মাদরাসা সংকটে পড়লে সমাধানের দায়িত্ব কার? কে এগিয়ে আসবে?
প্রকাশ:
০৩ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৮:৫০ রাত
নিউজ ডেস্ক |
|| কাউসার লাবীব || ইসলামের কেন্দ্র মনে করা হয় দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে। বিশেষ করে দেওবন্দি ধারার মাদ্রাসাগুলো। যুগ যুগ ধরে এদেশে দ্বীন-ইসলাম প্রচার-প্রসারে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। দেওবন্দের আট মূলনীতিকে সামনে রেখে অনেকটা নিজস্ব কারিকুলাম ও নীতিমালায় চলে দেশের প্রায় সব কওমি মাদরাসা। আমল-আখলাক, তা’লিম-তারবিয়ত ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে বরাবরই অনন্য এসব প্রতিষ্ঠান। বরাবরই মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা উত্তম আদব- আখলাকের পরিচয় দিয়ে আসছে। তবে কখনো কখনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রিন্সিপাল বা কমিটি কেন্দ্রীক অপ্রত্যাশিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় সংকট। তৈরি হয় অযাচিত পরিস্থিতি। সংকটময় এসব পরিস্থিতি মাদরাসাগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? কীভাবে কাটিয়ে উঠবে? এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম দেশের তিন শিক্ষাবিদ আলেদের কাছে। প্রচলিত নিয়মেই সংকটময় সময় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব- রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় অবস্থিত জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া ঢাকার প্রধান মুফতি ও গবেষক আলেম মুফতি হিফজুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠান চললে সেখানে নানা সময়ে সংকট দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক। সংকটগুলো হতে পারে শিক্ষার্থী কেন্দ্রীক, শিক্ষক কেন্দ্রীক বা পরিচালনা কেন্দ্রীক। এসব সমাধানের জন্যই কিন্তু প্রায় সব মাদরাসার বিভিন্ন স্তরের কমিটি বা মজলিস রয়েছে। যেমন, মজলিসে ইলমি, মজলিসে আম, মজলিসে শুরা। তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী বা একাধিক শিক্ষার্থীকে নিয়ে যদি কোনো সংকট তৈরি হয় তাহলে সেটা মজলিসে ইলমি নিয়ন্ত্রণ করবে। শিক্ষকদের নিয়ে যদি কোনো অস্থিরতা তৈরি হয় তাহলে মজলিসে আম সিদ্ধান্ত নেবে। তাছাড়া পরিচালক, মুহতামিম বা পরিচালনা ব্যবস্থা নিয়ে যদি কোনো সংকট তৈরি হয় তাহলে সেটা দেখভাল করবে মজলিসে শুরা। আমার মনে হয়, প্রচলিত নিয়মেই সংকটময় সময় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ‘সর্বশেষ মজলিসে শুরা বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে বোর্ডগুলো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে কী না?’ জানতে চাইলে এই শিক্ষাবিদ আলেম বলেন, আমি তো কোনো বোর্ডের সঙ্গে জড়িত নই, তাই আমি জানিনা এমন পরিস্থিতিতে বোর্ডগুলো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে কী না। তবে আমার মনে হয় সরাসরি না হলেও মৌনভাবে বোর্ডের দায়িত্বশীলরা এসব বিষয় সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন।
প্রাতিষ্ঠানিক সংকট বা অস্থিরতা বাইরে না এনে মজলিসে শুরার মাধ্যমে সমাধান করাই যথোপযুক্ত- রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও তাফসীর বিভাগের মুশরিফ মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন বলেন, প্রতিটি মাদরাসারই নিজস্ব মজলিসে শুরা থাকে। আমার মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সংকট বা অস্থিরতা বাইরে না এনে মজলিসে শুরার মাধ্যমে সমাধান করাই যথোপযুক্ত। আর যদি ‘মজলিসে শুরা’সহ পুরো প্রতিষ্ঠানেই সংকট তৈরি হয়। এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষের কথা মানতে না চায়, তখন দাম্পত্য বিবাদ নিরসনে আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটার ওপর আমল করা যেতে পারে। দাম্পত্য জীবনের সংকট