কওমি মাদরাসায় পড়ে কিভাবে বিসিএস ক্যাডার হয়ে ওঠলেন মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন
প্রকাশ:
২০ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৭:৩২ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
|| হাসান আল মাহমুদ || ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে (সমাজকল্যাণ) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন কওমি মাদরাসা পড়ুয়া মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন। ২০১৩ সালে তিনি দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত শেখ জনুরুদ্দীন র. দারুল কোরআন চৌধুরীপাড়া মাদরাসা থেকে। পরে ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত জামিআতুল আসআদ আল ইসলামিয়া থেকে তাখাস্সুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা সম্পন্ন করেন। কওমি মাদরাসা পড়ুয়া মেধাবী এই রিয়াজ উদ্দিন এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের হানগড়া গ্রামে। তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষায় ১৬ তম হয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করেন। এছাড়া, শরহে বেকায়া জামাতে (উচ্চ মাধ্যমিক) সারাদেশে ৪র্থ এবং মিশকাত-ফজিলতে (স্নাতক) শ্রেণিতে সারা দেশে ২২তম বোর্ড স্ট্যান্ড অর্জন করেন। কওমি মাদরাসা পড়ার পাশাপাশি তিনি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের পাটোয়ার ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং আলিমে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত হয়েছেন। এরপর জেনারেল ধারায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। আরও পড়ুন: পুলিশ সদস্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কওমি পড়ুয়া মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম কওমি মাদরাসায় পড়ে কিভাবে এ স্বপ্নের শুরু, এগিয়ে চলা এবং বাস্তবায়ন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন জানান, ‘আমি মূলত আধুনিক সিলেবাসের কওমি মাদরাসায় পড়েছি। ঢাকার ডেমরায় অবস্থিত বাইতুন নুর মাদসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষার সকল বিষয়ও পড়েছি। প্রত্যেক শ্রেণির অংক, ইংরেজি, বাংলা ও বিজ্ঞান নিয়মিত পড়ানো হতো আমাদের। নাহবেমীর-হিদায়াতুন্নাহু জামাতে থাকতেই আমরা আরবি-ইংরেজি উভয় ভাষাতেই খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করেছিলাম। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিলো, কওমি মাদরাসা ও জেনারেল শিক্ষার উভয় লাইনেই সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার। তিনি জানান, ‘শরহে বেকায়াতে পড়াকালীন আমি দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। এরপর ইফতা পড়ার সময় আলিম পরীক্ষা সম্পন্ন করি। তারপর ২০১৫ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণে ভর্তি হই এবং পাঁচ বছর পড়ালেখার পর প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করি। তারপর বিসিএসের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করি। গণিত, ইংরেজির বেসিক ফাউন্ডেশন আমার আগে থেকেই ভালো ছিল। এছাড়া, ২০২০ সাল করোনার সময় গৃহবন্দি থাকাকালে প্রিলিমিনারির জন্য ভালোমতো প্রস্তুতি নিই। নিয়মিত লাইভ এমসিকিউতে পরীক্ষা দিতাম। গাইড বইয়ের পাশাপাশি বোর্ড বই ও ডাইজেস্ট পড়েছি।’ তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ১৯ মার্চ প্রিলি হলো। পাস করার ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলাম। তবে প্রিলি পাসের পর রিটেন প্রস্তুতির জন্য মাত্র তিন মাস সময় পেলাম। রিটেন প্রস্তুতির জন্য আমি একটি কোচিংয়ে নিয়মিত এক্সাম ব্যাচে পরীক্ষা দিতাম। বেসিক নলেজ ভালো থাকায় রিটেন আমার সব সময়ই স্ট্রং জোন। প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। কিন্তু পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। অসুস্থতা নিয়েই পরীক্ষা দিই। এরমধ্যে ইংরেজি ও বাংলা খুবই ভালো দিয়েছিলাম। নিয়মিত ইংরেজি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকায় ইংরেজি বরাবরই আমার শক্তির জায়গা। বাকি পরীক্ষাও খারাপ হয়নি।’ তিনি জানান, ‘কওমি মাদরাসায় পড়া অবস্থা থেকেই আমার ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং, উপস্থাপনা, খাতা সাজানো ভালো ছিল। কোনো প্রশ্নের উত্তর ছেড়ে আসিনি। শিক্ষা ক্যাডারের ২০০ মার্কসের পরীক্ষার আগে এক মাস সময় পেয়েছিলাম। এই সময়ে আমি সিরিয়াস পড়াশোনা করেছি। ফলস্বরূপ পরীক্ষাটা হয়েছিল অসাধারণ। আল্লাহ পাকের রহমতে আমার ভাইভাটাও আউটস্ট্যান্ডিং ছিল। আমি বরাবরই ভাইভা ফেস করতে উপভোগ করি। ভাইভা বোর্ডে আমি ইতিবাচক ও আত্মবিশ্বাসী থাকার চেষ্টা করেছি। কোনো জড়তা কাজ করেনি। বোর্ড মেম্বাররা খুব স্যাটিসফাইড ছিলেন। আমার ক্যাডার হওয়ার পেছনে ভাইভার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার পর এটি আমার প্রথম বিসিএস ছিল। আমি শুধু টেকনিক্যাল বা পেশাগত ক্যাডারের প্রার্থী। তাই বলতে পারেন, শুধু শিক্ষা ক্যাডার পাওয়ার জন্যই আমি লড়াই করেছি। আমার বাবা, দাদা, নানা সবাই শিক্ষক ছিলেন। তাই শিক্ষকতার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ আছে। রিটেন এবং ভাইভার পর আমি আশাবাদী ছিলাম। মহান আল্লাহ আমাকে হতাশ করেননি। রেজাল্ট শিটে আমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা দেখার পর অনেক আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ আরও পড়ুন: তথ্য প্রযুক্তিতে এখনো পিছিয়ে বাংলাদেশের ফতোয়া বিভাগগুলো! কওমি নক্ষত্র মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অধীন একটি প্রাইমারী স্কুলের হেড-মাস্টার হিসাবে কর্মরত। এছাড়া, তিনি দৈনিক প্রথম আলোতে কন্ট্রিবিউটর হিসাবে লেখালেখি করছেন এবং বিসিএস, শিক্ষক নিবন্ধন ও অন্যান্য চাকরি পরীক্ষার প্রস্ততি সংক্রান্ত প্রযোজনীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক ফিচার লিখছেন প্রথম আলো, আজকের পত্রিকাসহ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন মিডিয়ায়। প্রতীক্ষায় আছেন আরো ভালো কিছুর সুসংবাদের। শিগগির সেই সুসংবাদ পাবেন বলে জানান তিনি। এজন্য, তিনি দোয়া চেয়েছেন সবার কাছে। এসময় তাঁর কাছে কওমি শিক্ষার্থী যারা এ স্বপ্ন লালন করে তাদের জন্য পরামর্শ কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে কওমি মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থী জেনারেল শিক্ষা অর্জনের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। এটিকে আমি খুব ইতিবাচকভাবে দেখি। বাংলা, ইংরেজিসহ অন্যান্য জেনারেল শিক্ষার দক্ষতা দ্বীনের দাওয়াত ও প্রসারের কাজে অনেক সহায়ক হবে। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বায়নের জ্ঞান কওমি শিক্ষার্থীদেরকে আরো পরিপক্ব ও সচেতন করে তুলবে।’ তিনি বলেন, ‘যারা কওমি মাদরাসায় পড়ছেন তাদেরকে বলবো, নিয়মিত পত্রিকা পড়া, প্রথিতযশা লেখক-সাহিত্যিকদের ভালো সাহিত্যকর্ম পড়া, বক্তৃতা-বিতর্ক ও পাবলিক স্পিকিং দক্ষতা বাড়ানো এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। ধর্মীয় শিক্ষায় পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষার দক্ষতা অর্জিত হলে আপনাকে আটকে রাখার ক্ষমতা পৃথিবীর কারো নেই। সেক্ষেত্রে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা অর্জন আপনার জন্য খুব সহজতর হবে, ইনশাআল্লাহ।’ এনএ/ |