।।।আনিকা তাহসিন সাইয়্যেদা।।। শবে বরাত। শব এবং বরাত এই শব্দগুলো ফারসি শব্দ। শব অর্থ রাত বা রজনী। বরাত অর্থ ভাগ্য, মুক্তি। এই দু’শব্দের একত্রে অর্থ হবে, ভাগ্য-রজনী বা মুক্তির রজনী। অনেকেই বরাত শব্দটিকে আরবি ভেবে ভুল করে থাকেন মূলত এটি একটি ফারসি শব্দ। কারণ আরবি ভাষায় বরাত বলতে কোন শব্দ নেই। আরবি ভাষায় শবে বরাত (শাবান মাসের মধ্য রজনী)কে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ হিসাবে অবিহিত করা হয়। শবে বরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত।
এই রাতের ফজিলত নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এর ফজিলত নিয়ে অনর্থক বিতর্ক করার সুযোগ নেই। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল বলেন, নবী কারীম সা. ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি বাড়িয়ে দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান ১৩/৪৮১ হাদিস নং, ৫৬৬৫, শুআবুল ঈমান ৩/৩৮২, হাদিস নং ৩৮৩৩)
এই হাদিসটির দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা এই রাতে আমাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং যারা শিরিক করে এবং খারাপ কাজ-কর্মে লিপ্ত থাকে এবং অন্যের সঙ্গে হিংসা পোষণকারী তাদের ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত এই রাতটিকে অবহেলায় কাটিয়ে দেন।
পুরুষদের তো ইবাদতের যথাযত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তারা মসজিদে গিয়ে সারা রাত ইবাদত করতে পারেন। কিন্তু মেয়েরা তা পারেন না। মেয়েরা সারাদিন সংসারের কাজ-কর্ম করে রাতে সাধারণত ক্লান্ত থাকেন। প্রতিদিনের মতো ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। তাই সাধারণত তারা এতো গুরুত্বপূর্ণ রাতটিকে বলা যায় ঘুমেই কাটিয়ে দেন।
মনে রাখতে হবে, ইসলামের প্রতিটি বিধানই নারী-পুরুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং সমান গুরুত্বপূর্ণ। সওয়াবের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে কোনো রকমের ভেদাভেদ করা হবে না। পবিত্র কোরআন বলছে, ‘বিশ্বাসী হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দপূর্ণ জীবন দান করব। আর তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার তাদেরকে দান করব।’(সুরা নাহল, আয়াত ৯৭) অন্যত্র তিনি এরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদের কোনো কর্মনিষ্ঠ পুরুষ বা নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা পরস্পর সমান।’ ( সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৯৫) সুতরাং ইসলামের যে কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান গুরুত্ব এবং সমান মর্যাদা। এ বিষয়টি আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিশেষ করে ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। এই রাতের ফযিলত পাওয়ার জন্য আমরা মেয়েরা যেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি: একান্ত অপরিহার্য কাজ-কর্ম ছাড়া শবে বরাতের দিনে অন্য কাজ না করা।
পারলে দিনে একটু ঘুমিয়ে নেয়া, যাতে করে রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা যায়। বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে তাদের তাড়াতাড়ি খানা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া। রান্না-বান্নার কাজ দিনেই সেরে ফেলা, রাতের ইবাদতের সময় যেন রান্না-বান্নার পেছনে না যায়।
বাসায় সাহায্যকারী থাকলে তাদের সাহায্য নিয়ে তাড়াতাড়ি ফারেগ হয়ে যাওয়া। তবে মনে রাখতে হবে, সাহায্যকারী কাজের বুয়া বা মেয়েদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। মোটকথা, রাতটিকে আমলে আমলে কাটানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি দিনেই সম্পন্ন করে ফেলা।
নফল নামাজ পড়া: এই রাতে নফল নামায পড়া সম্পর্কে একটি হাদিসে এসেছে, হযরত আলা ইবনুল হারিস (রহঃ) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা!
অথবা বলেছেন, হে হুমাইরা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল সা. তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুল সা.ই ভালো জানেন।
রাসুলুল্লাহ (স:) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রর্থানাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ (শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৬৮) এই হাদিস থেকে প্রমাণ হয় যে, এই রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া এবং যেই নামাজের সেজদাহ হবে অতি দীর্ঘ, শরীয়তের দৃষ্টিতে তা কাম্য।
তবে মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন বই-পুস্তকে এই নফল নামাজের বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য নিয়ম কানুন দেয়া আছে। অর্থাৎ কত রাকাত নামাজ পড়তে হবে, কোন রাকাতে কী সুরা পড়তে হবে, প্রতি রাকাতে সুরা কতবার পড়তে হবে। এগুলো ঠিক নয়।
পরদিন রোজা রাখা: হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্হে সাদিক পযর্ন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪]
