রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ ।। ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১ ।। ৯ রমজান ১৪৪৬


একই দিনে সারা বিশ্বে রোজা এবং ঈদ কি সম্ভব?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মুহিউদ্দীন মাআয ||

এই প্রশ্নের জবাবটি বড় একটি অংশ ভৌগলিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত। তাই এই প্রশ্নের জবাব জানার পূর্বে ভৌগলিক কিছু ধারণা অর্জন করা একান্ত দরকার। প্রথমেই যেটা জানা প্রয়োজন সেটা হলো প্রতি চান্দ্র মাসের নতুন চাঁদ পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে দৃষ্টিগোচর হবে? নাকি বিভিন্ন মাসের চাঁদ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেখা যাবে ?

এই বিষয়ে ভৌগলিক গবেষণার ফলাফল হলো, প্রতি চান্দ্র মাসের ১ তারিখের চাঁদ বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যাবে। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ক্রমান্বয়ে পাশ্চাত্বের কোনো অঞ্চলে ১ তারিখের চাঁদ দেখা যাবে।

কারণ চান্দ্র মাসের প্রথম দিনে চাঁদ ও সূর্য প্রায় একই সময়ে পূর্ব দিগন্তে (জাপানে) উদিত হয়। এবং এর বিপরীত মেরুতে অর্থাৎ দক্ষিন-পশ্চিম আটলান্টিক মেরুতে সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রায় ৪৯ মিনিট পরে চাঁদ অস্ত যায়। এর অর্থ হলো, সর্ব পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেও প্রথম তারিখের চাঁদ ৪৯ মিনিট আকাশে থাকে। এ সময় সূর্যাস্তের পর দিগন্তে চাঁদের যে কিঞ্চিৎ অংশটুকু সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয় তাকেই আমরা নতুন চাঁদ হিসেবে দেখি।

প্রথম দিনের চাঁদ, সূর্যাস্তের ৪৯ মিনিট পরে অস্ত যায় বলেই ২য় দিনের চাঁদ, সূর্য উদয়ের ৪৯ মিনিট বিলম্বে পূর্বাকাশে উদিত হয়। কারন আকাশের যে দিগন্ত রেখা আটলান্টিকের জন্য অস্ত স্থল, আবার সে দিগস্ত রেখাই জাপানের জন্য উদয়স্থল। এভাবে প্রতিদিনই চন্দ্র উদয়ের বিলম্বতায় ৪৯ মিনিট করে যুক্ত হতে থাকে। একারনেই ২৯ দিনে চাঁদকে ২৯টি ন্থানে উদয় হতে দেখা যায়। আবার প্রায় সাড়ে ২৯ দিন পরে চাঁদ ২৪ ঘন্টা ঘুরে এসে পরবর্তী চন্দ্র মাসের ১ তারিখে আবার নতুন করে সূর্যের সাথে প্রায় একই সময়ে উদিত হয়।

 চলুন আরো একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি

ভৌগলিকভাবে প্রমানিত যে, গ্রীনিচমান সময়ের (GMT) দিক থেকে পৃথিবীর সর্ব প্রথম সূর্য উদয়ের দেশ হলো জাপান। যার ভৌগলিক অবস্থান ১৪২ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাগিমাংশ এবং ৩৭.৫ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ।

আর অস্ত স্থল দক্ষিণ পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরের ভৌগলিক অবস্থান হলো ৩৮ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাগিমাংশ এবং ৩৭.৫ দক্ষিন অক্ষাংশ। এই উদয় ও অস্ত স্থলের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১২ ঘন্টা এবং অবস্থানগত দূরত্ব ১৮০ ডিগ্রী। কারণ প্রতি ১ ডিগ্রীতে সময়ের ব্যবধান ৪ মিনিট

চান্দ্র মাসের এক তারিখে চাঁদ ও সূর্য প্রায় একই সময়ে জাপানে উদিত হয়ে ১৮০ ডিগ্রী পথ অতিক্রম করে সন্ধায় সূর্য যখন আটলান্টিক অঞ্চলে অস্ত যায়, চাঁদ তখনও পৃথিবীর আকাশে ৪৯ মিনিট ধরে অবস্থান করে

