আনন্দ-বেদনার মধুময় স্মৃতি
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট, ২০২৩, ১১:৪৩ রাত
নিউজ ডেস্ক

|| জিয়া হক ||

মাওলানা আবদুল হাকিম শিকদার। আমার পরম শ্রদ্ধেয় শ্বশুর। গত ২৩ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। এর আগে প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন ১৫ দিনের মতো। শেষের দিকে ১৬ আগস্ট মধ্যরাতে তিনি সেন্স-লেস হয়ে পড়েন। এরপর আর সেন্স ফেরেনি। 

০২. আমার ছোট চাচা হাফেজ মৌলবি শহিদুল্লাহ। তাঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন আমার শ্বশুর। আমার বাবার একান্ত অনুগত ছাত্রও ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে ছোট থেকেই তাঁকে চিনি। ভালোভাবে জানি। অসম্ভব সুন্দর আমলের একজন কামেল আলেম ছিলেন। আচার-ব্যবহার, কথা-বার্তা ঈর্ষণীয়। তাঁর সাথে একবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে এমন সব মানুষ তাঁকে আমলি মানুষ হিসাবে আমৃত্যু স্মরণ করবেন। তাঁর উদার আতিথেয়তার অকৃত্রিম প্রশংসা করবেন।

০৩. গত সাত বছর তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। একমাত্র জামাতা হিসাবে সীমাহীন ভালোবাসা, অনন্ত স্নেহ আর পরম আশ্রয় পেয়েছি। কখনো মলিন মুখে কথা বলেননি। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। মুচকি হেসে মিষ্টি ভাষায় কথা বলতেন। আমার প্রায় বিশুদ্ধ বেকার জীবনের দীর্ঘদিনে "কী করবা? কী হবে? কত দিন তো হলো, এভাবে আর কত দিন?" এই ধরনের কোনো কথা একটিবারও বলেননি। কখনো জানতে চাননি, চাকরির কী খবর? এইসব আলাপ-আলোচনা আমাদের মুখে শুনলে তিনি বলতেন, "আল্লাহ ভরসা। তোমরা এত চিন্তা করো কেন? আল্লাহ আছে না!"

০৪. আমার বিয়ের সময় সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলাম। বিয়ের সময়ও তিনি জানতে চাননি, "আমি কত বেতন পাই? আমার ফিউচার কী?" এমনকি জাগতিক আয়-ইনকামের কোনো কিছুই জানতে চাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। একইসাথে ফাজিল-কামিল করেছি। ফাজিল-কামিলের ব্যাপারটা মেঝো ভাই মাওলানা আজিজুল হকের কাছে প্রশ্ন করে তিনি জেনেছেন। অন্য কোনো ব্যাপারে তাঁর সামান্য আগ্রহ চোখে পড়েনি। তবে প্রথম দিন তিনি আমাকে আপাদমস্তক দেখেছেন। টুপি, দাড়ি, পাজামার দিকে খেয়াল করেছেন। টাখনুর চিনে পাজামা পরা কিনা বারবার খেয়াল করেছেন। পরবর্তীতে আলাপকালেও এসব দেখার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। 

শ্বশুর আব্বা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন হুজুরের (আবার বাবা) ছেলে ১০০% হালাল পথে সম্মানজনক রিজিক অর্জন করতে পারবে। এজন্য অনেক ভালো (নবম গ্রেডের) সরকারি চাকরিজীবীদেরও তিনি জামাতা হিসাবে গ্রহণের চিন্তাও করেননি। বিভিন্ন দিন থেকে ভালো অফার আসার পরও মেয়েকে দেখাননি। আমার বাবা ও পরিবারের দিকে তিনি নজর দিয়েছেন। নজর দিয়েছেন আমার নেক আমলের প্রতি। তাই তাঁর অনেক আত্মীয়-স্বজনের প্রচণ্ড দ্বিমত থাকার পরও তিনি বিয়ের ব্যাপারে সামান্য পিছ-পা হননি। এমনকি গত সাত বছর তিনি সগৌরবে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বড় বড় মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাতে বলতেন, "আমাদের জামাই। ঢাবিতে পড়েছে। প্রিন্সিপ্যাল হুজুরের ছেলে।"

