হাসান আল মাহমুদ, বিশেষ প্রতিবেদক
শুরুতেই বলে রাখি, বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহের সরকার স্বীকৃত সংস্থা আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। মোট ৬ টি বোর্ড মিলে এই সংস্থা। এই সর্বোচ্চ অথরিটির অধীনে সরকার দাওরায়ে হাদীসকে (ইসলামী শিক্ষা ও আরবি) মাস্টার্সের সমমান মর্যাদা প্রদান করেছে।
৬ টি বোর্ড হচ্ছে-বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশ, আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ, তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বাংলাদেশ।
বোর্ডগুলোর কাছে কী চায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা?
মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কওমি মাদারাসার বোর্ডগুলো কাছে কী চায়? ছাত্র-ছাত্রী বা অভিভাবকদের প্রত্যাশা কী এই বোর্ডগুলোর কাছে? পরীক্ষা দেওয়া-নেওয়ার বাইরে কী দাবি- দাওয়া আছে বোর্ডগুলোর কাছে? শিক্ষাবোর্ডের কাছে রয়েছে অনেক প্রত্যাশা ও চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। শিক্ষাবোর্ডের সিলেবাস, কারিকুলামকে সময়োপযোগী করা, স্বীকৃতির মূল্যায়ন, আন্তর্জাতিক বিশ্বে কওমি মাদরাসার সুনাম বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ও দেশের বাইরে পড়াশোনাসহ নানা বিষয়ে আওয়ার ইসলামকে ১২ দফা প্রত্যাশা জানিয়েছেন সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল ৩ আলেম।
বোর্ডের কাছে আমাদের ৬ দাবি : মুহিম মাহফুজ
আলেম কবি ও ইতিহাসের শিক্ষক, বাগেমুসা ইসলামিক সেন্টার, সোনারগাঁও, নারায়নগঞ্জ
গোটা উপমহাদেশের সকল শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষা একটি স্বাধীন ও উপনিবেশবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ মুসলমানী ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বোর্ড বা অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতির প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ বোর্ড প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অধ্যাবধি শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তারে সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছে। তবে একটি জাতির জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শ মানদন্ড বিচার করলে সামগ্রিকভাবে আরো ব্যাপক উন্নতির দাবি রাখে। এই স্বল্প পরিসরে সবিস্তার বলার সুযোগ নেই। তবুও কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে বলা অত্যন্ত প্রয়োজন।
একটি শিক্ষা বোর্ডের প্রধান কাজ মানসম্মত ও যুগোপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, যোগ্য দক্ষ ও দরদী শিক্ষক সমাজ তৈরি করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান-উপকরণ নিশ্চিত করা এবং সময়ের প্রয়োজন পূরণে গোটা শিক্ষা কাঠামোতে উত্তরোত্তর উন্নতি সাধন করা।
এই বিবেচনায় বোর্ডের কাছে আমাদের ৬ দাবি
এক. বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তকগুলোকে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রণয়ন করা।
দুই. মানসম্মত ও যুগোপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য প্রতিটি বিষয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা, সৃজনশীলতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন লেখক ও গবেষকদের সমন্বয়ে পাঠ্য বই প্রণয়ন করা এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সম্পাদকদের মাধ্যমে তা মূল্যায়ন ও পরিমার্জন করা।
তিন. প্রতিটি ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের জন্য পাঠপদ্ধতি সম্বলিত আরেকটি শিক্ষক ভার্সন প্রস্তুত করা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকদের পাঠদান বিষয়ক এবং শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব অনুধাবনমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও দরাদি হিসেবে গড়ে তোলা।
চার. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা রয়েছে এমন শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা।
পাঁচ. শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগের পরিবর্তে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা।
ছয়. সামগ্রিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ আরো শিক্ষা উপযোগী করে তোলা।
এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকলে আরো বিস্তারিতভাবে আমাদের প্রত্যাশা ও আবেদন জানানোর চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
৩ দফার প্রস্তাবনা : মাহবুবুর রহমান নোমানী
মুহাদ্দিস- জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ টঙ্গী গাজীপুর
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আমাদের আস্থার জায়গা। আমাদের ঐক্যের প্লাটফর্ম। শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী সবারই রয়েছে বোর্ডের প্রতি আস্থা ও ভরসা। মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বোর্ড নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সিলেবাস প্রণয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, একসাথে পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় বোর্ডের তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত সুচারুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তবে বোর্ডের কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা আরও বেশি। এখানে আমি কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করছি।
৩ দফার প্রস্তাবনা
এক. কওমি শিক্ষার্থীদেরকে বহির্বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়া-শোনার সুযোগ করে দিতে বোর্ড উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের অনেক কওমি শিক্ষার্থী ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট দিয়ে মদিনা ইউনিভার্সিটি, মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। অথচ তাদের ঐকান্তিক ইচ্ছা কওমি সনদ নিয়ে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া।
দুই. শিক্ষা সমাপনের পর বহু শিক্ষার্থী খেদমতের সংকটে পড়েন। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত। কেবল মসজিদ-মাদরাসায় সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে কওমি আলেম থাকলে মন্দ কি? বরং সময়ের প্রয়োজনে তা দরকার। তবে তা ব্যক্তি উদ্যোগে না হয়ে জাতীয় উদ্যোগে হলে ভালো। বোর্ড সে ব্যবস্থা করতে পারে। কওমি আলেমদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে বোর্ড কর্তৃপক্ষ সরকারের সাথে আলোচনায় বসুক। এটা আমাদের দাবি নয়, বরং অধিকার। আমরা সরকার থেকে শিক্ষার মান নিয়েছি এর সুফল ভোগ করব না কেন?
তিন. বোর্ডের আওতাধীন মাদরাসাগুলোর নিয়ম-কানুন, বেতন কাঠামো অভিন্ন হওয়া চাই। বিভিন্ন মাদরাসার বেতনের তারতম্যের কারণে ঘনঘন শিক্ষক পরিবর্তন হয়। তাতে শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাজার দরের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিভাগওয়ারি বেতন স্কেল বোর্ড নির্ধারিত করে দিলে মাদরাসাগুলো তা গ্রহণ করবে বলে আশা করি।
৩ দফা দাবি : মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী
মুহাদ্দিস, যাদুরচর মাদরাসা, সাভার, ঢাকা
কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বিশাল এক জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করছে। অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বোর্ডের কাছে ছাত্র ও আলেম সমাজের চাহিদা ব্যাপক। আমার কাছে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
গুরুত্বপূর্ণ ৩ দফা দাবি
এক. এদেশের লাখ লাখ প্রাইমারি শিক্ষার্থী ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্য ধর্মীয় শিক্ষক এবং সিলেবাসে কাঙ্ক্ষিত মানের ধর্মীয় শিক্ষা না থাকার কারণে। কওমি শিক্ষাবোর্ড সরকারের সাথে বৈঠক করে দাওরা ফারেগ আলেমদেরকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে পারে।
দুই. নবীন আলেমদের ব্যাপক কর্মসংস্থানে কারিগরী প্রশিক্ষণ দেয়া ও ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
তিন. মেয়েদের মাদরাসার কোন নীতিমালা নেই। যে যার মতো করে মহিলা মাদরাসা গড়ছে। মা-বোনদের নিরাপদ পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিতে মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার একটি সময়োপযোগী নীতিমালা তৈরি করা। যারা সেটা ভঙ্গ করবে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
হুআ/