জাতীয় চেতনার অগ্রগতিতে মাওলানা ইসহাক এর অবদান অমর হয়ে থাকবে
প্রকাশ: ০৬ জুন, ২০২৪, ০২:৩৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

|| মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া রহ. ||

১৯৭৭/৭৮ সালের কথা। ছাত্র শিবিরের সাথে দ্বন্দ্ব বিবাদের এক পর্যায়ে আমি ময়মনসিংহ ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি। সচেতন উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্যে থেকে লেখাপড়া করার অদম্য আগ্রহের ফলেই তখন ফরিদাবাদ মাদরাসায় আমার ভর্তি হওয়া। কারণ, বেশ কিছু সচেতন আলেম তখন ফরিদাবাদ মাদরাসায় একত্রিত হয়েছিলেন। মাওলানা আ. হাফিয রাহিমাহুল্লাহ, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী, মাওলানা সুলায়মান নু'মানী, মাওলানা মুফতী আব্দুল হান্নান, মাওলানা মুফতী গোলাম মোস্তফা প্রমুখ দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম তখন ফরিদাবাদ মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন।

আমি শরহে বেকায়া জামায়াত না পড়েই ভর্তি পরীক্ষার কঠিন মহড়া অতিক্রম করে হিদায়া জামায়াতে ভর্তি হয়ে যাই। তখন বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার অফিস ছিল ফরিদাবাদ মাদরাসায়। আমার বাবা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসাবে এক মিটিংএ এসে তাঁর ফাঁকিবাজ ছেলের কান্ড সম্পর্কে অবগত হয়ে তৎক্ষণাৎ মাদরাসার নাযিমে তালিমাত মাওলানা আশরাফ আলীকে বলে আমাকে শরহে বিকায়া জামায়াতে নামিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

পরদিন থেকে শরহে বিকায়ার জামায়াতে ক্লাশ করতে শুরু করলাম। একটি ছেলে উস্তাদদের সামনে বসে মুগ্ধাসার নামক কিতাবের ইবারত পড়ে যেত হাফেজের মত। সব সময় ভাল ছাত্র হিসাবে সুখ্যাতি থাকলেও মুখতাসারের ইবারত এভাবে পড়তে পারার বিষয়টি আমাকে বেশ অবাক করত।

ছেলেটির পরিচয় জানতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সে এ মাদরাসার এই জামায়াতের এক নম্বর ছাত্র। স্বাভাবিক কারণেই তাকে আমার প্রতিদ্বন্দী মনে হল। ক্লাসের প্রতিদ্বন্দীদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা আমার পূরোনো অভ্যাস থাকলেও মফস্বল শহর থেকে আসা ছাত্র হিসাবে রাজধানীর প্রতিভাবান একজন ছাত্রের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে বেশ সময় লাগল। ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জানলাম তার নাম মুহাম্মদ ইসহাক।

ময়মনসিংহে অধ্যয়নকালে ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী একজন ছাত্র হিসাবে সময় কাটানোর কারণে আমার মাঝে এক ধরনের অনুসন্ধানী মেজাজ তৈরী হয়েছিল। যে কারো গতিবিধির উপর নজর রাখা তখন একটা বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং আমার ক্লাসের এই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরীক্ষার প্রতিদ্বন্দীর ওপর অনুসন্ধানী নজর পড়াটা সেই অভ্যাসেরই পরিণতি। তা ছাড়া তখন প্রায় মাদরাসাতেই ছাত্র শিবির কাজ করত। সে কারণেও ছাত্রদের গতিবিধির ওপর কিছুটা অনুসন্ধানী দৃষ্টি আমার থাকত।

কারণ, আমি মনে করতাম দেওবন্দি মাদরাসার ছাত্রগুলো যদি বাতিলপন্থী মওদুদি জামায়াতের শিকার হয়ে যায় তাহলে আমাদের আদর্শের পতাকা সমুন্নত করে রাখবে কারা? আমি হজ ও বাতিলের পার্থক্য করার মত জ্ঞান না রাখলেও আমার বাবার ঘনিষ্ঠতার সুবাদে এতটুকু স্পষ্টভাবেই জেনে নিয়েছিলাম যে, মওদুদি সাহেবের চিন্তা ভাবনার অনেক কিছুই ইসলামের ও উলামায়ে উম্মাতের চিরন্তন বিশ্বাসের পরিপন্থী।

সে কারণে উলামায়ে কেরাম তাকে গোমরাহ মনে করেন। তা ছাড়া দু'চারজন শিবির কর্মীর সাথে সে সময় কথা বলতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে, তারা উলামায়ে কেরামকে অথর্ব ও অকর্মন্য মনে করেন অকপটে। অথচ জীবনের এক দীর্ঘ সময় উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্যে কাটিয়ে তাদেরকে আমার সেরূপ মনে হত না; বরং মনে হত ত্যাগ ও কুরবানির মূর্তপ্রতীক হলেন উলামায়ে কেরাম।