০৫. মসজিদে একসাথে নামাজে যেতাম। অনেক সময় আমাকে ইমামতির দায়িত্ব দিতেন। কখনো দেরিতে মসজিদে গেলে সামনের কাতারে ডেকে নিতেন। পাশে দাঁড়াতে বলতেন। বিভিন্ন মাহফিলে মঞ্চে ডেকে নিতেন। সামনের দিকে বসাতেন। মাঝে-মধ্যে ফজরের নামাজে দেরি হলেও ডাকতেন না। মানে, জামাত পাবো না এমন বুঝতে পারলে তিনি একা মসজিদে চলে যেতেন। যাওয়ার সময় হাবীবুল্লাহ ভাইকে (তাঁর ছোট ছেলে) ডাকতেন যাতে আমারও ঘুম ভাঙে। এমন কখনো হয়নি যে তিনি আমাকে ডেকেছেন। কখনোই না। কত বেশি স্নেহ করতেন তা বুঝতাম বলে ডাকার মতো সিচুয়েশন তৈরিই হতে দিতাম না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম জামাত ধরার। 

০৬. কবে বাড়িতে যাবো, কখন যাবো; এসব জেনে নিতেন তানজিলার কাছ থেকে। যাওয়ার আগে বাজার থেকে বিভিন্ন সখের জিনিস, পছন্দের খাবার, দেশি-বিদেশি ফল-ফলাদি,  কিনে আনতেন। নদীর বড় মাছ, দেশী মুরগি, টাটকা শাক-সবজি কিনতেন। কেক-বিস্কুট, দই-ছানাসহ যত খাবার আছে সাধ্যমতো কিনতেন। খেতে বসলে আমার প্লেটের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে খেয়াল রাখতেন। "এত কম কেন খাও? আরো খেতে হবে। না খেলে হবে না। জুয়ান মানুষ কী খাও?" এসব বলতে বলতে খাবার তুলে দিতেন। তবে বেশি জোর করতেন না। আমার স্বস্তির দিকে খেয়াল করতে ভুলতেন না। 

০৭. তানজিলার রুমে আমি থাকলে অনুমতি নিয়ে আসতেন। হাতে খাবার থাকতো। বাজার থেকে সন্ধ্যার পর, মাদরাসা থেকে বিকেলে আসার সময় খাবার নিয়ে আমাদের হাতে দিতেন। আম্মাকে বলতেন, "জিয়াউল হককে দাও।" মাঝে-মধ্যে সন্ধ্যার পর ডাকতেন, "জিয়াউল হক, কোথায় তুমি? এদিকে আসো।" যাওয়া মাত্রই নানান খাবারে ভরা প্লেট হাতে তুলে দিতেন। বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল নিয়ে কথা বলতেন। কথা বলতেন সমসাময়িক জরুরি বিষয়ে। 

০৮. বিয়ের আগে মেঝ ভাই বলেছিলেন, "হাকিম কাকার ঘরে প্রতি মাসে পবিত্র কোরআন খতম হয়।" পরে এই চমৎকার ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে, ইশরাকের নামাজ পড়ে হাঁটতে যেতেন। হেঁটে এসে দীর্ঘসময় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন। সন্ধ্যার পরে এবং এশার নামাজের পরেও তিলাওয়াত করতেন। এই জান্নাতি রুটিনের ব্যতিক্রম হয়নি একটি দিনের জন্যও। 'জগতের সব গোল্লায় গেলে'ও তিনি রুটিন লঙ্ঘন করতেন না। 

আমাদের সন্তান তাসফিয়া জান্নাত জারা। জারা বাবুকে তিনি ডাকতেন জান্নাত বলে। জান্নাত নামটা তাঁরই রাখা। জান্নাতকে তিনি সীমাহীন ভালোবাসতেন। আমি না থাকলে জান্নাতও তাঁকে ছাড়া কিছু বুঝতো না। তিন বছর বয়সেই প্রতিদিন সকালে তাঁর সাথে হাঁটতে যেত। হেঁটে হেঁটে নানার কোলে উঠতো। সন্ধ্যার পর নানার কোলে বসে তিলাওয়াত শোনা, ওয়াজ শোনা নিয়মিত রুটিন ছিল তাঁর প্রাণপ্রিয় জান্নাতের। মৃত্যুর পর জান্নাতই সবচে বেশি মিস করছে তার নানাকে। ওর বয়স পাঁচ বছর হয়নি তবুও বোঝে নানা আর কখনো ফিরে আসবেন না। নানাকে আর এক মুহূর্তের জন্যও কাছে পাবে না। তাই ওর কষ্টও বেশি। ফুঁপিয়ে কাঁদে। বলে, "নানাকে ফোন দেও, বাবা। আমাকে নানার কাছে নিয়ে যাও। আমি আর কিছু বুঝি না। আমি নানাকে চাই!"

