রিদওয়ান হাসান।।
আমি এখন যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় যেখানটায় বসি, তার মুখোমুখি পার্শ্বে বসতেন সুন্নতি হুজুর রাহিমাহুল্লাহ। যখন তিনি রুমে প্রবেশ করতেন একটু জোর আওয়াজে আস সালামু আলাইকুম বলে উঠতেন। সালামের ‘আস’ শব্দটিকে জোর দিয়ে বলতেন। তখন মুখে হাসির দানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। স্বরবিহীন হাসি যে এতটা মোহনীয় হয়, সুন্নতি হুজুরকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
খুব সাদাসিদে জীবনের মানুষ। স্মিত হাসি লেগেই থাকত চেহারায়। নিরহঙ্কার মানুষের যদি কোনো আকার থেকে থাকে, তাহলে আমি সেটা সুন্নতি হুজুরের মাঝেই দেখতাম। তার চলাফেরা, কথা বলা, মেজাজ-মর্জি সব কিছু খুব ধীরস্থির গতিতে চলত। যেন তিনি যা করছেন তা আমরা সব দেখছি। এবং তিনিও যেন একজনকে দেখে দেখেই এসব করছেন, যা আমরা দেখছি।
হারদুয়ী হযরতকে খুব গভীরভাবে রপ্ত করেছিলেন সুন্নতি হুজুর। সুন্নতের পাবন্দকে রক্তে মিশিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। যাত্রাবাড়ি মাদরাসার হাউজের পারে আমি দীর্ঘসময় নিবিষ্ট মনে হযরতকে মনের মাধুরী মিশিয়ে উযু করতে দেখতাম। তিনি মিসওয়াক করছেন, হাতে পানিয়ে নিয়ে কুলি করছেন, সুন্নতের প্রতিটা ধাপ এতটা গভীরভাবে অনুসরণ করছেন, যেভাবে আমরা বইয়ের পাতায় সুন্নতের ক্রমিকানুসার পড়ি।
সুন্নতি হুজুর মজলিসে দাওয়াতুল হকের একজন প্রবীণতম মানুষ। হারদুয়ী হযরতের প্রত্যক্ষ সোহবতে হযরতের খানকায় দীর্ঘদিন ছিলেন। সুন্নতি হুজুরের কথায় হারদুয়ী খানকার প্রসঙ্গ থাকতই। এত জীবন্ত করে ওয়াকেয়াত ও মালফুযাত বলতেন, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।
একবার তিনি বলেছিলেন, হারদুয়ী হযরতের খানকা হতে ফেরার সময় হারদুয়ী হযরত তাকে একটি চিঠি দেয়। সুন্নতি হুজুরকে বলা হয়েছিল, চিঠিটা যেন বাংলাদেশে এসে তারপর খুলে। সুন্নতি হুজুর কথামতো বাংলাদেশে আসলেন। সে সময় সফররত হযরতওয়ালা করাচি হাকিম আখতার সাহেব বাংলাদেশে ঢালকানগরে অবস্থান করছিলেন। সেখানে এসে সুন্নতি হুজুর হাকিম আখতার সাহেবকে চিঠিটা দেখান। চিঠি দেখেই হাকিম আখতার সাহেব দাঁড়িয়ে যান এবং তার কোর্তা খুলে দেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, চিঠির বিষয়বস্তু আমাদের অজানা রয়ে যায়।
সুন্নতি হুজুরের সমকালীন ও সমবয়সী এক ভাগ্নে ছিলেন। তিনি চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু হযরতের জীবদ্দশায় তা প্রকাশ করা বারণ ছিল। তাই তিনি বলেছিলেন, যদি আমি হযরতের পরে মারা যাই তাহলে প্রকাশ করে যাবো, ইনশাআল্লাহ। কিন্তু হায়, তিনি নিজেই সুন্নতি হুজুরের ২ বছর আগে রফিকে আলার সান্নিধ্য পায়। নাওয়াল্লাহু মারকাদাহু।
মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান হাফিজাহুল্লাহ তার জানাযায় বলেন, তিনি হারদুয়ী হযরতের সোহবতে ছিলেন, এরপর হাকিম কালিম সাহেবেরও সোহবতে ছিলেন। আমি তাকে এজাযত দিয়েছি। এছাড়াও তিনি পীরজি হুজুরের খেলাফতপ্রাপ্ত ছিলেন।
সুন্নতি হুজুর সুন্নতের যারপরনাই গুরুত্ব দিতেন। ছোট ছোট সুন্নতগুলোও হযরতের আচরণে দারুণভাবে ফুটে উঠত। আকাবির আসলাফের পূর্ণাঙ্গ নকল করে গেছেন আজীবন।
হযরতওয়ালা যাত্রাবাড়ি তার জানাযার ইমামতি তো করানোর পাশাপাশি খাটিয়া পর্যন্ত নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং কবর পর্যন্ত বহন করে নিয়ে আসেন। লাশ রেখে মাথা বরাবর দাঁড়িয়ে সব কার্যক্রম খুব গভীরভাবে তদারকি করেন। সবার আগে কবরে মাটি দেন। সবার মাটি দেয়া শেষ হলে কবরের পাশে আবারও আসেন। এরপর মাটিগুলো হালকা উটের কুঁজের মতো করতে বলেন। তারপর একটি খেজুর ডাল মাঝ বরাবর গেঁড়ে দিতে বলেন। এরপর হযরত নিজেই সেখানে পানি ছিটিয়ে দেন। আহা, কী মধুময় দৃশ্য, জানি না এ কোন অসিয়তে এমন দৃশ্য সংঘটিত হয়েছে!
সারাজীবন যিনি সুন্নতের কথা বলেছেন, দাওয়াতুল হকের কথা বলেছেন। শেষ বিদায়ে তা খাতাকলমে দেখিয়ে গেলেন। দাফন কাফন থেকে শুরু করে জানাযা ও কবর খনন সব কিছু সুন্নতের ছাঁচে গড়ে ওঠা, আবার সেটা দাঁড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন দাওয়াতুল হকের আমীরুল উমারা, সারা বাংলাদেশ কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ অথরিটি আল হাইয়াতুল উলয়ার চেয়ারম্যান হযরতওয়ালা যাত্রাবাড়ী।
এরপর মুহিউস সুন্নাহ হযরত সবাইকে ইস্তেগফার এবং কালিমা পড়তে বলেন। বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কবর দেওয়ার পর এভাবে দাঁড়িয়ে সবাইকে ইস্তেগফার ও কালিমা পড়তে বলেছিলেন। কারণ, এসময়ে মাইয়েতকে সুওয়াল জওয়াব করা হয় এবং মাইয়েত পাশে থাকা লোকজনের উপস্থিতি বুঝতে পারে। আমাদের উচিত তার পাশে থাকা। আহা, কী মোহনীয় দৃশ্য। এমন দৃশ্যই হয়ত সাহাবীরা দেখেছিল সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বে।
আল্লাহ মুজীবুর রহমান সুন্নতি হুজুরকে জান্নাতের আলা ইলিয়্যিনে সম্মানিত করুন। মুহিউস সুন্নাহ হযরতের ছায়া আমাদের ওপর দীর্ঘায়িত করুন।
-এটি