তবে চিন্তা চেতনার মন্দত্যতা ও মাতৃভাষার পশ্চাদপরতার যে সমালোচনা ছাত্র শিবিরের কর্মীরা করত সেটাকে সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করতে মন সম্মত না হলেও এ ক্ষেত্রগুলোতে আলেম সমাজের অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন এ বিষয়টি আমার ভাবনার জগতকে প্রায়ই নাড়া দিত।

প্রত্যেক নবীই তো তার স্বজাতিকে নিজের জাতীয় ভাষায় হেদায়াত করেছেন। অথচ আমরা নিজেদের মাতৃভাষায় একেবারে দৈন্যদশার শিকার। তাহলে আমরা নিজেদের জাতিকে হিদায়াত করব কি করে? এ ছাড়া এও ভাবতাম যে, ভারত পাকিস্তানে মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যম হল তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা উর্দু।

অথচ আমাদের বাংলাদেশেও মাদরাসার শিক্ষার মাধ্যম উর্দু। তাহলে আমরা আমাদের আহরিত জ্ঞান উপলব্ধির কাছাকাছি নিয়ে যাব কি করে? একটি বিদেশি ভাষায় জ্ঞান বিষয় উপলব্ধির সেই গভীরে পৌঁছে না যার দ্বারা চিন্তার জগৎ প্রসারিত হতে পারে। তাই ইচ্ছা ছিল এই বিষয়গুলোর উন্নয়নের জন্য ছাত্র সমাজের মাঝে চেতনার স্ফূরণ ঘটানোর লক্ষ্যে কিছু কাজ করা।

ময়মনসিংহে অধ্যয়নকালে মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের (বর্তমানে আজিমপুর মাদরাসার মুহাদ্দিস) মাওলানা খালেদ (বর্তমানে কামরাঙ্গীরচর মাদরাসার শিক্ষক) মাওলানা দিলাওয়ার (মেফতাহুল উলূম মাদরাসার মুহতামিম) সহ আরো কিছু সাথী সঙ্গী-এসব বিষয় নিয়ে কিছু কিছু ভাবতাম এবং কিছু কিছু চর্চাও করতাম। কিন্তু ফরিদাবাদে ভর্তি হয়ে শূণ্যতায় ভুগছিলাম। মাওলানা ইসহাকের ওপর আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টি থাকার কারণে মাঝে মাঝেই তার চাল চলনকে রহস্যজনক মনে হত। হারেস ইবনে হাম্মামের আবূ যায়েদ সারূজীকে অনুসরণ করার মত ইসহাককে অনুসরণ করতে যেয়ে একদিন আবিস্কার করলাম তাদেরকে একটি মিটিংয়ে।

আমাকে দেখে প্রথমে তারা আতংকিত হলেও আমার ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তারা নিজেকে আমার কাছে খুলে ধরল যে, তারা ছাত্র সমাজ নামে একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্য। আমি খুব সহজেই তাদের আতংক কাটিয়ে দিলাম এই বলে যে, আমার দ্বারা আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না। এই অভয়বাণী শুনে তারা আমাকে তাদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার দাওয়াত দেয়।

আমি তাদের কাগজপত্র কি আছে, তাদের চিন্তা চেতনার ধারাটা কী, কোন উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে তারা কাজ করতে চায়? ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলাম। আরো জানতে চাইলাম এই সংগঠন কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড় কি না? এর নেতৃত্ব কে দিচ্ছেন, এর আদর্শিক দিক নির্দেশনা কে করেন? ইত্যাদি। প্রতি উত্তরে যা জানতে পারলাম, তার সংক্ষেপ কথা হল, সংগঠনটি নেজামে ইসলাম পার্টির লেজুড়। খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দীক আহমদ এর এক ছেলে এর নেতৃত্বে রয়েছেন। ঐতিহ্যগতভাবে আশ্বস্ত হওয়া গেলেও একটি ছোট্ট হ্যান্ডবিল ছাড়া পার্টির চিন্তা চেতনা, লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া গেল না ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার আবেগময় একটি ধ্বনির অনুরণ ছাড়া।

আমি বুঝতে পারলাম চেতনার যে বহ্নি আমাকে দগ্ধ করছে সেই গভীরতায় পৌঁছার মত কোন উপাদান এ দলের আমার সম্মুখস্থ কর্মীদের হাতে নেই।

