|| হাসান আল মাহমুদ ||
কওমি মাদরাসাগুলোর সম্মিলিত সর্বোচ্চ অথরিটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে জাতীয় মুফতি বোর্ড।
গত ৪ জানুয়ারি বোর্ডটির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে সংস্থাটির চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসানকে জাতীয় মুফতি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মারকাযুদ দাওয়াহ ইসলামিয়া ঢাকা’র আমিনুত তালিম মুফতি আব্দুল মালেককে সদস্যসচিব করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়।
এরপর গতকাল শনিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে মুফতি বোর্ডের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সদস্যসচিবসহ বোর্ডের সদস্যরা আলোচিত ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে ইসলামী শরিয়তের বিধান উপস্থাপন করেন।
চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব ছাড়া মুফতি বোর্ডের সদস্যরা হলেন, মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ, মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন, মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতি আরশাদ রাহমানী, মুফতি মোহাম্মাদ আলী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মুফতি জসিমুদ্দীন, মুফতি এনামুল হক, মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া, মুফতি মুজিবুর রহমান (সিলেট), মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন, মুফতী আব্দুস সালাম (ফরিদাবাদ) ও মুফতি কেফায়াতুল্লাহ (হাটহাজারী)।
এমন একটি মুফতি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আসছে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। মুসলিম-অমুসলিম বিশ্বের নানা দেশে ইসলামি শরিয়া কেন্দ্রিক জাতীয় ফতোয়া বোর্ড বা মুফতি বোর্ড থাকলেও বাংলাদেশে বড়দের সম্মিলিত পরিসরে এ প্রথম। তাই, এমন বোর্ড গঠনের সংবাদে উচ্ছ্বসিত দেশের আলেমসমাজও।
জাতীয় মুফতি বোর্ড জাতির উন্নয়নে কীভাবে কাজ করবে?
কোন্ কোন্ বিষয়গুলো গুরুত্বে নিবে এর দায়িত্বশীলগণ? এ বিষয়ে দেশের ৫ জন তরুণ আলেম-মুফতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ২০ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন আওয়ার ইসলামের কাছে।
নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়ার মুদাররিস ও মুফতি নাজমুল ইসলাম কাসিমী বলেন, ‘প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যে কাজটি আরও বিশ বছর আগে হওয়ার কথা ছিল; দেরীতে হলেও অবশেষে জাতীয় মুফতি বোর্ড গঠন হয়েছে।
তবে শুরুতেই এই বোর্ড নিয়ে আমার একটি প্রস্তাবনা থাকবে, এই বোর্ড কে নিরঙ্কুশভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য আমার কয়েকটি প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা :
এক : বাংলাদেশের অনেক নিভৃতচারী মুফতি রয়েছেন, তাদেরকে যুক্ত করে এই ১৭ জনের সংখ্যাকে ৪০ জনে উন্নীত করা।
দুই : জাতীয় এই মুফতি বোর্ডের অধীনে বিশাল একটি মাকতাবা প্রতিষ্ঠা করা এবং তাতে বেশি-বিদেশি সকল দুর্লভ কিতাবগুলো সংগ্রহ করা।
তিন : পাশাপাশি মাকতাবার সাথেই একটি গবেষণালয় প্রতিষ্ঠা করা।
চার: বর্তমানে প্রযুক্তি অনভিজ্ঞ হওয়া মানে অনেক ফেতনাকেই আপনার না চেনা। তাই প্রযুক্তিগত ফেতনাকে চিনতে এবং সেটার প্রতিকারে একটি মানসম্মত ওয়েবসাইট তৈরির মাধ্যমে বোর্ডের ফতোয়াকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
পাঁচ: বাংলাদেশের প্রতিটি দারুল ইফতার সাথে এই জাতীয় মুফতি বোর্ডের সমন্বয় রাখা। সারা দেশের প্রতিটা দারুল ইফতাকে একটি শক্ত নিয়মনীতি করে এই বোর্ডের আওতাভুক্ত করা।
আপাতত এই প্রস্তাবনাগুলো রাখলাম। আশা করব,কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন করে এই বোর্ড গঠনের সার্থকতা যেনো বজায় রাখা হয়। জাতীয় মুফতি বোর্ডের জন্য অনেক দোয়া।’
চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুদাররিস মাওলানা দৌলত আলী খান জাতীয় মুফতি বোর্ডে বিদ্বান তরুণ আলেম ও মুফতিদের নিয়োগদান করার জোর দাবি জানিয়ে বলেন, ‘তরুণ সমাজ দেশের আশা-ভরসা। একটা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে তরুণ সমাজের উপর।
একইভাবে আমাদের দেশের তরুণ আলেম ও মুফতিদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় শরয়ি সমাধানের অনেক খেদমতের আশা করতে পারি। এছাড়াও বর্তমান তরুণ আলেমরা যুগোপযোগী ইসলামি জ্ঞান অর্জনে এগিয়ে চলছে। তারা দেশি-বিদেশি ধর্মীয় ষড়যন্ত্র বা ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জোড়ালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ তরুণ আলেমদের উপর নির্ভর করে। তাই আমার জাতীয় মুফতি বোর্ডের সম্মানিত অভিভাকদের কাছে আমার একটি প্রস্তাবনা থাকবে :
এক : জাতীয় মুফতি বোর্ডে বিদ্বান তরুণ আলেম ও মুফতিদের নিয়োগদান যুগচাহিদা ও সময়ের সেরা দাবি হবে।’
লক্ষ্মীপুর রায়পুরের বাইতুল আমান জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা শরিফ আহমাদ বলেন, ‘দেশে এই প্রথম জাতীয় মুফতি বোর্ড গঠন করার সংবাদে আমি আনন্দিত। উদ্যোক্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আল্লাহর শোকর আদায় করছি আলহামদুলিল্লাহ। জাতীয় মুফতি বোর্ডের কাছে আমার প্রত্যাশা হলো:
এক : জেলাভিত্তিক কমিটি গঠন করা হোক। এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুফতিদের একত্র করা হোক। মজবুত নেটওয়ার্ক তৈরি করা হোক।
দুই : যোগ্যতার ভিত্তিতে সবার মাঝে দায়িত্ব বন্টন করা হোক।
তিন : যুগোপযোগী কার্যকরী উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করা হোক।
চার : কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে তদারকির সিস্টেম চালু করা হোক। কেননা শহর গ্রামাঞ্চলের মুফতিদের সমন্বিত প্রয়াসে সমকালীন ফেরাকে বাতেলা, গ্রাম্য সালিশে অযোগ্যদের ফতোয়াবাজি ও ধর্মবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব।
একা একা কখনো সম্ভব নয়। জাতীয় মুফতি বোর্ড আশা করি লালিত এই স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে প্রয়াসী হবেন।’
কুমিল্লার চান্দিনা সাতবাড়িয়া মাদরাসা দারুল উলূম আল ইসলামিয়ার মুদাররিস মুফতি তানযীল হাসান বলেন, ‘দীর্ঘদিনের বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয় ছিল দেশের গ্রহণযোগ্য শীর্ষ মুফতিদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় বোর্ড গঠন করা। আলহামদুলিল্লাহ গত কিছুদিন পূর্বে দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম উদ্যোগি হয়ে এ ধরনের একটি মুফতি বোর্ড গঠন করেছেন। আমার কাছে মনে হয় কাজের সুবিধার্থে জাতীয় মুফতি বোর্ডের বিন্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। আর তা এভাবে হতে পারে-
এক : দেশের সর্বজন স্বীকৃত শীর্ষ ওলামায়ে কেরামকে এই বোর্ডের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা।
দুই : ফিকহ ফতোয়ার কাজকে যারা জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং সরাসরি এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন এমন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও আস্থাশীল মুফতিদেরকে কার্যকরী সদস্য হিসেবে মনোনীত করা। তাহলে, শরীয়ত বিরোধী যে কোন তৎপরতা প্রতিহত করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবেন।
তিন ; বোর্ডের উদ্যোগে ফিকহি সেমিনার, কনফারেন্স, মুহাজারা ও গবেষণাপত্র প্রণয়ন এবং তা প্রচারের ব্যবস্থা করা। যাতে সর্বস্তরের সাধারণ মুসলমান সচেতন হতে পারে এবং সঠিক করণীয় নির্ধারণ করতে পারে।
চার : বছরে অন্তত একবার হলেও জাতীয় পর্যায়ে ফিকহি কনফারেন্স আয়োজনের মাধ্যমে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা এবং উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত ফতোয়া প্রদানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পাঁচ : বোর্ডের নিজস্ব ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করা এবং ওয়েবসাইটে সমস্যাবলির সমাধান প্রকাশ করা, যাতে করে সাধারণ মানুষ বেশ উপকৃত হতে পারে।
