রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪ ।। ২৫ কার্তিক ১৪৩১ ।। ৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


কওমি মাদরাসার পরীক্ষার ফি: বন্টন পদ্ধতি কেমন হওয়া চাই


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

।।হাসান আল মাহমুদ।।

পরীক্ষার ফি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকারি কিংবা বেসরকারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের থেকে নেয়া হয়ে থাকে পরীক্ষার ফি। এ পরীক্ষার ফি কোথায় কোন্ কাজে ব্যয় হয়ে থাকে কিংবা হওয়া উচিত বলে মনে করেন সে বিষয়ে মতামত নেওয়া হয় কওমি মাদরাসার শিক্ষক, শিক্ষা সচিব ও পরিচালকের কাছ থেকে।

রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত মিরপুর-১৪, জামেউল উলুম মাদরাসার শিক্ষক মুফতি জুনাইদ বিন সিরাজ জানান, ‘প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই গঠনতন্ত্র আছে। কোথাও না থাকলে থাকা জরুরি। উক্ত গঠনতন্ত্রেই লেখা থাকবে পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম ও পদ্ধতি। সেই সূত্রে পরীক্ষার ফি ও বণ্টন পদ্ধতিও গঠনতন্ত্রে লিখিত থাকারই কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে গঠনতন্ত্র নেই এবং নিয়ম রক্ষার বালাইও নেই। ফলে বিভিন্ন সময় শোনা যায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।

পরীক্ষার ফি বণ্টন পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি জানান, ‘উত্তোলিত অর্থ পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজেই খরচ করা উচিত। এ কথা বলা যাবে না যে, পরীক্ষা গ্রহণ ক্লাস গ্রহণের মতই, তাই এর জন্য শিক্ষককে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা যাবে না।

তিনি বলেন, ‘নিজের বিবেককে কাজে লাগালেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। এটা বিতর্কের বিষয় নয়, খোলা মনে শিক্ষককে মূল্যায়ন করার ও চর্চার বিষয়। সারাদিন ২৪ ঘণ্টা খেটে ছাত্রদের পিছনে মেহনত করা একজন শিক্ষক কী পরিমাণ সম্মানী পাওয়ার কথা! কিন্তু আমরা তাদেরকে কী পরিমাণ দিচ্ছি? পরীক্ষার ব্যস্ততা অবশ্যই ক্লাস করানোর চাইতেও কঠিন ও কষ্টদায়ক। বড় মাদরাসাগুলোতে প্রত্যেক জামাতে ১০০/১৫০ করে ছাত্র। একেক উস্তাদের ভাগে ৪/৫টি জামাতের খাতা দেখার দায়িত্ব থাকে। মাদরাসার ছুটি থাকে সপ্তাহ খানেক। এই সময়ের মধ্যে পাঁচ-ছয়শ খাতা দেখা যে কত বড় সংগ্রাম তা শুধু ভুক্তভোগী শিক্ষকই জানেন। সারা বছর তো পরিবার ও সন্তানদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়-ই না, পরীক্ষার ছুটিতে পরিবারকে নিয়ে কোনো প্ল্যান থাকলে শিক্ষকদের সেই প্ল্যানও ভেস্তে যায়।

তিনি বলেন, ‘এতোসব বলার উদ্দেশ্য হল, শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তারা মূল্যায়িত না হলে এ অঙ্গন হুমকির মুখে পড়বে। তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে মাদরাসার শিক্ষতার পেশা থেকে বের হয়ে আসছেন অনেক প্রতিভাবান মেধাবী তরুণ আলেম। এমনকি আর্থিক সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে উচ্চ সুবিধা লাভের আশায় যোগ দিচ্ছেন ভিন কোনো দলে বা প্রতিষ্ঠানে। পরীক্ষার ফি যদিও ছোট্ট একটি ইস্যু, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের এরকম নানান ছোট্ট ছোট্ট অসঙ্গতির প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

মিরপুর-১১ অবস্থিত বায়তুল জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া বায়তুল মা’মূর মাদরাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জানান, ‘আমাদের মাদরাসার পরীক্ষার ফি আমরা পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে ব্যয় করার পরে যা থাকে তা সমহারে সকল শিক্ষকের মাঝে বন্টন করে দেই।
এছাড়া, দারোয়ান, বাবুর্চি ও অন্যান্য সহকারী স্টাফদেরকেও কিছু সম্মানী দিয়ে থাকি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো ভাবেই পরীক্ষার ফি মাদরাসা ব অন্য কোনো ফান্ডে জমা করে রাখি না। সম্পূ্র্ণ টাকাই এ কাজে ব্যয় করি। ‘আমাদের মাদরাসার এ নিয়ম সকল মাদরাসাকে ফলো করা উচিত’ বলে তিনি দাবি করেন।

উত্তরায় অবস্থিত এরাবিক মডেল মাদরাসার পরিচালক আবদুল্লাহ বিন মুস্তফা পরীক্ষার ফি বন্টন করা সম্পর্কে জানান, ‘আসলে পরীক্ষার ফি মাদ্রাসার একটি অতিরিক্ত আয়। যা থেকে প্রথমত পরীক্ষার যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে। যেমন কাগজ- কলম, স্টাপলার, খামসহ যাবতীয় সরঞ্জাম ক্রয় করা এবং কম্পিউটারে টাইপ ও প্রিন্টের খরচ বহন করা। এছাড়াও পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষকদের ভালোমানের নাস্তা করানো।’

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত পরীক্ষার সকল খরচ বহনের পরে অতিরিক্ত যা থাকবে সেগুলোর পরিমাণ যদি এমন হয় যা সকল শিক্ষককে গড়ে ২০০০/৩০০০ করে দেওয়া যায়, তাহলে যার যার খাতার সংখ্যা এবং কাজের পরিমাণ ও পরিশ্রমের পরিমাণ হিসেবে কমবেশি করে বন্টন করতে হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ২০০০, কাউকে ২৫০০ কাউকে বা ৩০০০ দিতে হবে। আর যদি এমন হয় যে দুই -তিন হাজার করে দেওয়ার পরেও আরো বড় অংকের টাকা অতিরিক্ত থেকে যায়, তাহলে সেটা মাদ্রাসার সাধারণ ফান্ডে রশিদ কেটে জমা করতে হবে।

এক্ষেত্রে বেফাকের নিয়মানুযায়ী খাতা প্রতি একটা ফি নির্ধারণ করা যেতে পারে। এছাড়া, পরীক্ষার ফি থেকে শিক্ষক বাদে আরো যে সকল কর্মচারী আছে, তাদেরও একটা অংশ দেওয়া দরকার।’

এদিকে এ বিষয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ার মুফতি ও উস্তায মুফতি আবুল কালাম আনছারী’র কাছে ফতোয়ার আলোকে পরীক্ষার ফি বন্টন পদ্ধতি কেমন হওয়া চাই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘এ বিষয়টি সম্পর্কে ইতিপূর্বে প্রশ্নের আলোকে আমাদের ফতোয়া ও গবেষণা বিভাগ থেকে ফতোয়া দেয়া হয়েছিল।

বিষয়টির সারমর্ম হলো এমন- আসলে এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নীতিমালাটাই মূল হিসেবে বিবেচ্য। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পূর্ব থেকেই যদি নিয়ম করে রাখে যে, পরীক্ষার ফি থেকে উস্তাদরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করবেন, তাহলে সেটাই গ্রহণযোগ্য এবং সে অনুপাতেই ফিগুলো বন্টিত হবে।
আর পূর্ব থেকেই যদি উল্লেখ থাকে যে, পরীক্ষার ফি থেকে উস্তাদরা কিছু পাবেন না, তাহলে সেটাই ধর্তব্য হবে।

তিনি জানান, ‘তবে পরীক্ষার সময় যেহেতু অতিরিক্ত কাজ-কর্ম এবং পরিশ্রমের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের থেকে ফি নেয়া হয়ে থাকে, এজন্য নৈতিকতা এবং মানবিকতার দাবিও এটাই যে, পরীক্ষার ফি থেকে পরীক্ষা সংক্রান্ত খরচ বাদে, যা অবশিষ্ট থাকে সেগুলো পরীক্ষার হলের ডিউটি, খাতা মূল্যায়ন, আনুষঙ্গিক পরিশ্রম এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্তরবিন্যাস হিসেবে উস্তাদ ও স্টাফদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া চাই। এটাই নৈতিকতা ও মানবিকতার দাবি বলে মনে হয়।’

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