তবে এদেরকে বিরূপ ভাবাপন্ন করে তোলাও মুনাসিব মনে করলাম না; বরং আমার মনে হল, চিন্তা চেতনার স্ফূরণ এদের মাঝে ঘটাতে পারলে আমরা সবাই মিলে সেই পথ ধরে চেতনার সিড়ি তৈরী করতে পারব হয়ত। আমি মৌখিকভাবে তাদের সাথে কাজ করতে সম্মত আছি বলে জানিয়ে দিলাম। এই সুবাদে বেশ কিছু চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার জন্য উন্মুখ ছাত্রের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। এদের মাঝে মাওলানা মুস্তাফিযুর রহমান সোহাগী, মাওলানা মুহিউদ্দীন (আজিমপুর মাদরাসার মুহাদ্দিস) মাওলানা আবু সুফিয়ান (ফরহঙ্গে জাদীদের রচয়িতা) ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ (শায়খুল হাদীস তেজগাওঁ মাদরাসা) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তারা আমাকে তাদের পরবর্তী মিটিংএ দাওয়াত করল। নতুন অতিথি হিসেবে আমাকে কিছু বক্তব্য রাখতে বলা হলে আমি আমাদের বর্তমান জাতীয় সমস্যাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করলাম এবং বললাম যে, সংগঠন আমাদেরকে করতে হবে এই সমস্যাগুলো নিরসন করে উত্তরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। অথচ ছাত্র সমাজের যে কর্মসূচীর ভিত্তিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি তাতে এ বিষয়ের তেমন কোন কর্মসূচী নেই। তা ছাড়া এটা হল রাজধানী। ছাত্র সমাজের অফিস চট্টগ্রামে। রাজধানী কেন্দ্রীক না হলে কোন দলই ভাল করতে পারে না। এটা একটা সাধারণ কথা।

যাই হোক, এ পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা যদি সম্মত হন তাহলে আমরা ঢাকা কেন্দ্রীক একটি নতুন দল গঠন করতে পারি। সে দলটি গতানুগতিক কোন দল হবে না। আমাদের জাতীয় অভাব অভিযোগ ও সমস্যাগুলোর কথা মাথায় রেখে তা থেকে উত্তোরণের দীর্ঘ মেয়াদী কর্মসূচী নিয়ে কাজ করে যাবে।

আমার এ প্রস্তাব সর্বাগ্রে যে সমর্থন করেছিল সে ছিল মাওলানা ইসহাক। পরে অবশ্য ক্রমান্বয়ে আমরা সবাই একমত হয়ে একটি নতুন দল গঠনের পথে অগ্রসর হলাম এবং তার জন্য চিন্তা চেতনার বলয় নির্ধারণ, জাতীয় সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করণ, সে আলোকে দলের আহবানপত্র, কর্মসূচি, গঠনতন্ত্র ইত্যাদি প্রণয়নের প্রশ্ন সামনে আসল।

তখনই প্রশ্ন আসল আমরা এ কাজগুলো কিভাবে সম্পাদন করব। মাওলানা ইসহাক প্রস্তাব করল আমাদের মাঝে একেকজনকে একেকটি বিষয় তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হউক। পরে একটি সম্পাদনা বোর্ড তৈরি করে সেগুলো সম্পাদনা করে নিয়ে ছাপানো হোক। এসব কাগজপত্র সিকিউরিটির সাথে ছাপাতে হবে। কারণ, জানাজানি হয়ে গেলে মাদরাসা থেকে বহিস্কারের ফায়সালা হয়ে যাবে এটা সুনিশ্চিত।

অবশ্য এ জন্য একজন ভাল সহযোগী পেয়ে গেলাম। বাংলা বাজারের প্রেস ব্যবসায়ী এককালের নেজামে ইসলামের নিবেদিত কর্মী মাওলানা আব্দুল বাতেন রাহিমাহুল্লাহকে। তিনি আমাদের এই নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানালেন এবং জাতির এহেন মহতি কাজের জন্য তিনি আমাদের বসার, মিটিং করার জায়গার ব্যবস্থা ও সিকিউরিটি রক্ষা করে কাগজপত্র ছাপার ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমরা তার কাছে একটু সাহারা পেয়ে উদ্দীপ্ত হলাম। মাওলানা ইসহাকের প্রস্তাব অনুসারে একেকজনকে একেকটি কাজ বন্টন করে দেওয়া হল। কিন্তু অপরিপক্কতার কারণে কেউই তার কাজ শুরু করতে উৎসাহবোধ করল না।

পরে আমি প্রস্তাব করলাম যে, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের যার যা ভাবনা আছে সেগুলো অগোছালোভাবে হলেও কাগজের গায়ে লিপিবদ্ধ করে নেই। পরে আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার পর একটি করে খসড়া দাঁড় করাই। বিষয়টি এভাবেই ফায়সালা হল এবং এও ফায়সালা হল যে, আমাদের ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের জন্য আমাদের অভিজ্ঞ আসাতিযায়ে কিরাম থেকে ধারণা নিতে হবে।

