মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫ ।। ১১ চৈত্র ১৪৩১ ।। ২৫ রমজান ১৪৪৬


২৩ তম তারাবির নামাজে তিলাওয়াতের সারমর্ম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব || 

 (সূরা আহকাফ, সূরা মুহাম্মদ, সূরা ফাতহ, সূরা হুজুরাত, সূরা ক্বাফ ও সূরা যারিয়াত)

আলহামদুলিল্লাহ, আমরা কুরআনের বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলোর শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছি। আজ ২৩ তম তারাবীতে তেলাওয়াত করা হবে ২৬ তম পারা। এই পারার আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সামনে অতীত জাতির ঘটনা, কিয়ামতের ভয়াবহতা, মুমিনদের প্রতিদান ও কাফেরদের শাস্তির বিবরণ তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে নবীজির (সা.) দাওয়াতি মিশন, কুরআনের অলৌকিকত্ব এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। ২৬ নম্বর পারার আয়াতগুলোতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের জীবন, সমাজ ও আখিরাতের নির্দেশনা দিয়েছেন। এখানে উঠে এসেছে ঈমান ও আমলের গুরুত্ব, নবী-রাসূলদের সংগ্রাম, মুমিন ও মুনাফিকদের পার্থক্য এবং জান্নাত-জাহান্নামের সুস্পষ্ট চিত্র।

এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা মানুষের সঠিক পথনির্দেশনা, কিয়ামতের ভয়াবহতা, জান্নাত ও জাহান্নামের পরিণাম, পূর্ববর্তী উম্মতদের ঘটনা এবং নবী-রাসূলদের সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই অংশে আমরা পাব হুদাইবিয়ার সন্ধির পেছনের হিকমত, ইসলামী সমাজে শৃঙ্খলা ও একতা বজায় রাখার বিধান, আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থার শিক্ষা এবং কিয়ামতের ভয়াবহতার বিবরণ। অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষা, আর রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের অনুপম জীবনাদর্শ আমাদের জন্য পথনির্দেশ।

১. সূরা আহকাফ (১-৩৫) আদ জাতির ধ্বংস ও নবীদের ধৈর্যের শিক্ষা

  • আল্লাহ তাঁর কুদরতের নিদর্শন ও সত্য পথনির্দেশনার কথা উল্লেখ করেছেন।
  • হুদ (আ.)-এর সম্প্রদায় 'আদ জাতির ধ্বংস এবং তাদের প্রতি প্রেরিত আজাবের বর্ণনা এসেছে।
  • পিতা-মাতার প্রতি সদাচার ও তাদের প্রতি দায়িত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
  • জিনদের একটি দল কুরআন শ্রবণ করে ঈমান আনায় তাদের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
  • নবী হুদ (আ.) তাঁর জাতিকে একত্ববাদ ও আনুগত্যের দিকে আহ্বান করেছিলেন, কিন্তু তারা অবাধ্য হয়ে ধ্বংস হয়েছে।
  • কাফেররা কিয়ামতের সত্যতা অস্বীকার করলেও তা নিশ্চিতভাবেই সংঘটিত হবে।
  • নবীজী (সা.)-কে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে, যেমন পূর্ববর্তী নবীগণ ধৈর্য ধরেছিলেন।

২. সূরা মুহাম্মদ (১-৩৮) ঈমান, জিহাদ ও মুনাফিকদের পরিচয়

  • ঈমানদার ও কাফিরদের পার্থক্য স্পষ্ট করা হয়েছে।
  • মুমিনদের বিজয় ও কাফিরদের পরাজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
  • জিহাদের গুরুত্ব, মুনাফিকদের চরিত্র এবং দুনিয়ার সাময়িক জীবনের অসারতা তুলে ধরা হয়েছে।
  • কিয়ামতের ভয়াবহতা ও পরকালের সফলতার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
  • মুমিন ও কাফেরদের পরিণতি বর্ণিত হয়েছে। মুমিনরা সফল, আর কাফেররা ধ্বংসপ্রাপ্ত।
  • আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও ত্যাগের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
  • যারা আল্লাহর পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর আল্লাহ অন্য জাতিকে উত্তম বানিয়ে দান করবেন।

