জুমার নামাজের ইতিহাস ও গুরুত্ব
প্রকাশ:
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ০৯:২৮ সকাল
নিউজ ডেস্ক |
জুমা ইসলামের অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ঐতিহাসিকভাবে এ দিনের অসংখ্য ফজিলত রয়েছে। তবে এটি মুমিন মুসলমানের জন্য সপ্তাহিক ইবাদতের হিসেবে নির্ধারিত। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, কীভাবে জুমার প্রচলন শুরু হয়? আরবি শব্দ ‘জুমুআ’-এর অর্থ হলো একত্রিত হওয়া। আর তাহলো ইয়াওমুল জুমআ বা শুক্রবার। আল্লাহর দুনিয়ায় সপ্তাহের সেরা দিন ইয়াওমুল জুমআ। তিনি জগৎ সৃষ্টির পরিপূর্ণতা দান করেছেন এ দিনে। জুমার দিনকে মুমিনের ঈদ ও গরিবের হজের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ দিনে মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর নির্দেশ পালনে ইবাদত উপলক্ষে মসজিদে একত্রিত হয় বলে দিনটিকে ইয়াওমুল জুমাআ বা জুমার দিন বলা হয়। কুরআনেও সে কথাটি ওঠে এসেছে- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দ্রুত মসজিদের দিকে ধাবিত হও। আর বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝতে পার।’ (সুরা জুমআ : আয়ত ৯) হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এক বর্ণনায় বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো এক জুমার দিনে বললেন- যেভাবে শুরু হয় জুমা জুমার সূচনা ও ফরজ হয় প্রথম হিজরি থেকে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র নগরী মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনার কুবায় গিয়ে অবস্থান করেন। সেখান থেকে জুমার দিন মদিনায় যাওয়ার পথে বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছলে জোহরের সময় হয়ে যায়। তিনি সেখানেই জুমা আদায় করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম জুমা। তবে হিজরতের পর জুম্র নামাজ ফরজ হওয়ার আগে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের ১২তম বর্ষে মদিনায় নাকিউল খাজিমাতে ২ রাকাআত জুমা পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে হজরত আসআদ বিন জুরারাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইমামতিতে শুক্রবার সে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আর সেটি ছিল নফল নামাজ। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইবনে সিরীন থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমনের পর এবং জুমআর নামাজ ফরজ হওয়ার আগে একবার মদিনার আনসারগণ একত্রিত হয়ে আলোচনা করলেন যে, ইয়াহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটা দিন নির্দিষ্ট আছে, যে দিনে তারা সকলে একত্র হয়। আর নাসারাদেরও সপ্তাহে সবার একত্রিত হওয়ার জন্য একদিন নির্ধারিত আছে। সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটা দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যে দিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, নামাজ আদায় করব। অতপর তারা আলোচনাকালে বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রোববার নাসাদের জন্য নির্ধারিত। অবশেষে তাঁরা ‘ইয়াওমুল আরুবা’ (শুক্রবার)-কে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এদিনকে ‘জুমআর দিন’ নামকরণ করলেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, সীরাতুল মুস্তাফা, তিরমিজি) তবে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুবা নামক স্থান থেকে মদিনায় পৌঁছার পথে বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় সবাইকে নিয়ে যে জুমা আদায় করেন। এটিকে ইসলামের প্রথম জুমা ধরা হয়। আর সেদিন থেকেই মুমিন মুসলমানদের জুমা আদায় শুরু হয়। জুমা পড়ার নির্দেশ হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ফরজ ইবাদত হিসেবে জুমা পড়ার নির্দেশ আসে পবিত্র নগরী মক্কায়। কিন্তু সে সময় পরিস্থিতির কারণে জুমা আদায় করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ সম্পর্কিত একাধিক তথ্য ও বর্ণনা হাদিসে পাকে এভাবে ওঠে এসেছে- অতএব প্রথম দিকে হিজরতকারীদের নেতা হজরত মুসআব ইবনে উমায়ের ১২ জন লোক নিয়ে মদিনায় প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। (তাবারানি, দারাকুতনি) - হজরত কাব ইবনে মালেক ও ইবনে সিরিনের বর্ণনা মতে, তারও আগে আনসারগণ নিজ থেকেই (বিশ্বনবির মদিনার পৌছার আগে) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তারা সবাই মিলে সপ্তাহে একদিন সামষ্টিক ইবাদাত করবেন। এ উদ্দেশ্যে তারা ইয়াহুদিদের শনিবার ও খ্রিস্টানদের রোববার বাদ দিয়ে জুমার দিনকে মনোনীত করেছিলেন এবং বনি বায়দা অঞ্চলে হজরত আসআদ ইবনে জুরারাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রথম জুমা পড়েছিলেন। এতে ৪০ জন ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিলেন।(মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকি) এ থেকে জানায় ইসলামি জনতার আবেগ অনুভূতি তখন এমন একটি সাপ্তাহিক ইবাদাত-বন্দেগির দিন থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করেছিল। উপরন্তু বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করার পর সর্বপ্রথম যে কাজগুলো করেন, জুমা প্রতিষ্ঠা ছিল তার অন্যতম। বিশ্বনবি মক্কা থেকে হিজরত করে সোমবার দিন কুবায় উপনীত হন। সেখানে ৪ দিন অবস্থান পর পঞ্চম দিন ‘ইয়াওমুল জুমআ’ তথা জুমার দিনে সেখান থেকে মদিনার দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে বনি সালেম ইবনে আওফের এলাকায় জুমআর নামাজের সময় হয়। সেখানেই তিনি প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। (ইবনে হিশাম) জুমার গুরুত্ব শুক্রবার জোহরের পরিবর্তে জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমার দুই রাকাআত ফরজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাআত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। সপ্তাহের এদিনে জুমার খতিব তা বক্তেব্যে উম্মতের যাবতীয় প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের আলোকে নির্দেশনা ও সমাধানমূলক উপদেশ দেবেন। হাদিসে এসেছে- - হজরত তারেক ইবনে শিহাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইলি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ক্রীতদাস, নারী, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি এই ৪ প্রকার মানুষ ছাড়া সব মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামায়াতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য (ফরজ)।’ (আবু দাউদ, মুসতাদরেকে হাকেম) - হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দফতরে লেখা হবে; যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না।’ (তাফসিরে মাজহারি) - হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার নামাজ না পড়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাজ পড়ানোর আদেশ করি, সে মানুষকে নামাজ পড়াক। অতপর যে সব ব্যক্তি জুমার নামাজ পড়ে না, আমি তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিই।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা) সুতরাং জুমা হলো মুমিন মুসলমানের জন্য বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। যা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে আনুষ্ঠানিকভাবে বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় আদায়ের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। আজও মুমিন মুসলমানের জন্য তা বিশেষ ইবাদত হিসেবে জারি রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিনের এ ফরজ নামাজ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন। এনএ/ |