সমাধানের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন- وَاِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَيۡنِهِمَا فَابۡعَثُوۡا حَكَمًا مِّنۡ اَهۡلِهٖ وَحَكَمًا مِّنۡ اَهۡلِهَا ۚ اِنۡ يُّرِيۡدَاۤ اِصۡلَاحًا يُّوَفِّـقِ اللّٰهُ بَيۡنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِيۡمًا خَبِيۡرًا ٣٥ অর্থাৎ, ‘যদি তোমরা তাদের মধ্যে অনৈক্যের আশংকা কর, তবে স্বামীর আত্মীয়-স্বজন হতে একজন এবং স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন হতে একজন সালিস নিযুক্ত কর। যদি উভয়ে মীমাংসা করিয়ে দেয়ার ইচ্ছে করে, তবে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন, সকল কিছুর খবর রাখেন।’ -সুরা নিসা : ৩৫ এই আয়াতের ওপর দৃষ্টি রেখে সংকট তৈরি হওয়া উভয় পক্ষ থেকে অভিভাবক তুল্যদের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করতে হবে। সংকটকালীন সময়ে বোর্ডগুলো উদ্যোগ নিলে এটি আরো সহজে সমাধান হবে কী না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর সবচেয়ে বড় অথরিটি হলো আল হাইয়াতুল উলিয়া। এখন হাইয়াতুল উলিয়ার তো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া বাহ্যত আর কোনো দায়িত্ব নেই। তাছাড়া বেফাকসহ আরো যে বোর্ডগুলো আছে তারা উদ্যোগ নিলেও সহজে বিষয়টির সমাধান হবে এমনটি নয়। সংকটকালীন সময়ে কোনো পক্ষই সহজে কারো কথা শুনতে চায় না। তাছাড়া আমাদের বোর্ডগুলোর কিন্তু পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া অন্যকোনো তেমন কর্তৃত্ব নেই মাদরাসাগুলোর ওপর। তাই সংকটকালীন সময়ে তারা এগিয়ে এলে প্রতিষ্ঠানগুলো এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে কীনা সেটাও কিন্তু ভাবার বিষয়। ‘আসলে সব বিষয়ে বোর্ড এগিয়ে এলেই সমাধান হবে বিষয়টি তেমন নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় সমাধানের জন্য মজলিসে শুরা ও সংশ্লিষ্ট মুরব্বিদের উদ্যোগ বেশি কার্যকর বলে আমার ধারনা।’ -বলেন, এই শিক্ষাবিদ আলেম
অস্থিরতা তৈরি হওয়ার বড় একটি কারণ, কওমি মাদরাসার উস্তাদদের অবসরের কোনো বয়সসীমা না থাকা- ঢাকার মাদ্রাসা দারুর রাশাদ মিরপুরের শিক্ষা সচিব ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা লিয়াকত আলীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাদরাসায় কোনো অস্থিরতা তৈরি হলে সেটা শিক্ষকদের মাধ্যমে সহজেই সমাধান সম্ভব। এবং এটি হয়েও থাকে। তবে মাদরাসাগুলো সংকটে পড়ে শিক্ষক বা মুহতামিম নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হলে। তখন এর সমাধান করা বেশ কঠিন হয়ে যায়। তার মতে, শিক্ষক বা মুহতামিম নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হয় এর বড় একটি কারণ কওমি মাদরাসার উস্তাদদের অবসরের কোনো বয়সসীমা না থাকার কারণে। অবসর কত বছর বয়সে হবে? অবসরকালীন আর্থিক সুবিধা কেমন হওয়া প্রয়োজন? এগুলো ভিন্ন আলোচনা। যখন অবসরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা উঠবে তখন নানা প্রস্তাব আসবে। তবে অবসরের বিষয়টি প্রথমে সামনে আসা উচিৎ। ‘দেশের প্রায় সব কওমি মাদরাসাই কোনো না কোনো বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু মাদরাসাগুলোতে অস্থিরতা বা সংকট তৈরি হলে বোর্ডের দায়িত্বশীলদের তেমন কোনো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। এর কারণ কী? বোর্ডগুলো উদ্যোগী হলে কি এসব পরিস্থিতি আরো সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?’ এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে ‘মাদরাসা সংকটে পড়লে কারা এগিয়ে আসবে’ বিষয়টি খুব জটিল একটি বিষয়। অল্প কথায় এটির সমাধানমূলক কিছু বলা কঠিন। স্বতন্ত্রভাবে যদি কখনো দীর্ঘ সময় নিয়ে যদি বলার সুযোগ হয়, তাহলে বলবো কখনো। তবে বোর্ডগুলো তো অবশ্যই এ বিষয়ে আরো উদ্যোগী হতে পারে। তারা তাদের নীতিমালায় সংযোজন-বিয়োজন করে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারে। কেএল/ |