০৯. এই জান্নাত জন্মের পরপর আমি জরুরি কিছু জিনিসপত্র কিনি। যেকোনো কারণে সেটা আব্বা দেখেছেন। দেখে বলেন, "এসব কেন কিনেছো? এখন খরচের সময় না। আমরা খরচ করবো।" ঢাকা থেকে বাড়িতে যেতাম। বাড়ি থেকে তানজিলাদের বাড়ি। কখনো কখনো আগে তানজিলাদের বাড়ি। তানজিলাদের বাড়িতে আগে গেলে আব্বাই জানতে চাইতেন, আমাদের বাড়ি কখন যাবো? আমার বাবার সাথে দেখা করার তাগিদ দিতেন। কিছু নিয়ে যেতাম সবসময়ই। সেসব তাঁর চোখে পড়লেই বলতেন, "এতকিছু ক্যানো আনো? দরকার নাই তো!" পরে দেখতাম বাড়ির সব শিশুকে ডেকে ডেকে আমার নেয়া ফল-ফলাদি হাসি মুখে বিতরণ করতেন। তাঁর পরিচিত মানুষজনকে সময় করে ডাকতেন। দেখা হলে বাড়িতে নিয়ে আসতেন।আপ্যায়নকালে তাঁদের বলতেন, "এটা জামাই আনছে। জিয়াউল হক আনছে।"

১০. গত কয়েক বছর কিডনি-জটিলতায় তিনি ঘরে পড়ে ছিলেন। হাঁটা-চলা কম করতেন। করতে পারতেন না। তখন তিনি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি আমল করতেন। প্রায় পুরোটা সময় তসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। নামাজের পর দীর্ঘ সময় জিকির করতেন। কুরআন তিলাওয়াত করতেন। টুকটাক জরুরি কাজ ছাড়া সময় নষ্ট করতেন না বললেই চলে।  

১১. হাসপাতালে সেন্স থাকা অবস্থায় তিনি ইশারায় নামাজ পড়েছেন। বাসায় বসেও নামাজের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখেছি। যদিও তখন তাঁর দুইটি কিডনিই বিকল। মৃত্যুর দোরে তিনি। প্রায় সেন্স-লেস অবস্থা। পুরোপুরি সেন্স হারানোর পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৬ দিন তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। তবে গত এক মাস ধরে মৃত্যুর ব্যাপারে, মৃত্যুর কষ্টের ব্যাপারে তিনি অনেক কথা বলতেন আমাদের সাথে। বারবার বলতেন, "আল্লাহ আমাকে কষ্ট দিও না। হায়াত না থাকলে ঈমানের সাথে তোমার কাছে নিয়ে যাও। কষ্ট দিও না আল্লাহ!"

এমনকি শেষের দিকে আমাদের বলতেন, "আমার সময় ফুরিয়ে গেছে। রিজিক শেষ হয়ে গেছে। তোমরা আমাকে আর কষ্ট দিও না। আমাকে হাসপাতালে টেনে-হেঁচড়া করো না। বাড়িতে নিয়ে চলো। আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা হোক। আল্লাহ যত দিন হায়াতে বাঁচান, তোমরা বাড়িতেই রাখো আমাকে।" 

আল্লাহর কী চমৎকার ইশারা বাড়িতে আনার সাথে সাথে তাঁর শারীরিক কষ্ট কয়েক গুণে কমে যায়। তিনি কিছুটা নিস্তেজ হয়ে যান। মৃত্যু-পূর্ববর্তী যন্ত্রণা কমতে থাকে। কমে যায়। এমনকি মৃত্যুকালে আমরা বুঝতেই পারিনি যে তিনি চলে গেলেন। ৩০-৪০ সেকেন্ড পর বুঝতে পারি আব্বা আর নেই! 

১২. জানাজার নামাজের আগে বিভিন্ন আলেম-ওলামা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শুনে বিস্মিত হচ্ছিলাম। সত্যিই তাঁকে পুরোপুরি চিনতে পারিনি এই সাত সাতটা বছরেও। প্রতিটা মানুষ চোখের পানি ছেড়েছেন। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সবার বক্তব্যের সারমর্ম ছিল, মাওলানা আবদুল হাকিম আল্লাহর প্রিয় বান্দা। একজন জান্নাতি মানুষ। সত্যিকারের আলেমে দ্বীন। আমরা তাঁর মতো মানুষ পাইনি বললেই চলে। 

পরিশেষে আমরা বলবো, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ক্ষমা করে দিন। তাঁর নেক আমলগুলো বহু গুণে বাড়িয়ে দিন। তাঁকে মহান রবের প্রিয়জনের কাতারে শামিল করুন। তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনকে ধৈর্য ধারণের তাওফিক দিন। ইসলামের পরিপূর্ণ বিধান সঠিকভাবে তাঁদের মানার তাওফিক দিন। আমিন, ছুম্মা আমিন।

কেএল/