মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন নিভৃতচারী আলেম। রাজধানীর মিরপুর-১২ মাদরাসা দারুর রাশাদ’র মুহতামিম। ইসলাম শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে সম্প্রতি আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান আল মাহমুদ। সঙ্গে ছিলেন মুহাম্মাদ বিন ইয়ামীন। সাক্ষাৎকার সহযোগিতায় ছিলেন দারুর রাশাদের শিক্ষক মাওলানা এনামুল করীম ইমাম।
প্রথম পর্বের লিংক : কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার তাগিদ দেয় ইসলাম: মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী
আওয়ার ইসলাম: আকাবির-আসলাফরা শুধু মাদরাসা-মসজিদে নির্ভর ছিলেন না, নমুনা হিসাবে তাদের কয়েকজনের গল্প শুনতে চাই
মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী: সকল যুগের শ্রেষ্ঠ মানবগণ হালাল জীবিকা উপার্জনে তৎপর ছিলেন। নবি-রাসুলগণ মানবজাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে বসে থাকেননি। বরং কাজ করেছেন। তাঁদের জীবিকা উপার্জনের কিছু দিক উল্লেখ করা হলো :
হজরত আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন একজন কৃষক এবং নিজ হাতে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন। আর এ কাজে তাঁর স্ত্রীও সাহায্য করতেন।
হজরত নূহ আলাইহিস সালাম ছিলেন কাঠ মিস্ত্রী।
হজরত ইদরিস আলাইহিস সালাম ছিলেন দর্জি।
হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ছিলেন রাখাল।
হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম ছিলেন বর্ম নির্মাতা। [ফাতহুল বারি : ৪/৩০৬ [২০৭২নং হাদিসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবহাত ফি তালবির রিজক : ৬৪]
হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম কখনও মক্কাবাসীর ছাগল চরাতেন। আবার কখনও ব্যবসা করতেন। তিনি ইরশাদ করেন :
আল্লাহ তাআলা এমন কোনো নবি প্রেরণ করেননি, যিনি ছাগল চরাননি। তখন সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আপনিও? তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি কয়েক কিরাতের (মুদ্রা) বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৬২]
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু একজন সৎ ব্যবসায়ী ছিলেন। কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। ইসলাম কবুল করার পর তার সম্পদ গোলাম আজাদ ও ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করেন।
হজরত উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। এর মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু জাহেলি ও ইসলামি যুগে কাপড়ের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু কুপ থেকে পানি তুলে অন্যের জমিতে সেচ দিতেন। তার কষ্ট এমন পর্যায়ে পৌঁছত যে, হাতে রশির দাগ পড়ে যেত।[1]
হজরত খাব্বাব ইবনুল আরত রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন কর্মকার।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন রাখাল।
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন তীর প্রস্তুতকারী।
যুবায়ের ইবনুল আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন দর্জী।
বিলাল ইবনে রাবাহ ও আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহুমা গোলাম ছিলেন।
সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু ক্ষুরকার ও খেজুর গাছে পরাগায়নের কাজ করতেন।
বারা ইবনে আযেব ও যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ছিলেন ব্যবসায়ী।
ইমামে আজম আবু হানিফা রহ.সহ অন্যান্য ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী ছিলেন। [ইত্তিকাউল হারাম ওয়াশ শুবুহাত ফি তলাবির রিজক : ৬৮]
উপমহাদেশের শাহ আবদুল আজিজ দেহলভি রহ.-এর প্রধান খলিফা মুফতি এলাহি বখশ রহ. কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সহিহ বুখারির টীকাকার মাওলানা আহমাদ আলি সাহরানপুরীর ‘মাতবায়ে আহমদি’ নামে প্রকাশনা ছিল। কাসেম নানুতুভি রহ. প্রকাশনীর প্রুফ রিডিং-এর কাজ করতেন।
মনে হচ্ছে, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উচ্চতর সাধারণ শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসা নীতি ও কর্মমুখী শিক্ষাকে বাদ দেওয়ায় মুসলিমরা অনুন্নত, অবহেলিত, পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীতে পর্যবসিত হচ্ছে। বিষয়গুলো আমাদের দায়িত্বশীল ইসলামি চিন্তাবিদদের বিবেচনায় আনতে হবে।
আওয়ার ইসলাম: মসজিদ-মাদরাসার বাইরে তরুণদের কর্মমুখী করতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী: বর্তমান সময়ের তরুণ-যুবকদের কর্মমুখী করতে উলামায়ে কেরাম ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজসহ অন্যান্য পেশার ফজিলত বিষয়ক আয়াত ও হাদিস বেশি বেশি আলোচনা করতে পারেন। তাহলে তারা উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করবে।
ওয়াজ মাহফিলগুলোকে কেবল জান্নাত-জাহান্নাম ও রাজনৈতিক আলোচনা সর্বস্ব না করে এগুলোকে কর্মতৎপরতার ওয়ার্কশপ বানানো যেতে পারে।
মসজিদের ইমাম ও উলামায়ে কেরামও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারেন।
আওয়ার ইসলাম: কর্মমুখী করতে কওমি কর্ণধার/বোর্ড কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করছেন কি? সেগুলো কী কী?
মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী:
- মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজসহ অন্যান্য পেশার ফজিলত বিষয়ক আয়াত ও হাদিস দিয়ে একটি বই তৈরি করে তা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
- বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ কর্মমুখী বিভিন্ন বিষয়ের পাঠদান আবশ্যক করাতে পারে।
- ছাত্রদের বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মদক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা আত্মবিস্মৃত ও আত্মবিনাশী জাতি হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। তাদের চৈতন্যোদয় হওয়া দরকার। আর এটা হবে দ্বীনি শিক্ষার সাথে সাথে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ব্যবসা নীতি ও কর্মমুখী মানসম্মত শিক্ষায় জ্ঞানার্জন করার মাধ্যমে কর্মতৎপরতার মানবিক বৈশিষ্ট্য সর্বাঙ্গে ধারণ না করা পর্যন্ত তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। আজকে মুসলিমদের সবধরনের দুরাচারবৃত্তি ছেড়ে দ্বীনি ও উপযুক্ত কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতীয় চেতনায় অখণ্ডতা, সংহতি ও উৎকর্ষ সাধন একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন।
হাআমা/