ২৯ জুন শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হয় এবং শেষ হয় রাত সাড়ে ১০টায়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এই ওয়েবিনারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাখ হরি সরকার।

প্রধান অতিথি ছিলেন হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেসের এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. অনিল চন্দ্র বসাক।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রফেসর ড. আবুল খায়ের গাছকে কেন্দ্র করে মানুষ, প্রাণী ও পাখির খাদ্য, জীবন, আবাসন বিষয়টি বিবেচনায় এনে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বেশী করে গাছ লাগানো ও তার পরির্চযা বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি পালনের জন্য আহ্বান জানান। পানির পরিমিত ব্যবহারের বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে বলেন।

ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ ড. মো. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী।

সুন্দরবন নিয়ে তার দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণার ফলাফলে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, স্থলজ ও জলজ পরিবেশের ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণের বিপর্যয়ের কারণে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়েছে, এমন কি বিলুপ্তি ঝুঁকি বাড়ছে কুমিরের মতো প্রাণীর। অসম পানি প্রবাহ ও বন্টনের ফলে দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের স্থলজ ও জলজ পরিবেশের লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে কম লবণাক্ততা প্রিয় উদ্ভিদসমূহের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

প্রথম আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান খন্দকার। তিনি বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের অতীত, বর্তমানকে বিবেচনায় এনে দেশব্যাপী জলজ ও স্থলজ সকল পরিবেশে সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার গুরুত্ব উল্লেখপূর্বক বলেন যে, তথ্য সংগ্রহে বস্তুনিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা থাকলে আমরা জীববৈচিত্র্যের সংকট ও তা উত্তরণের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এ বিষয়ে দাবি তুলতে পারবো।

দ্বিতীয় আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বাংলাদেশে শীত প্রধান দেশের স্ট্রবেরির প্রবর্তক অধ্যাপক ড. মনজুর হোসন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাস্তবতা বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতির দেশ এবং মাথাপিছু জমির প্রাপ্যতা জন প্রতি অত্যন্ত কম হওয়ায় খাদ্য, আবাসন, শিল্পায়ন, নগরায়ন, সড়ক নির্মাণের মতো প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য একটি ঋণাত্মক প্রভাব এদেশের জীববৈচিত্র্যের উপর পড়ে। পরিবেশ দূষণ কমানোসহ, সামষ্টিক অভ্যাস পাল্টানো এবং দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো ও বর্জনের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে তিনি মতামত দেন।’

সেমিনারের সঞ্চালক, সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাখ হরি সরকার বলেন, ‘আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। শুধু আলোচনা করলে হবে না। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসাবে দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে ।

সেমিনারে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ১১১ জন উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজের শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও গবেষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী, গবেষক, বেসরকারী পরিবেশ সংগঠনের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ সার্কভুক্ত দেশসমূহের উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আয়োজনকে সমৃদ্ধ করে। সবাই অভিমত পেশ না করলেও অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল এই সেমিনার।

নেপাল থেকে যুক্ত হয়েছিলেন ড. নারায়ন প্রসাদ গিমিরি। জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়োডাইভার্সিটির পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তিনি তার অভিমত পেশ করতে গিয়ে বলেন, ‘পিরিয়ডিক পরিবর্তন কেন হচ্ছে? কীভাবে হচ্ছে? তা বুঝার জন্য নিয়মিত আমাদের গবেষণা চালানো দরকার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আজমল হোসেন ভুঁইয়াও অভিমত পেশ করেন এই সেমিনারে। অধ্যাপক আজমল মূলত জলজ উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির প্রবাহ না আসার কারণেও আমাদের দেশে বায়োডাইভার্সিটির কম্পোনেন্ট কমে গেছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসানুর রহমান জানান, জলবায়ুর পরিবর্তন উত্তরবঙ্গে কি ধরণের প্রভাব ফেলছে এই নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের ভাবনাগুলো স্থানান্তর করতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনটা কীভাবে আমাদের পরিবেশে ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটিয়ে যাচ্ছে সেটা আমরা চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছি। আমাদের চোখের সামনে কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে! জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ইকোসিস্টেমের পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে ফুড চেইনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবেশের উপর যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে তা প্রশাসনের কাছে আমাদের উপস্থাপন করতে হবে।’

দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রোপ ফিজিওলজি ও ইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্রীপতি শিকদার বলেন, ‘যেন সেমিনারের জন্য শুধু সেমিনার না হয়। আসলে আমাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হবে। আমরা অরগানাইজড ফরমে কিছু রিকোমেন্ডেশন প্রকাশ করতে পারি, সেগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে দিতে হবে।

ইডেন মহিলা কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌসী নূর বলেন, ‘অনলাইন সেমিনারে বড় বড় গবেষক ও আকাডেমিশিয়ানদের পাশাপাশি আমাদের ছাত্রদেরও অংশগ্রহণ করানো যেতে পারে। পরিবেশ নিয়ে অনেকের গবেষণার ইচ্ছা থাকে। এসব সেমিনারে অংশগ্রহণ করলে যাদের গবেষণার ইচ্ছা আছে তারা পরিবেশ নিয়ে গবেষণায় ব্যাপারে আরও বেশী আগ্রহী হয়ে উঠবে এবং গবেষণার বিষয়ে দিক নির্দেশনা পাবে।’

সরাসরি কোনও আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং অভিমত পেশ না করলেও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের পরিচালক এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ। শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান বোটানি লিমটেড-এর প্রধান গ্রিন মিজানুর রহমানও তার অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি মৌখিকভাবে তার অভিমত উপস্থাপনের পাশাপাশি লিখিত কিছু রিকোমেন্ডেশন দিবেন বলে জানিয়েছেন ।

বিএফআরআই এবং বিসিএসআইআর এর কয়েকজন গবেষকের পাশাপাশি বিসিএসআইআর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নজরুল ইসলাম ভুঁইয়াও এই ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অনিমেশ বিশ্বাস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান খন্দকার ও ড. আমিনুল ইসলাম খন্দকার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব বায়ো-সাইন্সের ডিন ড. সুব্রত দাস, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শাহিদুর রহমান, নেত্রকোনা সরকারী কলেজের উপধ্যক্ষ ড. বিমল সরকার, রাজশাহী সরকারী সিটি কলেজের শিক্ষক মো. আশরাফুল আলম, নওগাঁ সরকারী কলেজের শিক্ষক আবু কাউসার এবং ড. জাবেদ হোসেন ছাড়াও অনেকে অংশগ্রহণ করেন।

ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারীরা ব্যক্তিগত, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমের ভিত্তিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারসহ আগ্রাসী উদ্ভিদের আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য সক্রিয় হওয়ার সময় এখনই বলে কাজ শুরুর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

হাআমা/