কিন্তু সমস্যা হল, একটা ছাত্র সংগঠনের সংবাদ যে উস্তাদই জানবেন তা আমাদের বহিষ্কারের জন্য যথেষ্ঠ হয়ে যাবে। সুতরাং জানানোর উপায় কি হবে। একটা কৌশল তখন আমাদের মাথায় আসল যে, সুযোগ বুঝে সমস্যাটিকে সাধারণ প্রশ্ন আকারে ক্লাসে কোন একজন বিজ্ঞ উস্তাদের সামনে প্রশ্নটি ছুড়ে দিলে তিনি সে আলোকে যে বক্তব্য রাখবেন তা থেকে আমরা আমাদের কাংখিত বিষয়টি পেয়ে যাব।

এভাবে উস্তাদের থেকে মতামত গ্রহণ করেই আমরা আমাদের কর্মসূচীর খসড়া তৈরি করে এবং সবার খসড়া একত্রিত করে আমরা আমাদের আদর্শের বলয় নির্ধারণ করলাম। জাতীয় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করলাম। কর্মসূচি প্রণয়ন করলাম। গঠনতন্ত্র তৈরি করলাম এবং ছাত্র ঐক্য নামে কর্মের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। জাতীয় সমস্যা হিসাবে তখন আমাদের সামনে যে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছিল সেগুলো ছিল নিম্নরূপ:

. মাদরাসার ছাত্রদের চিন্তা চেতনার মন্দাত্ব। ২. আত্মসচেতনতার অভাব ও হীনমন্যতাবোধ।

. মাতৃভাষার দূর্বলতা-মনের ভাব ব্যক্ত করণে অক্ষমতা।

. গাফলত ও অলসতা, ফলে কর্মতৎপরতার অভাব।

. আকাবির ও আসলাফের চিন্তা চেতনা ও তাদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বে-খবরী, ফলে হীনমন্যতাবোধ।

. লিখনীর দূর্বলতা, ফলে সমাজের কাছে আমাদের কথাগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে অক্ষমতা।

. ইসলামের সুমহান আদর্শ সম্পর্কে ব্যাপক ও সচেতন অধ্যয়নের অভাব, ফলে ইসলামি ভাবাদর্শ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অনুপস্থিতি।

. বাতিল ফিরকাগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অনুপস্থিতি, ফলে তাদের আবেগময় স্লোগানের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে তাদের দলভুক্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা।

বস্তুতঃ এই সমস্যাগুলোর সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি প্রোগ্রাম নিয়ে তৈরি করা হল ছাত্র ঐক্যের আহবান ও কর্মসূচি।

ছাত্রদের চেতনাকে অনুরনিত করেই তাদেরকে এই কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে; শুধু শুধু দল ভারী করার জন্য সদস্য করা নয়। এজন্য আন্ডার গ্রাউন্ডে কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং প্রত্যেক মাদরাসার মেধাবী প্রভাবশালী ছাত্রদেরকে টার্গেট করে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরী করে আলাপ চারিতার মাধ্যমে তার চেতনাকে আমাদের চিন্তার অনুকুলে উদ্দীপিত করার পরই তাকে দলভুক্ত করার নীতি অনুসরণ করে কাজ শুরু হয়। আর কর্মসূচির অনুসারীদেরকে ইনাবত ইলাল্লাহর চেতনায় অনুপ্রাণিত করে বিনয়াবনত, মুতাযাররী ইলাল্লাহ রূপে গড়ে তোলার বিষয়ে অধিক জোর দেওয়া হয়।

আর জাতীয় সমস্যা হিসাবে যে সব বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছিল সেগুলো নিরসনের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগামী দিনের কর্মের ময়দানে সিপাহসালার রূপে কর্মীদেরকে তৈরী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণের প্রোগ্রাম চলতে থাকে।

আমি ও মাওলানা ইসহাক ঘুরে ঘুরে ঢাকার মাদরাসাগুলোর ছাত্রদের মাঝে ঐ চেতনা সম্প্রসারণের কাজ করতে উদ্যমী উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। অন্য সঙ্গীরাও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকল। ফরিদাবাদ মাদরাসাই অঘোষিতভাবে ঐ চেতনার কেন্দ্রভূমি হিসাবে পরিগণিত হতে থাকল। আমাদের নিজেদের আমল আখলাক উন্নয়নের প্রচেষ্টা তার সাথে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির তপস্যা, সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যের চর্চা একই সাথে এগুতে থাকল।