এই বর্ণনাটির সনদ দয়ীফ। কিন্তু মহাদ্দিসীন কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে, ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে ও রিকাক বা চিত্তবিগলনের ক্ষেত্রে দয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। এমনকি বিধি-বিধানের ক্ষেত্রেও দয়ীফ হাদিসের সমর্থনে শরিয়তের অন্য কোনো দলিল থাকলে অথবা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কোনো আমল বা ফতয়া থাকলে কিংবা সাহাবি-তাবেয়ীর যুগ থেকে সেই হাদিসের ওপর আমল অব্যাহত থাকলে সেই দয়ীফ হাদিস শুধু গ্রহণযোগ্যই নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অনেক সূত্রে বর্ণিত হাদিসের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। (আল আজবিবাতুল ফাযিলা, আল্লামা ইবনে কায়্যিম রহ. কৃত কিতাবুর রূহ, পৃষ্টা ১৬, ইমাম যারকাশী রহ. কৃত আন নুকাত, ১/৩৯০, হাফেজ শামসুদ্দীন সাখাবী রহ. কৃত ফাতহুল মুগীছ, ১/৩৩৩)
আল্লামা তাকী উসমানী বলেন, শাবানের ১৫ তারিখে রোযা রাখার আদেশ সম্বলিত (ইবনে মাযায় বর্নিত) হাদীসটি দুর্বল। তাই শুধুমাত্র এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে শাবানের ১৫ তারিখের রোযাকে সুন্নত বা মুস্তাহাব বলা অনেক আলেমের দৃষ্টিতেই অনুচিত। তবে শাবান মাস ও আইয়ামেবীয (১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) হিসেবে (আগে-পরের দিনসহ) ১৫ তারিখে রোজা রাখলে সওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। (ইসলাহী খুতুবাত) কবর জিয়ারত করা: হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ রাতে কবর জিয়ারত করেছেন।
তবে কবর জিয়ারত করাটা যেন আড়ম্বরপূর্ণ না হয় এবং শিরকমুক্ত হয়। কেননা আমাদের দেশে কবর যিয়ারতকে কেন্দ্র করে নানা শিরকি কর্মকান্ড সমাজে শিকড় গেড়ে বসেছে। ইসলামের সূচনালগ্নে যখন মানুষ কবর পূজা করত তখন আল্লাহর নবী সা. কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলেন। সুনানে ইবনে মাজাহ শরিফের ১৫৭১ নং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আমি তোমাদের কবর-যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। (এখন ঐ নিষেধাজ্ঞা মানসূখ করা হচ্ছে) এখন তোমরা কবর যিয়ারত করতে পার।
কারণ তা দুনিয়ার মোহ দূর করে এবং আখিরাতকে মনে করিয়ে দেয়। (মিশকাত পৃষ্ঠা ১৫৪) এরপর ইসলাম আসার পর সাহাবায়ে কেরাম যখন জাহিলিয়্যাতের রীতিনীতি ভুলে যান তখন রাসুল সা. আবার কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদান করেন। কারণ কবরের দৃশ্য দেখে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বের বিশ্বাস তাজা হয়, নিজের মৃত্যু ও কবর-জীবনকে স্মরণ করে আখিরাতের প্রস্তুতির সংকল্প গ্রহণ করা যায়। তাছাড়া আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করা এবং মাগফিরাতের দুআ ও ঈসালে ছওয়াবের মাধ্যমে তাদের উপকৃত করা যায়।
আর আল্লাহওয়ালাদের কবর যিয়ারতের দ্বারা যে পথে চলে তারা আল্লাহর দরবারে মাকবুল হয়েছেন ওই পথে চলার পাক্কা এরাদা করা যায়। এ ধরনের বিভিন্ন মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কবর যিয়ারতকে নিষিদ্ধ করার পরও আবার অনুমতি দান করা হয়েছে। সুতরাং কবর যিয়ারতের ক্ষেত্রে জাহিলিয়্যাতের ধ্যান-ধারণা চলে আসার আশংকা থাকলে কবর যিয়ারত না করাই শ্রেয়। তাই কবর যিয়ারত করতে হবে সম্পূর্ণ একাকি।
ঈসালে সওয়াব করা: হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ রাতে মৃত ব্যক্তির জন্য ঈসালে সওয়াব করতেন। ঈসালে সওয়াব বিভিন্নভাবে করা যায়। যেমন নফল ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদির মাধ্যমে ঈসালে সওয়াব করা যায়। সহিহ হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত যে, মানুষ মৃত্যুর পরও তার আমলনামায় দুই ধরনের আমল অব্যাহত থাকে। (ক) মৃতের এমন আমল যা তার জন্য সদকায়ে জারিয়া হতে পারে। (খ) এমন আমল, যা মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতরা করে থাকে।
যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতরা দোয়া মাগফিরাত করে থাকে। তার মাগফিরাতের জন্য দান-সদকা করে থাকে। কিংবা তার জন্য নফল হজ্জ্ব উমরা করে থাকে।
অধিক পরিমাণ আল্লাহর কাছে দোয়া করা: কেননা এ রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাকে তার প্রয়োজনের জন্য দোয়া করতে বলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ রাতে খুব কান্নাকাটি করে দোয়া করতেন। শবে বরাত ছাড়াও দোয়া সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোয়ার মাধ্যমে মহান রবের কাছে পূর্ণ আত্মসর্মপন করা হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব, যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ -সুরা মু’মিন : আয়াত ৬০।
দোয়া ইবাদতের অংশ। আল্লাহ তাআলা এটিকে ইবাদত হিসেবে অভিহীত করেছেন এবং সাহায্য লাভের মাধ্যম বানিয়েছেন। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে, বস্তুজগতের উপায় উপকরণ তার কোনো সমস্যা, কষ্ট ও চাহিদা পূরণ করতে পারে না, তখন কোনো অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী সত্তার কাছে ধরনা দেয়া অপরিহার্য মনে করে। তখনই মানুষ দোয়া করে এবং না দেখেই সে সত্তাকে ডাকে, প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি জায়গায় এবং সর্বাবস্থায় ডাকে।
একাকী নির্জনে ডাকে, শুধু উচ্চস্বরেই নয়, চুপে চুপেও ডাকে এবং মনে মনেও তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তাই দোয়া গুরুত্বপূর্ণ। আর বিশেষ রাতে তার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। মোটকথা, যে ব্যক্তি এই মহামহিমান্বিত রজনী আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে কাটাবে তার ওপর আল্লাহ তায়ালার রহমত ও অফুরন্ত করুণা বর্ষিত হবে। সুতরাং এই পরম মুহূর্তে নিজেকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে বাঁচিয়ে রেখে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া উচিত।
-এটি