|| কাউসার লাবীব ||
সাধারণ মানুষের মাঝে দ্বীনের আলো বিলোনোর অন্যতম মাধ্যম প্রচলিত ওয়াজ মাহফিল। তাছাড়া গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যও বলা চলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই আয়োজনকে। তবে নানা কারণে বর্তমানে এসব হেদায়েতি মঞ্চকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে; যার অন্যতম কারণ কিছু বক্তার অযাচিত-অপ্রত্যাশিত কিছু কর্মকাণ্ড।
চলছে শীতকাল। শীত মৌসুমে দেশের পাড়া-মহল্লায় দ্বীনি এই আয়োজন দেখা যায় প্রায় প্রতিদিন। দ্বীনপ্রেমী মানুষজন সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে ছুটে আসে ওয়াজের প্যান্ডেলে। খুঁজে পায় দিলের খোরাক। নবীপ্রেম আর রবের ভালোবাসা বুকে বেঁধে বাড়ি ফেরে।
যুগ যুগ ধরে চলমান দ্বীনের এসব মজমাকে আরো কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায়? সময়ের ব্যবধানে কেন এখন ওয়াজের মঞ্চগুলো নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছে? তাছাড়া কোন ধরনের বক্তাদের ওয়াজের ময়দানে আসা উচিৎ? একজন ওয়ায়েজের ‘হাদিয়া’ই বা কেমন হতে পারে ইসলামের আলোকে? এসব বিষয়ে কথা বলেছিলাম দেশের প্রখ্যাত ওয়ায়েজ ও ইসলামি আলোচক মুফতি মুস্তাকুন্নবী কাসেমীর সঙ্গে।
তার মতে, কমপক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন না করে ওয়াজের ময়দানে কোনো বক্তাকে আসা উচিৎ নয়। কেননা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অসংখ্য সাধারণ মানুষ এখানে দ্বীন শিখতে আসে, জানতে আসে। অযাচিত কোনো তথ্য এসব সাধারণ মানুষকে পরকালীন ক্ষতির মুখোমুখি করতে পারে। তাছাড়া বক্তাকেও আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেখুন! কোনো ডাক্তার কি মেডিকেল সাইন্স না পড়ে ডাক্তারি করতে পারে? কোনো ইঞ্জিনিয়ার কি ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে ইঞ্জিনিয়ারি করতে পারে? তাহলে একজন বক্তা কীভাবে প্রয়োজনীয় ইলম বা জ্ঞান অর্জন না করে এই ময়দানে আসার দুঃসাহস করে!
তিনি যোগ করেন, প্রয়োজনীয় ইলমের পাশাপাশি একজন ইসলামি আলোচক বা ওয়ায়েজের আমল থাকতে হবে। ইলম মোতাবেক যদি আমল না থাকে তাহলে তার মাধ্যমে মানুষ গোমরাহির পথে যাবে। তাছাড়া যে বক্তা ইলম অনুযায়ী নিজেই আমল করতে পারে না, তার আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ কীভাবে হেদায়েতের পথ পাবে!
‘এসবের পাশাপাশি বক্তার নিয়ত থাকতে হবে একেবারে স্বচ্ছ। দিল থাকতে হবে ইখলাসে ভরপুর। তার ফিকির হতে হবে উম্মতকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর। পয়সা কামানো বা দুনিয়াবি কোনো উদ্দেশ্য তার দিলে থাকতে পারবে না। এছাড়া বক্তাকে ময়দানে অহেতুক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ —বলেন তিনি
মুফতি মুস্তাকুন্নবী কাসেমী বলেন, উম্মতের সামনে অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা বলার সুযোগ বক্তাকে ইসলাম দেয় না। মুসলিম জীবনে অপ্রয়োজনীয় কোনো কাজের সুযোগ নেই। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, গিবত-শেকায়েত, গালগল্প এমনিতেই পরিত্যাজ্য। ওয়াজের ময়দানে তো আরো বেশি পরিত্যাজ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক বক্তার ওয়াজের মূল বিষয়ই হচ্ছে এগুলো।
তিনি আফসোস প্রকাশ করে বলেন, ইদানিং কোনো কোনো বক্তার ওয়াজের জন্য এডভান্স টাকা নেওয়ার খবরও পাওয়া যায়। ইসলাম এটা কোনোভাবেই অনুমোদন করে না। পাশাপাশি চুক্তি করে ওয়াজ করাও ইসলাম সমর্থন করে না।
তার মতে, বক্তা হলো দ্বীনের দাঈ। ‘এতো টাকা না হলে আমি মাহফিলে যাবো না’—একথা বলার তার অধিকার নাই। আমাদের আকাবিরদের নজরিয়া এমন নয়। আকাবির-আসলাফগণ যেভাবে এই ময়দানকে দাওয়াতের অংশ মনে করতেন, সেভাবে আমাদেরকেও এই ময়দানকে দাওয়াতের অংশ মনে করতে হবে।’
তিনি বলেন, আমরা যারা ওয়াজের ময়দানে দ্বীনি খেদমত করছি, আদ্দাওয়াতু ইলাল্লাহর কাজ করছি; আমাদের তো উচিৎ ছিল সম্পূর্ণ ফ্রি’তে ওয়াজ করা। কিন্তু যেহেতু পারিবারিক ও সাংসারিক নানা তাকাজা রয়েছে, তাই ইচ্ছে থাকলেও তা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই ততটুকুই হাদিয়া গ্রহণ করা উচিৎ যতটুকু আয়োজক কমিটি স্বেচ্ছায় ও খুশিতে দিতে পারে।
‘আসলে এসবের বিরুদ্ধে এখন কথা বলাও কঠিন। কথা বললেই উলঙ্গ সমালোচনা হবে। ফেসবুক গরম হবে। কিন্তু একজন দ্বীনের দাঈ হিসেবে আমার যেহেতু এসব বলা দায়িত্ব তাই বলেই যাবো। সমালোচনা হোক। তবুও যদি মানুষ সঠিক বিষয় জানতে পারে তাহলেই কল্যাণ। আর আপনারা যারা মিডিয়াকর্মী আছেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা সঠিক বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরবেন।’ —যোগ করেন জনপ্রিয় এই আলোচক।
কেএল/