আমি যেহেতু স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে এসেছিলাম, তা ছাড়া ময়মনসিংহ অধ্যয়নকালে কিছু কিছু সাহিত্যের চর্চা করতাম সেজন্য সাথী সঙ্গীদের মাঝে আমার সাহিত্য জ্ঞান কিছুটা অগ্রসরমান ছিল। সে জন্য সাথী সঙ্গীদের অনেকেই আমার কাছে সাহিত্য চর্চা করত। মাওলানা ইসহাকের বাংলা সাহিত্যের হাত ততটা পাকা ছিল না। কিন্তু তার প্রতিভা ছিল অসামান্য। স্মৃতিশক্তিও ছিল খুব প্রখর। চেতনার এই সন্ধিক্ষণে সেও বাংলা সাহিত্যে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে।

এ ব্যাপারে আমার সাথে তার মত বিনিময় হত প্রায়ই। যেখানে তার সমস্যা হত একই ক্লাসের সহপাঠী হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছ থেকে জেনে নিতে মোটেই সংকোচ করতো না। জ্ঞান আহরণের জন্য তাঁর এই অদম্য আগ্রহ ও সংকোচহীনতা আমাকে খুবই অবিভূত করত। অল্প কদিনেই সাহিত্যের ময়দানে সে বেশ অগ্রসর হয়ে গেল যে, এ সময়ের ধর্মীয় বিষয়ে যারা লিখেছেন তাদের মাঝে তাঁর প্রকাশিত ছোট বড় পুস্তকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। এটি তার জন্য সম্ভব হয়েছিল তার একনিষ্ঠ অধ্যাবসায়ের কারণেই।

যে কথা বলছিলাম জাতীয় চেতনা বিকাশে আমাদের যে কর্মতৎপরতা শুরু হয়েছিল তার স্রোত ক্রমে ক্রমে গতিশীল হতে থাকলে আমরা এ কর্মসূচির সুফল লক্ষ করে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়াতাম। কখনো কুমিল্লা, কখনো নোয়াখালী, কখনো চট্টগ্রাম, কখনো পাবনা, কখনো বগুড়া, কখনো রংপুর, কখনো সিলেট সফরের পর সফর চলতে থাকল। ইসহাক, আমি, মুশতাক, আবু সুফিয়ান আরো অনেকে ঘুরে ঘুরে সারা দেশের মাদরাসাগুলোতে চেতনার বহ্নি ছড়িয়ে দিতে থাকলাম। কোথায়ও সাহিত্য মজলিস, কোথায়ও কর্মী প্রশিক্ষণের নামে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছাত্রদের সাথে আমাদের চেতনার বিনিময় হতে থাকল।

সারাদেশে প্রায় ৫০০০ কর্মী আমাদের এই চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হল। জাতীয় চেতনা বিনির্মাণে এ কাজের কথা ছাড়া সহধর্মীনির কথা কোন দিনই তাকে বলতে শুনিনি। আমাদের প্রোগ্রাম ছিল বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করে কোন জেলায় প্রোগ্রাম করার জন্য বের হয়ে যাওয়া। আবার শনিবার এসে যথা সময়ে ক্লাসে হাজির হওয়া। বিবাহিত হিসাবে কোনদিন প্রোগ্রামে না গিয়ে বাড়ী যাওয়ার কথা মুখে আনতেও কোনদিনই তার কাছে শুনিনি। অবিরাম কর্মের চেতনায় অনুপ্রাণিত তার মত অন্য কাউকেই আমি নিরলস পাইনি।

জাতীয় প্রয়োজনে নিজস্ব কাজকে তুচ্ছ মনে করা মাওলানা ইসহাকের স্বভাবজাত বিষয় ছিল। যে কোন কাজের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পন করা হলে তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়ার ব্যাপারে সে খুবই তৎপর ছিল। তাঁর তৎপরতা অনেক সময় আমাদেরকে অলসতা ছেড়ে কাজ করতে উৎসাহিত করেছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিক ময়দানে উলামায়ে কেরামের বিচরণের পথ সহজগম্য ছিল না বিধায় এ সময় চেতনার জগতে এক বিরাট স্থবিরতা চলছিল। এই স্থবিরতা কাটিয়ে উঠার চিন্তা কেবল আমরাই করছিলাম তা নয়। আমাদের মত আরো অনেকেই করছিলেন। ছাত্র ফৌজ নামে একটি সংগঠন মাওলানা আব্দুল মতীন (ঢালকা নগর)-এর নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছিল। তাদের ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিভাবে কাজ করা যায় এ নিয়ে আমি, মাওলানা ইসহাক, মাওলানা আব্দুল মতীন ও তার সহযাত্রীদের সাথে অনেকবার দেন দরবার করেছি।