৩. সূরা ফাতহ (১-২৯) বিজয়ের সুসংবাদ ও মুসলিমদের শ্রেষ্ঠত্ব

  • হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা এবং মুসলমানদের জন্য তা কল্যাণকর হওয়ার ব্যাখ্যা এসেছে।
  • রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সত্যতা ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে।
  • মুনাফিকদের হীনমন্যতা ও তাদের অন্তরের কালিমার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
  • রাসূল (সা.)-এর সাহাবাদের প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাদের চরিত্রের উৎকর্ষ তুলে ধরা হয়েছে।
  • মুমিনদের জন্য ক্ষমা, শান্তি ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
  • নবীজীর (সা.) সাহাবাদের ঈমানের দৃঢ়তা তুলে ধরা হয়েছে।

৪. সূরা হুজুরাত (১-১৮) সামাজিক নীতি ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ তুলে ধরা হয়েছে।

  • সামাজিক শৃঙ্খলা, ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ, গুজব থেকে বেঁচে থাকা এবং মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিধান দেওয়া হয়েছে।
  • মুমিনদের সত্যিকারের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এবং দীনকে শুধু মুখের কথা হিসেবে না নিয়ে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
  • নবীজীর (সা.) অবমাননা করা নিষেধ করা হয়েছে।
  • গুজব ও সন্দেহ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
  • মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, তা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • জাতি, বর্ণ ও গোত্রের ভেদাভেদ নয়, বরং তাকওয়াই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে প্রকৃত সম্মানের ভিত্তি হলো তাকওয়া, বংশ বা গোত্র নয়।

৫. সূরা ক্বাফ (১-৪৫) কিয়ামত, মৃত্যু ও জান্নাত-জাহান্নামের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে।

  • মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন ও কিয়ামতের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
  • ফেরেশতাদের দায়িত্ব, মানুষের কর্ম লিপিবদ্ধ করা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের পরিণতি স্পষ্ট করা হয়েছে।
  • অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের কাহিনী উল্লেখ করে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে।
  • কিয়ামতের ঘটনা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
  • মৃত্যুর পর প্রত্যেক ব্যক্তির কর্ম তার সামনে উপস্থিত করা হবে।
  • জান্নাতের নেয়ামত ও জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহ দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে।

৬. সূরা যারিয়াত (১-৩০) কিয়ামত, নবীদের ঘটনা ও তাকওয়ার গুরুত্ব

  • আল্লাহর শপথ দিয়ে কিয়ামতের নিশ্চিত বাস্তবতার ঘোষণা করা হয়েছে।
  • ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে ফেরেশতাদের আগমন এবং তাঁর স্ত্রী সারার সন্তান লাভের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
  • আল্লাহর দয়ায় যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।

মূল শিক্ষা ও বার্তা:

  • ঈমান ও তাকওয়ার ওপর সফলতা নির্ভরশীল, আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।
  • আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃত বিজয় অর্জিত হয়।
  • মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে সম্মান, সৌজন্য ও ন্যায়বিচার।
  • মৃত্যু ও কিয়ামতের স্মরণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, যা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।

উপসংহার:

এই পারায় আমরা দেখতে পাই, ঈমান ও আমলের গুরুত্ব, নবীজির অনুসরণ, আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন এবং সামাজিক শৃঙ্খলার বিধান। বিশেষ করে, কিয়ামতের ভয়াবহতা ও জান্নাত-জাহান্নামের বাস্তবতা আমাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে অটল থাকার আহ্বান জানায়। এই পারার প্রতিটি আয়াত আমাদের জন্য হিদায়াতের আলোস্বরূপ। এতে অতীত জাতির শিক্ষা, নবীদের সংগ্রাম, ইসলামী সমাজব্যবস্থার মূলনীতি ও পরকালের প্রস্তুতির নির্দেশনা রয়েছে।

আসুন, আমরা কুরআনের এই মূল্যবান শিক্ষাগুলো হৃদয়ে ধারণ করি, আল্লাহর আনুগত্যে নিজেদের উৎসর্গ করি এবং নাজাতের পথে দৃঢ় সংকল্পে এগিয়ে যাই। আসুন, আমরা এই শিক্ষাগুলোকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কুরআনের শিক্ষাকে অন্তরে গ্রহণ করে আমলে পরিণত করার তাওফিক দান করুন, আমিন!

লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