|| হাসান আল মাহমুদ ||
বাংলাদেশে প্রচলিত কওমি মাদরাসার ইতিহাস প্রায় সোয়াশ বছর হলেও এই সময়ের মধ্যে কোনও প্রতিষ্ঠান বা বোর্ডই শ্রমনীতিমালা বা বেতনকাঠামো তৈরি করেনি বলে নানা মাধ্যমে অভিযোগ ওঠে প্রায় সময়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, অনেক মেধাবী কওমি শিক্ষক শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যবসাসহ নানা পেশায় যোগ দিচ্ছেন। কেউ কিছুদিন খেদমত করে উন্নত জীবনব্যবস্থার তাগিদে বিদেশেও পাড়ি জমাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হাজার হাজার মেধাবী আলেম বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছে বলে জানা যায় খোঁজ নিয়ে।
‘এরা চাকরির অভাবে নয় বরং সবদিক কুলিয়ে উঠতে না পেরে দেশ ছেড়েছেন’ —এমন তথ্য জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক মেধাবী কওমি শিক্ষক।
দেশে থাকতে ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে খেদমত করতেন বলে জানান তিনি। এখন তিনি সৌদি আরবের রিয়াদে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক মেধাবী আলেমকেও দেখেছি জীবনের তাগিদে মাদরাসার খেদমত ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে। তিনি বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে মেধাবী শিক্ষক শূণ্যতায় ভোগবে কওমি মাদরাসাগুলো।’
রাজধানী ঢাকার মিরপুরে ১৮ বছর ধরে টিউশনি ও একটি মার্কেটে দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে সংসার চালাচ্ছেন কওমি মাদরাসার সাবেক একজন মেধাবী শিক্ষক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই আলেম জানান, ‘আমি দীর্ঘ এক যুগ কওমি মাদরাসায় পড়িয়েছি। বড় বড় কিতাবও পড়িয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। আমার বাবাও একজন বড় আলেম। আমাদের মফস্বল শহরে বড় একটি জামিয়ায় আমৃত্যু শিক্ষকতা করেছেন। দীর্ঘ ৪২ বছর এই মাদরাসায় শিক্ষকতা করা অবস্থায় বাবার ইন্তেকাল ঘটে। বাবার সংসারে আমি একাই ভাই একজন। দুটো বোন রয়েছে। ওই সময় আমি মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে একটি মাদরাসায় খেদমতে ছিলাম। মাদরাসার খেদমত ছাড়তে আমার মন কখনো সায় দেয়নি। কিন্তু পারিবারিক জীবন আমাকে বাধ্য করলো কওমি মাদরাসার মতো মহান শিক্ষকতার পেশাকে ছেড়ে দিতে।’
‘আপনি টিউশনি ও দুই ওয়াক্ত ইমামতি করে কত পান?’ এমন প্রশ্ন করলে তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ হাজার চল্লিশের মতো’।
এই সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘আমি একটি লেখায় পড়েছি- পটিয়ার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা হারুন ইসলামাবাদি রহ. বলছেন, ‘কওমি মাদরাসা কখনো অর্থাভাবে বা কারো ষড়যন্ত্রে বন্ধ হবে না, যদি কখনো বন্ধ হয় তাহলে যোগ্য লোকের অভাবেই হবে।’’ আর যোগ্য ও মেধাবিদের ধরে রাখতে হলে অবশ্যই তাদের থাকা, খাবার এবং একটি মানসম্মত বেতন স্কেল তৈরী করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে একটি পরিসংখ্যান বলছে, ‘রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা, মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলে মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের কোনও নীতিমালা নেই। রাজধানীর কোনও কোনও কওমি প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৪৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয় শিক্ষকদের। আর মফস্বল কিংবা গ্রামের মাদ্রাসাগুলোর চিত্র আরও বেশি ভিন্ন। সেখানে সর্বোচ্চ বেতন ১৫ হাজার হলে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ হাজার। এক্ষেত্রে গত ১০-১২ বছরে শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হার বেড়েছে। যদিও বাজারমূল্যের দিক থেকে এই বৃদ্ধি খুব নগণ্য বলে মনে করছেন কওমি শিক্ষকরা।’
২০১৩ সালে অধ্যাপক আবুল বারকাত একটি জরিপ করেছিলেন আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার ওপরে। ওই জরিপটি উদ্ধৃত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ তার ‘মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘‘আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ এবং ৮৪ শতাংশ শিক্ষকেরই প্রধান অভিযোগ বেতনের নিম্ন হার। ড. বারকাতের মতে, এখানে সর্বনিম্ন বেতন হচ্ছে মাসিক ৪৬০০ এবং সর্বোচ্চ মাসিক ১১ হাজার টাকা। অন্যদিকে, কওমি মাদরাসায় যেহেতু কোনও বিধিবিধান নেই, সেখানে বেতনের বিষয়টি খুবই নমনীয়। যখন যেমন সংগ্রহ, তখন তেমন বেতন— এই ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে। ড. বারকাতের তথ্য অনুযায়ী তাদের সর্বনিম্ন আয় মাসিক ১৪৫০ এবং সর্বোচ্চ ৪৫০০ টাকা। লক্ষ্যণীয় যে, ড. বারকাত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের আয়ের যে হিসাব দিয়েছেন সে অনুযায়ী নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তারা প্রায় সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন।’