এ সময় খাদেমুল ইসলাম ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন কওমি পাবলিকেশন্স এর সত্বাধিকারী মাওলানা গোলাম মোস্তফা। সে তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছাত্রদেরকে একই প্লাট ফর্মে একত্রিত করার ভাবনা থেকে তার সাথেও তখন আমাদের পরিচয় হয়। আমরা একত্রে বসার এবং কাজ করার একটি অনুকুল ক্ষেত্র তৈরী করার ভাবনা নিয়ে বহুবার একত্রে বসেছি।

মালিবাগ মাদরাসা তখন সবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হযরত মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ মুহতামিম হিসাবে এখানে এসেছেন। ফরিদাবাদ থেকে আভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে সরে আসা উস্তাদদের মাঝে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদও এখানে যোগদান করেছেন। অন্যান্য আসাতিযায়ে কিরাম ও ছাত্ররা স্বামীবাগে আলহাজ্ব আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের খরিদ করা জমির উপর পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ভাঙ্গা ঘরে যেয়ে আশ্রয় নিলেন।

এ সময় ঘনিষ্ঠতার সুযোগে আসাতিযায়ে কেরাম আমাদের এ সংগঠনটির কথা জেনে গেলেন। মাওলানা ইসহাক সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে খেয়ে না খেয়ে স্বামীবাগে আসাতিযায়ে কিরামের সঙ্গে থেকেছে এবং এরই মাঝে চেতনা বিলানোর কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করে গেছে।

আমি অবশ্য গোলযোগের আভাস পেয়ে মাঝ বৎসরই সিটকে পড়েছিলাম। বৎসরের বাকী অংশ বালিয়া মাদরাসায় কাটিয়ে পরবর্তী বৎসর কাজের তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য চট্টগ্রামে পটিয়া মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হই।

স্বাধীনতা উত্তরকালের স্থবিরতা কাটানোর জন্য আমরা ছাত্ররা যেমন চিন্তা করছিলাম উস্তাদরাও নিরব বসে ছিলেন না। আগামী প্রজন্মের ছাত্রদেরকে কিভাবে চেতনা সমৃদ্ধ করে আদর্শ ছাত্র হিসাবে গড়ে তোলা যায় এ নিয়ে মালিবাগ মাদরাসায় হযরত মাওলানা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ-এর সভাপতিত্বে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের দীর্ঘদিন যাবৎ পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।

এ সকল পরামর্শ সভায় যারা উপস্থিত থাকতেন তাঁদের মাঝে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী, মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, মুফতি গোলাম মোস্তফা, মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ, মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দীকী, মাওলানা ইয়াহ্ইয়া জাহাঙ্গীরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দীর্ঘদিন পরামর্শের পর তারা ছাত্রদের জন্য একটি কর্মসূচি তৈরি করেন এবং লাজনাতুত তালাবা নামে ছাত্রদের মাঝে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন। বস্তুতঃ এ কর্মসূচি প্রনয়নে যারা উদ্যোগী ছিলেন তারা আমাদেরও চেতনার প্রাণপুরুষ ছিলেন। ফলে লাজনাতুত্ তালাবার কর্মসূচি ও আমাদের চেতনার কর্মসূচির তেমন ফারাক থাকেনি।

এ সময় আমি পটিয়ায় ছাত্র ঐক্যের কাজ পূরো উদ্যমের সাথে চালিয়ে যাচ্ছি, হাটহাজারী, নাজির হাট, জিরি মাদরাসায় আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা ইতিমধ্যেই সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। মাওলানা ইসহাক আমার অবর্তমানে ঢাকায় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দু'জনের মাঝে সপ্তাহান্তেই চিঠিপত্রের যোগাযোগ হত। আমার কাজের রিপোর্ট তাকে জানাতাম, সেও কেন্দ্রের কর্মতৎপরতার রিপোর্ট আমাকে জানাত।

সারা দেশেই আমাদের কর্মতৎপরতা ছড়িয়ে পড়েছিল, চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল ক্রমান্বয়ে। আকাবির ও আসলাফের আদর্শের চেতনায় গড়ে উঠা স্বপ্নময় আবেগ আমাদেরকে আন্দোলিত করছিল প্রতিনিয়ত। আমাদের গতি তখন দূর্বার। ছাত্র সমাজের মাঝে নিজেদেরকে চেতনাদ্বীপ্ত করে গড়ে তোলার যে জোয়ার আমরা দেখছিলাম তাতে কাজ ছেড়ে বসে পড়ার কোন পথ আমাদের খোলা ছিল না।

হঠাৎ, একদিন মাওলানা ইসহাকের একটি চিঠি পেলাম। সে লিখেছে" আসাতিযায়ে কিরাম লাজনাতুত্ তালাবা নামে যে কাজের সূচনা করেছেন, তাঁদের ইচ্ছা আমরাও তাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করি। আপনার মতামত ছাড়া এ ব্যাপারে আমি কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারব না বলে তাঁদেরকে জানিয়েছি। অনতিবিলম্বে আমাদের কর্তব্য স্থির করার জন্য মতামত জানাবেন।"