এই ১৮০ ডিগ্রী পথ অতিক্রম করতে চাঁদ ও সূর্য অস্ত যাওয়ার ব্যবধান ৪৯ মিনিট হলে, এর অর্ধেক অর্থাৎ ৯০ ডিগ্রী পথ অতিক্রম করতে সময় লাগবে প্রায় ২৪ মিনিট।

এখন মধ্য প্রাচ্যের (ইয়েমেন,রিয়াদ,বাগদাদ) অবস্থান ৪৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাগিমাংশে হওয়ায়, উদয় স্থল জাপান ও অস্ত স্থল আটলান্টিকের সাথে মধ্য প্রাচ্যের ভৌগলিক অবস্থানের ব্যবধান ৯০ ডিগ্রী। যে কারনে মধ্য প্রাচ্যে যখন সূর্যাস্ত হয়, তখন চান্দ্র মাসের ১ তারিখের চাঁদ মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ২০ থেকে ২৫ মিনিট অবস্থান করে ৷ ফলে চান্দ্র মাসের ১ তারিখ চাঁদ সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ থেকে দৃষ্টিগোচর হবে। এবং ক্রমান্বয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশ সমূহে সূর্যাস্তের পরে চাঁদের স্থায়িত্ব আকাশে বেশী সময় থাকবে।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্বাঞ্চলীয় দেশসমূহ উদয়স্থলের নিকটবর্তী হওয়ায়, সূর্যাস্তের পরে সেখানকার আকাশে ১ তারিখের চাঁদের স্থায়িত্ব কম সময় ধরে থাকে এবং চাঁদ দিগন্তের_আকাশে_কম_উঁচুতে থাকে বলেই উদয়স্থলের নিকটবর্তী দেশ সমূহ যেমন, পাকিস্থান, ভারত, বাংলাদেশ, চীন বা জাপানে কখনই চান্দ্র মাসের ১ তারিখের চাঁদ দেখা যাবে না। এ ছাড়াও চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর নিরক্ষ রেখার সঙ্গে সোয়া ৫ ডিগ্রিতে হেলানো থাকে। ফলে একই সময়ে পৃথিবীর কোথাও একই সময়ে চাঁদ দেখা যায় না।’

এখন কথা হলো একই দিনে সারা বিশ্বে রোজা এবং ঈদ কি সম্ভব ?

আমরা জানতে পারলাম। সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করা, একই দিনে ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আযহা করাÑ ভৌগোলিক ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় বাস্তবতার দিক থেকে এগুলো একেবারেই সম্ভব নয়। কারণ শরীয়তের এই ইবাদতগুলো চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। আর যেখানে চাঁদ দেখা যায়নি সেখানে এই ইবাদতগুলো কিভাবে শুরু হতে পারে।  

বস্তুত যা সম্ভব নয়, শরীয়ত নাযিলের সময় সে বিষয়ের ধারণা থাকলেও, শরীয়ত এর হুকুম দেয় না। আর একে তো এই বিষয়টা অসম্ভব, আবার সে সময় এর ধারণাও ছিল না, এমন বিষয়ের হুকুম শরীয়ত কীভাবে দিতে পারে?

কথা এমনিতেই খুব স্পষ্ট; তা সত্ত্বেও আরো স্পষ্ট করার জন্য শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এর প্রামাণ্যতা তুলে ধরছি।

রোজা-ঈদ সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ হাদীস শরীফে বলা হয়েছে।

إن الله تبارك و تعالى جعل الأهلة مواقيت للناس، فصوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته، فإن غم عليكم فعدوا له ثلاثين يوما.

নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা হিলালকে মানুষের জন্য মীকাত (সময় নিরূপণের মাধ্যম) বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়। যদি হিলাল দেখা না যায় তাহলে (চলতি মাসের) ত্রিশ দিন গণনা কর! Ñমুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক বিন হাম্মাম (১২৬-২১১ হি.), খ. ৪, পৃ. ১৫৬, হাদীস 

একই দিনে রোজা-ঈদ পালন করা না করা বিতর্কের সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হলো উক্ত হাদীসটি।

যেখানে রাসুল সা. চাঁদ দেখে রোজা রাখতে বলেছেন ও চাঁদ দেখে ঈদ করতে বলেছেন। সুতরাং যারা চাঁদ দেখতে পায়নি তারা কোন ভিত্তিতে রোজা-ঈদ পালন করতে পারে?

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