চরমোনাই তরিকার তিন মুরব্বি: যাদের মাধ্যমে আলোর পথে লাখো মানুষ
প্রকাশ:
২৪ নভেম্বর, ২০২৩, ০৫:৩৫ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
|| কাউসার লাবীব || বাংলাদেশে মুসলমানদের মাঝে দ্বীনি চেতনাকে শানিত করতে, ইসলামের শুদ্ধ চর্চাকে ব্যাপক করতে এবং আল্লাহ রাসুলের আদর্শকে সমাজে বাস্তবায়ন করতে যেসব মতাদর্শ বা তরিকা কাজ করছে এর মধ্যে অন্যতম ‘চরমোনাই তরিকা’। সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. ঊনবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে এই তরিকার পথচলা শুরু। হাজি ইমদাদউল্লাহ মুহাজির মাক্কির খলিফা ছিলেন মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গোহি। তার খলিফা ছিলেন কারী ইবরাহিম উজানী। তার থেকে খেলাফত লাভ করে সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক নিজ এলাকা চরমোনাইয়ে আধ্যাত্মিক খেদমত শুরু করেন। তার থেকেই বাংলাদেশে চরমোনাই আধ্যাত্মিক ধারার প্রসার ঘটে। তার হাত ধরেই শুরু হয় বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জমায়েত চরমোনাইয়ের বার্ষিক মাহফিলের। চরমোনাই অনুসারীদের মাঝে ‘দাদা হুজুর’ নামে তিনি পরবর্তীতে খ্যাতি লাভ করেন। মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক ১৯১৫ সালে বরিশাল শহরের কীর্তনখোলা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত পশুরীকাঠি গ্রামে পিতা সৈয়দ আমজাদ আলীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরআন-হাদীসের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তার চাচা মামা মাওলানা সৈয়দ আহসানুল্লাহর কাছে, যার নামানুসারে চরমোনাইয়ের অপর নাম আহসানাবাদ রাখা হয়েছে। এরপর তিনি উজানীর ক্বারী মুহাম্মদ ইবরাহীম রহ. এর কাছে ক্বিরআত-সহ কুরআন শরীফ শিক্ষা লাভ করেন। তার কাছে সাত ক্বিরআত সমাপ্ত করে তিনি ভোলা দারুল হাদীস আলিয়া মাদরাসা থেকে জামাআতে উলা পাশ করেন। অতঃপর তিনি ভারতের বিখ্যাত ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। মাওলানা ইসহাক বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ছিলেন। তিনি স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ও ক্যাপ্টেন আবদুল লতীফ এবং আরও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা তার কাছে আসতেন, কথা বলতেন, পরামর্শ ও যুদ্ধে সাফল্য লাভের জন্যে দুআ নিতেন। মাওলানা সৈয়দ ইসহাক রহ. রচিত ২৭টি গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়। গ্রন্থগুলো মানুষের হেদায়েতের জন্য বেশ ভূমিকা রাখলেও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা এসব বইয়ের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আপত্তি তুলে থাকেন। লাখো মানুষের আত্মাধ্যিক এই রাহবার ১৯৭৭ সালে ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। তাকে চরমোনাই ময়দানের এক পাশে দাফন করা হয়। মাওলানা ফজলুল করীম রহ.- মাওলানা সৈয়দ ইসহাকের মৃত্যুর পর চরমোনাই তরিকার হাল ধরেন আরেক কাল বিজয়ী রাহবার মাওলানা ফজলুল করীম রহ.। তার হাত ধরে চরমোনাই তরিকার সুনাম দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। চরমোনাইয়ের মাহফিল রূপ নেয় গণজমায়েতে। ক্ষণজন্মা এই আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক ১৯৩৫ সালে বরিশালের চরমোনাই গ্রামের বিখ্যাত পীর পরিবারে মাওলানা সৈয়দ এছহাক ও রাবেয়া খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বুজুর্গ পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে এবং দ্বীনী পরিবেশে তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। এরপর ৫ বছর বয়সে তিনি নিজ গ্রাম চরমোনাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর ১৯৪৫ সালে পিতার প্রতিষ্ঠিত চরমোনাই আহসানাবাদ রশীদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ফাযিল পাস করেন। অতঃপর ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকার লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় ভর্তি হন। লালবাগ মাদ্রাসায় দু’বছর অধ্যায়ন করে ১৯৫৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ১৯৫৮ সালে চরমোনাই জামিয়া রশীদিয়ায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি নিজ পিতার কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। ১৯৭7 সালে পিতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাকের মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির আমীরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জীর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সহ সভাপতি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ তিনি ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠা করেন। সফল রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের বেলা শেষে তিনি ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন। মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম- উপমহাদেশের গণমানুষের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক রাহবার মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীমের ইন্তেকালের পর বর্তমানে চরমোনাই তরিকার হাল ধরেছেন তার সুযোগ্য উত্তরসুরী ও সাহেবজাদা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। মুফতি রেজাউল করীম ১৯৭১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার কীর্তনখোলা নদীর তীরে চরমোনাই গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা চরমোনাই আলিয়াতেই শুরু হয়। কিন্তু তিনি আলিয়ার ছাত্র হলেও প্রায়ই কওমিয়াতেই ক্লাস করতেন। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসাতেও তিনি কিছুকাল লেখাপড়া করেন। অবশেষে ১৯৯১ সালে চরমোনাই আলিয়া থেকে কামিল হাদীস ও বরিশাল সাগরদী আলিয়া থেকে ইফতাসম্পন্ন করেন। লেখাপড়ার পাঠ শেষে তিনি চরমোনাই আলিয়ার খন্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। পরে দীর্ঘদিন যাবত আলিয়া কাওমীয়া উভয় শাখার নাযেমে আ’লারদায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি উভয় শাখার পৃষ্ঠ পোষক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। এসবের পাশাপাশি পীরসাহেব চরমোনাই খ্যাত মুফতি রেজাউল করীম দীর্ঘদিন যাবত চরমোনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। অত্যন্ত কৃতিত্ব ও সফলতার সাথে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার পিতা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. থেকে ১৯৯৪ সালে খেলাফত প্রাপ্ত হন। ঐ বৎসর চরমোনাইয়ের বাৎসরিক মাহফিলে এর ঘোষনা হয়। এরপর ২০১৩ সালে বুজুর্গ আলেম, থানভী সিলসিলার অন্যতম খলিফা মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান তাকে প্রধান খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর তার পিতা সৈয়দ মুহাঃ ফজলুল করীমের ইন্তেকালের পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশএর প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সর্ব সম্মতিক্রমে তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীরও আমীরুল মুজাহিদীনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। অদ্যবধি তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে উভয় সংগঠনকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি পিতার আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে ইতোমধ্যেই তরিকাকে ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষ ও আলেমদের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেএল/ |