উত্তরে আমি লিখলাম, যে আসাতিযায়ে কিরামের রাহনুমায়ী গ্রহণ করার জন্য আমরা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলাম আজ যদি তাঁরাই রাহনুমায়ী করতে ময়দানে নেমে আসেন তাহলে তাঁদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে বাঁধা কোথায়? আমার বিশ্বাস আসাতিযায়ে কিরামের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং তাঁদের রাহনুমায়ী আমাদের মঞ্জিলে মাকসাদের পথকে ত্বরান্বিত করবে নিঃসন্দেহে। আপনি মতামত জানিয়ে দিন। আমি খুব শীঘ্রই ঢাকায় আসছি। সাক্ষাতে বিস্তারিত আলাপ হবে।

এভাবেই আমরা লাজনাতুত তালাবার সাথে একাত্ম হয়ে কাজ পূর্ণ উদ্যমে শুরু করলাম। সাংগঠনিক তৎপরতা ও প্রশিক্ষণ দু'টোই সমান তালে অগ্রসর হতে থাকল। এবার আর গোপনে নয়। কাজ শুরু হল প্রকাশ্যে। বৎসরের শেষে শা'বানের ২৩, ২৪, ২৫ তারিখে (১৯৮২/৮৩) জামিয়া শারঈয়া মালিবাগে জেলা প্রতিনিধিদের তরবিয়তি ইজতেমা হল বেশ আড়ম্বরের সাথে। সারাদেশ থেকেই জেলা প্রতিনিধিরা বেশ উৎসাহের সাথে শরীক হলেন এই ইজতেমায়।

আসাতিযায়ে কেরাম বিষয় ভিত্তিক গড়পরিলক্ষিত হল। আরবি প্রবাদ আছে সর্বান্বেষী কিছুই পায় না-এ প্রবাদই বোধহয় আমাদের ক্ষেত্রে বাস্তব হয়ে দেখা দিল। সব কাজ ঝিমিয়ে পড়ল। কেন এমন হল তার কারণ উদ্ঘাটনের বৃথা চেষ্টা করে কি আর লাভ? আমি আর মাওলানা ইসহাক সিদ্ধান্ত নিলাম, গবেষণা পরিষদের মাধ্যমে গবেষণার কাজ না হলেও আমাদের বসে থাকার কোন অর্থ হয় না। আমাদের সীমিত জ্ঞান নিয়ে আমরা প্রত্যেকেই নিজে নিজে কিছু গবেষণার কাজ করে যাব।

সে থেকেই লেখালেখির পথে মাওলানা ইসহাক ও আমার যাত্রা। তবে শুধু বই লেখার জন্যই নয়; আগামী দিনে ইসলামি সমাজ বিনির্মানে পথ যাত্রীদের কাজে আসে এমন কিছু লিখা; এটাই ছিল আমাদের লেখার উদ্দেশ্য। আমরা জ্ঞানের সল্পতার জন্য গভীর জ্ঞানের কিছু লিখতে পারিনি হয়ত। তবে আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনের কথা সামনে রেখেই লিখার চেষ্টা করেছি। মাওলানা ইসহাকের লেখা বইগুলো উল্টালে এরসুস্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যাবে।

লেখালেখির ক্ষেত্রে মাওলানার একটা বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, কিছু লিখার জন্য মুড তৈরির প্রয়োজন হত না। বাহির থেকে ছুটে এসেই কলম নিয়ে বসে যেত এবং লিখতে শুরু করত ছাত্র ঐক্য ও লাজনাতুত তালাবার কাজ করতে গিয়ে আমাদের ক্ষুদ্র চোখে একটি বিষয় কাঁটার মত বিধেছিল যে, এদেশে কিছু আলেম হযরত থানবী রাহিমাহুল্লাহর মতাদর্শের অনুসারী, আর কিছু আলেম হযরত মাদানী রাহিমাহুল্লাহর মতাদর্শের অনুসারী। এই দুই শ্রেণীর মাঝে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাজনের সময় যে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল, তার বিষাক্ত রেশ এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