ছয় : বিভিন্ন সময় দেখা যায় মতবিরোধপূর্ণ কিছু মাসয়ালার ক্ষেত্রে, অনেকে যার যার মত সমাধান পেশ করে থাকে এবং তাদের কথাগুলো মিডিয়াতেও প্রচার করা হয়। ফলে সঠিক সমাধান নির্ণয়ে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়। তাই জাতীয় মুফতি বোর্ড যদি উদ্ভূত সমস্যার ফতোয়া বা সমাধান মিডিয়াতেও প্রচার করে, যাতে করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির শিকার হতে হবে না, তারা সঠিক বার্তাটি সহজেই জানতে পারবে।
সাত : আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে শরীয়ত বিরোধী অনেক সমস্যা ও সংকট এমন রয়েছে, যেগুলোর সাথে সরাসরি সরকার বা সরকারী কর্মকর্তারা সম্পৃক্ত। যেমন ইসলাম বিরোধী নারী নীতি, শিক্ষা নীতি, সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা এবং ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে যদি যথাযথ পন্থায় সরকারের উপর প্রভাব সৃষ্টি করা যায় এবং সরকারের উপলব্ধিতে সঠিক বার্তাটি পৌঁছে দেয়া যায় তাহলে অনেক সংকট সহজেই প্রতিহত হওয়া সম্ভব।
শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে গঠিত জাতীয় মুফতি বোর্ড এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি আশাবাদী।’
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পল্লবী ফিকরুল উম্মাহ মডেল মাদরাসার পরিচালক মুফতী মুহাম্মাদ আবিদুর রহমান বলেন, ‘বাস্তব কথা হল এদেশের মানুষ ফিতরাতান ধর্মভীরু। ধর্মীয় আবেগে পরিচালিত এখানকার মানুষ। ফলে নিজেদের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেশের উলামায়ে কেরামের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে থাকে সাধারণ মানুষ।
কিন্তু শরয়ী বিষয়াদির কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমতের যৌক্তিকতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মাঝে ওলামায়ে কেরামের মতভিন্নতা মাঝেমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে দেয়। এজন্য দেশের শীর্ষ মুফতীয়ানে কেরামের একটি সম্মিলিত বোর্ড থাকা অনিবার্য হয়ে পড়ে যেখানে সবকিসিমের জাতীয় সমস্যায় একটি মাত্র ফতোয়ার মাধ্যমে গণমানুষ বিদ্যামান বিষয়ে শরয়ী হুকুম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবে।
আলহামদুলিল্লাহ দেরিতে হলেও এমন একটা উদ্যোগ দেশ-শীর্ষ উলামায়ে কেরাম নিয়েছেন তাদের জন্য তাই শুভকামনা রইল।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আক্ষেপের বিষয় হলো, এই উদ্যোগ অতিতেও নেওয়া হয়েছিল কিন্তু উদ্যোগগুলো না স্থায়ী হয়েছে আর না সামগ্রিকভাবে নির্ভরতার জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।’
এই সময় তিনি জাতীয় মুফতি বোর্ডের কাছে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, ‘
সদ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করা জাতীয় মুফতী বোর্ডের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হল বোর্ডটি যেন কেবল শব্দগত জাতীয় বোর্ড না হয়ে কার্যত একটি জাতীয় ফতোয়া বোর্ড হিসেবে দেশের সকল মানুষে আস্থা ও নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠে। এজন্য এই বোর্ডের কাছে আমাদের কিছু প্রস্তাবনা পেশ করছি:-
এক : যেহেতু এটি একটি জাতীয় মুফতী বোর্ড সেহেতু অনির্ভরযোগ্য কাউকে এই বোর্ডের মূল বডিতে না রাখা।
দুই : এই বোর্ডের একটি শক্তিশালী ওয়েবসাইট রাখা এবং সেখানে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করবার অপশন রাখা।
তিন : ভবিষ্যতে দেশে যে কেউ দারুল ইফতা খোলার আগে তারা যেন জাতীয় মুফতী বোর্ডের অনুমোদন পাওয়াকে নিজেদের অস্তিত্ব সহি হওয়ার দলীল মনে করে বোর্ডটির এমন প্রভাব থাকা।
এনএ/