এছাড়া, কওমি শিক্ষক নিয়োগের নানা বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ‘রাজধানী কিংবা মফস্বল প্রায় সকল কওমি মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ হলে তার বেতন আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারিত হয়। আবাসিক শিক্ষক হলে কোথাও ৮ হাজার, কোথাও ৫ হাজার থেকেও শুরু হয়। আর অনাবাসিক শিক্ষক হলে তার বেতন ২ হাজার টাকা হতে শুরু হয়।’
একটি সূত্র বলছে, ‘কওমি শিক্ষক নিয়োগের সময় বেতন কাঠামো ঠিক রাখে না অনেক প্রতিষ্ঠানই। ‘আলোচনা সাপেক্ষে’র নামে নামকাওয়াস্তে বেতনের সর্বনিম্নের কোনো শেষ নেই। তাই কওমি মাদরাসার শ্রম নীতিমালা বা বেতন স্কেল তৈরি করা বিষয়ে অনেক কওমি শিক্ষক শ্রমনীতিমালা তৈরি ও সে আলোকে বাস্তবায়নের দাবি করছে সূত্রটি।’
কওমি মাদরাসার শ্রম নীতিমালা বা বেতন স্কেল তৈরি করা বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় কওমি শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বশীলদের কাছে।
বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া (বেফাক) এর প্রধান পরিচালক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী বলেন, ‘কওমি মাদরাসা সবগুলো তো একটা জায়গা থেকে চলে না। এ অবস্থায় শ্রম নীতিমালা তৈরি করা কি সম্ভব! সম্ভব না। হ্যাঁ, একটা প্রস্তাবনা তৈরি করতে পারে বিভিন্ন বোর্ড। যাদের ইচ্ছা ফলো করবে। যারা পারে না, তারা ফলো করবে না।
বেফাকের পক্ষ থেকে এমন কোনো প্রস্তাবনা করা আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো ‘দস্তুরুল মাদারিস’ নামে একটা মাদরাসা পরিচালনা নীতি আছে। কিন্তু ওরকম চাকরিবিধি বা অর্থনীতি বিষয়ে নাই।’
এর জন্য কোনো উদ্যোগ বা প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? প্রশ্নে বেফাকের প্রধান পরিচালক বলেন, ‘প্রয়োজনীয়তা আছে, কিন্তু সম্ভব না। কারণ, মাদরাসাগুলো তো আর বোর্ড চালায় না। যে যেমন সে সেরকমই চলে। যদি গভমেন্ট চালাতো, তাহলে একটা নিয়মনীতি করে বাস্তবায়ন করতে পারতো।’
মেধাবী শিক্ষকরা ঝরে পড়ছে, এর সমাধানের জন্য বোর্ডের করণীয় কী? এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেফাক প্রধান পরিচালক বলেন, ‘বোর্ডের অনেক কিছুরই করণীয় আছে। বোর্ড সেগুলো চিন্তা করবে বা করছে- বলে জানান তিনি।
এদিকে বেফাকের সহ-সভাপতি রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত আরজাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া’র কাছে কওমি মাদরাসার শ্রমনীতিমালা নাই কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিক যেসকল মাদরাসা আছে, আমার জানামতে এসব মাদরাসার সবারই বেতন স্কেল আছে। আমাদের মাদরাসাতেও আছে।’
এসময় তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসায় যারা শিক্ষকতা করেন, তারা শ্রম নয়, চাকরি নয়, বরং তারা খেদমত তথা শিক্ষা সেবা দিয়ে থাকেন। শ্রম বললে তার পারিশ্রমিক দেশীয় নিয়মে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ বেতন দিতে হয় একেকজন শিক্ষককে তার যোগ্যতা ও স্কেল অনুযায়ি।’
তিনি বলেন, ‘কওমি মাদরাসা তো বিভিন্ন ধরনের। ব্যক্তি মালিকানা মাদরাসা তার নামও আবার কওমি মাদরাসা দিছে। ফ্ল্যাট-বাড়ি ভাড়া নিয়ে বা জমি কিনে মাদরাসা করে এককভাবে চালাচ্ছে। কোনো শূরা নাই, কমিটি নাই, কোনো জবাবদিহিতা নাই। এসমস্ত মাদরাসা প্রাইভেট কোম্পানির মত। একটা কোম্পানি তার আয়ের যেমন ৭০ ভাগ রাখে নিজের জন্য আর ৩০ ভাগ দেয় কর্মচারীদের, এসব প্রাইভেট মাদরাসাগুলোও তেমন।’
তাহলে বেফাক বা বোর্ডের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে দেওয়া যায় কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেফাক বেতন স্কেল নির্ধারণ করে নীতিমালা প্রকাশ করলেও কেউ মানতে তা বাধ্য নয়। কারণ, মাদরাসার আয়ের খাত অনুযায়ি সাধারণত বেতন নির্ধারণ হয়ে থাকে। এছাড়া অন্যান্য মাদরাসার নিজস্ব কমিটি আছে, তারা নির্ধারণ করে থাকে বেতন। এখানে বেফাকের কিছু করার আছে বলে অধিকার নেই। কারণ, বেফাক তো আর বেতন নির্ধারণ করে দিলে তা দিতে পারবে না।’
কেএল/