এ দু'দলের বৈশিষ্ট্য এমন যে, দু'দলই হযরত থানবী ও মাদানী রাহিমাহুল্লাহকে নিজেদের আকাবির হিসাবে স্বীকার করেন। কিন্তু একদল আরেক দলের এমন সুক্ষ্ণ সমালোচনা করেন যাতে তার দলের লোকেরা অজ্ঞাতসারেই অপর পক্ষের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন থানবী রাহিমাহুল্লাহর মতাদর্শের কোন আলেমের দরবারে বসলে শুনা যায় যে, তিনি বলেছেন যে, হযরত মাদানী অনেক বড় আল্লাহওয়ালা ছিলেন, তবে কংগ্রেসের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বলে অখন্ড ভারতের প্রবক্তা হয়েছেন। আবার মাদানীভক্ত কোন আলেমের দরবারে বসলে হয়ত শুনা যেত যে, তিনি বলেছেন যে, থানবী অনেক বড় আধ্যাত্বিক ব্যক্তি ছিলেন, তবে সমাজের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেননি বলে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল না বললেই চলে। ফলে তিনি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্বের চক্করে পড়ে গেছেন।

মাওলানা ইসহাক ও আমার ধারণা ছিল সুক্ষ্ণ বিরোধ টুকুই দুষ্ট ক্ষত হয়ে আমাদেরকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাখছে। সুতরাং, জাতীয় বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে এই দূরত্বটুকু কমিয়ে আনা একান্ত প্রয়োজন। জাতীয় চেতনা বিকাশের কর্মসূচি নিয়ে কাজ করার সময় আমরা সুকৌশলে এই দূরত্ব গুছিয়ে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এমনকি যেখানে পাঁচ কল্লি টুপির প্রভাব (যা থানবী অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য) সেখানে কিস্তি টুপি নিয়ে আমরা হাজির হতাম এবং যেখানে কিস্তি টুপির প্রভাব (যা হযরত মাদানীর ভক্তদের বৈশিষ্ট্য) সেখানে পাঁচকল্লি টুপি নিয়ে হাজির হতাম এবং সবার কাছেই সমানভাবে আনাগোনা করতাম।

এই দূরত্ব আমরা কতটা কমাতে পেরেছি তা জানি না, তবে আমাদের হাতে যারা কর্মসূচির দীক্ষা নিয়েছে তাদের অন্তরে উভয় বুযুর্গের আযমত সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্ট করেছি।

এ কারণে থানবী ভক্ত হোক আর মাদানী ভক্ত হোক যে কোন আলেম কোন ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমরা তাতে শরীক থাকতে চেষ্টা করেছি। মাওলানা ইসহাক তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত এই নীতির ওপর অটল ছিল; এ কারণেই উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যেখানেই কোন ভাল কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে মাওলানা ইসহাক তাতে শরীক থাকার চেষ্টা করেছে।

তাই আমার মনে হয় বাংলাদেশে উলামায়ে কেরামের জাতীয় চেতনায় বিগত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তাতে মাওলানা ইসহাকের অবদান অনেক খানি। অসামান্য স্মৃতিধর এই কর্মতৎপর ব্যক্তিটি এভাবে অকালে ঝরে যাবে তা আমরা কেউই কল্পনা করিনি।

মৃত্যুর সপ্তাহ দশদিন পূর্বে তার সাথে আমার একটি একান্ত বৈঠক হয়েছিল। সে বৈঠকে তাঁর বক্তব্য ছিল, মাওলানা যে ফুল ফুটিয়ে গেলাম তা দ্বারা মালা গাঁথার বড় শখ হয়। আসাতিযায়ে কিরামের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে বয়সতো পার করে দিলাম।

আচ্ছা! আপনি আমি মিলে সেই ছাত্র জীবনের মত যদি মাঠে নামি তাহলে কি আমরা পারি না একটি চেতনার মিছিল তৈরি করতে? আমি বলেছিলাম হয়ত পারি। কিন্তু সেরূপ শ্রম দেওয়ার জন্য কি আপনি আমি প্রস্তুত হতে পারব? ইসহাক বলেছিল, মাওলানা চলুন এ জাতির উত্তরণের জন্য আমরা দু'জনে মিলে শেষ চেষ্টায় অবতীর্ণ হই। আমি বলেছিলাম, আমি সম্মত তবে জীবন বাজী রেখে নামতে হবে।

ইসহাক বলেছিল আমিও প্রস্তুত। জীবন কয়দিনের। জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নের কাজে যদি এ জীবন ক্ষয়ে যায় তবুও ইতিহাস আমাদেরকে স্মরণ করবে কিন্তু কোন পদক্ষেপ না নিয়ে মারা গেলে আল্লাহও আমাদেরকে ক্ষমা করবেন না। কিন্তু আমি কি জানতাম ক'দিন পরেই সে থাকবে না। সত্যিই জাতীয় উন্নয়নের ফিকির নিয়ে ভাবা ও সর্বক্ষণ সেই চেতনায় উম্মাতাল থাকার মত আরেকজন ইসহাক কি আমার বন্ধু হয়ে আসবে?

-লেখাটি আল্লামা ইসহাক ফরিদী রহ. স্মারক গ্রন্থ থেকে নেওয়া

এনএ/