ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসি দুর্ঘটনা নাকি হত্যার শিকার?
প্রকাশ: ২০ মে, ২০২৪, ০৯:৩১ রাত
নিউজ ডেস্ক

সাকলাইন আবির :

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেছেন। সোমবার (২০ মে) দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর আগে গতকাল থেকে রাইসিকে বহনকারী ওই হেলিকপ্টারটি নিখোঁজ ছিল। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানও দুর্ঘটনায় নিহত হন।

দুর্ঘটনাটি এমন একটি সময়ে ঘটলো যখন ইসলায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। ইসরায়েলের পরম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে ইরানের চরম বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে এটাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে নিতে পারছেন না বিশ্লেষকরা। আবার অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে হত্যা করা হতে পারে বলেও অনেকে ধারণা করছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়ে থাকতে পরে। তবে এটি নিছক দুর্ঘটনা হলেও, ইরানিরা তা ভাবতে পারছে না। কারণ, তারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসে অভ্যস্ত।  

সন্দেহের তীর ইসলায়েলের দিকে 

গত ২ এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাস ভবনে হামলা করে ইসরায়েল। এতে ইরানের কমান্ডারসহ সাত কর্মকর্তা নিহত হন। নিহতদের মধ্যে এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার সহযোগী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রহিমিও ছিলেন। এ হামলার প্রতিশোধ নিতে ১৪ এপ্রিল ইসরায়েলে পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এর পর ফের ইরানে হামলার হুমকি দেয় ইসরায়েল। এর কয়েকদিন পর ইরানের একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইসরায়েল।  দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েল প্রথম প্রকাশ্য সামরিক সংঘর্ষের পরই হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হলো।  

ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান ও ইসরায়েলের ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরায়েলের একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরবর্তীতে ইসরায়েলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনায় সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা বিবেচনায় এই তত্ত্বটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে।

তবে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বলছে, অতীতে কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার অভিযোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নেই। রাইসির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হামলা চালিয়ে ইসরায়েল হত্যা করবে এমনটা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে উপযুক্ত মনে হয়নি।  

রয়টার্সের বরাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েলের নাম প্রকাশ না করা এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, রাইসির এ ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো যোগসূত্র নেই।

বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। ইরানের পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দেশটির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তহত্যার শিকার হন ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। গাজা যুদ্ধের পর ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার পর ইরানবিরোধী আরও শক্ত অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রও সন্দেহের বাইরে নয়। তাছাড়া রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।

আলজাজিরার প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ওই হেলিকপ্টারটি বেল-২১২ মডেলের ছিল। এদিকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাইসি ও আব্দুল্লাহিয়ান বেল-২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টারে ছিলেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা একটি হেলিকপ্টার। মাঝারি আকারের হেলিকপ্টারটিতে পাইলটসহ ১৫ জন বসা যায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনা-এর বরাতে এ খবর দিয়েছে রয়টার্স। যদিও ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের কাছে এমন কোনো হেলিকপ্টার যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি করিনি বলে দাবি করা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই কি খুন হলেন রাইসি? 

ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুতে দেশটির মধ্যে চলমান অভ্যন্তরীণ কোন্দলই বেশি প্রকাশ্যে আসছে। মূলত ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মৃত্যুর পর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জায়গা নেওয়ার পথে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। এদিকে, খামেনির ছেলে মোজতবাও আবার আছেন এই দৌড়ে। কিন্তু রাইসি বেঁচে থাকতে তা হওয়া সম্ভব ছিল না। একে তো রাইসি দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী রেভল্যুশনারি গার্ডের পছন্দের মানুষ। তার ওপর তিনি ছিলেন প্রসিকিউটর জেনারেল। তলের খবর কমবেশি সবই জানা ছিল তার।

এখনো ৮৫ বছর বয়সী বাবা খামেনির আশ্রয়স্থলে থাকেন মোজতবা। কিন্তু খামেনি অসুস্থ হওয়ায় বেশি দিন তা অব্যাহত থাকবে না। ফলে রাইসি বড় বিপদ হয়ে ওঠার কথা মোজতবার জন্য। রাইসির মৃত্যুতে তাই সবচেয়ে বেশি সুবিধা হওয়ার কথা মোজতবার। কার্যত, রাইসির মৃত্যুর ফলে বাবা খামেনির উত্তরসূরি হতে মোজতবার পথে আর বাধাই রইলো না।

হাআমা/