আওয়ার ইসলাম ডেস্ক: একসময় নেদারল্যান্ডসের কট্টরপন্থী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন জোরাম ভ্যান ক্ল্যাভারেন। ২০১০-১৪ সাল পর্যন্ত ফ্রিডম পার্টির সদস্য হিসেবে ফ্লেভোল্যান্ডের প্রদেশের সংসদ সদস্য ছিলেন। এমনকি কট্টর ডানপন্থী নেতা গির্ট ওয়ার্ল্ডার্সের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তিনি।
কিন্তু ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে একটি বই লেখার সময় বদলে যায় ক্ল্যাভারেনের জীবন পরিক্রমা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবরে অবাক হয় সবাই। পরবর্তী সময়ে তাঁর বইটি ‘এপস্টেট : ফ্রম ক্রিস্টিয়ানিটি টু ইসলাম ইন টাইমস অব সেকুলারাইজেশন অ্যান্ড টেরর’ নামে প্রকাশিত হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে যখন পবিত্র কোরআনের কপি পোড়ানোর মতো জঘন্য কাজ চলছে তখন নিজ জীবনের কোরআনের প্রভাব ও নতুন দিগন্ত উম্মোচনের গল্প তুলে ধরেন তিনি। তুরস্কভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
১৯৭৯ সালে আমস্টারডামে আমার জন্ম। সেখানকার ভিইউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করি। উদার ও সংস্কারপন্থী খ্রিস্টান হিসেবে আমি বেড়ে উঠি। আগে থেকেই বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল আমার। কারণ ইসলামের সহিংসতা নিয়ে সবাইকে সতর্ক করাই ছিল আমার কাজ। একজন রাজনীতিবিদ ও সংসদের সদস্য হিসেবে আমি নেদারল্যান্ডসে মুসলিমদের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের চেষ্টা করেছি।
এখানকার ইসলামিক স্কুল, মসজিদ, আজানসহ পবিত্র কোরআন পাঠ নিষিদ্ধে আইন করার দাবি জানিয়েছি। সব সময় ইসলামের ভয়াবহতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ১/১১-এর ঘটনার পর বিখ্যাত ফিল্মমেকার থিও ভ্যান গঘ নিহতের ঘটনা ঘটে। তখন আমি ধর্মের ভয়াবহতা নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতে মনোযোগী হই।
তখন ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য যাচাই করতে গিয়ে কিছুটা অবাক হই। আমার ইচ্ছা ছিল আমার বইয়ের সব তথ্য সঠিক হবে। তাই সঠিক বিষয় জানতে বিখ্যাত স্কলার অধ্যাপক আবদুল হাকিম মুরাদের (আগে যিনি টিমোথি উইন্টার নামে পরিচিত ছিলেন) শরণাপন্ন হই। আমার ধারণা ছিল, ইসলামবিদ্বেষী হওয়ায় তিনি আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। কিন্তু তাঁর সুন্দর উত্তর শুনে মুগ্ধ হয়ে পড়ি।
তিনি ইসলাম বিষয়ক পশ্চিমাদের লেখার বাইরে প্রাচ্যের লেখকদের মৌলিক কিছু বই পড়ার পরামর্শ দেন। এরপর আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়। এমনকি খ্রিস্টবাদ নিয়ে আমার অনেক সংশয়ের ইসলামী জবাবও পেয়ে যাই। সেই সময় মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীও পড়ে ফেলি।
অবশ্য এক স্রষ্টা ও নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে আমি তখন প্রায় মুসলিম হয়ে পড়েছি। তবে আমার মধ্যে তখনো কিছুটা বিদ্বেষ ছিল। ইসলামকে সত্য জানলেও আমি তা গ্রহণ করতে পারছিলাম না। কিন্তু তখনই একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। অস্বাভাবিক মনে হলেও তা সত্য ছিল।
একটি বইয়ের তাকে রাখতে গিয়ে সেখান থেকে কিছু বই পড়ে যায়। যেখানে পবিত্র কোরআনেরও একটি কপি ছিল। আর আমার বৃদ্ধাঙ্গুল ছিল কোরআনের একটি আয়াতের ওপর। তা ছিল আল্লাহর এই কথা, ‘তোমাদের চোখ তো অন্ধ হয়নি, বরং তোমাদের বক্ষে থাকা অন্তর অন্ধ হয়ে পড়েছে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৪৬)
মূলত এটি আমারও সমস্যা ছিল। কেননা তখন সত্য আমার কাছে স্পষ্ট। আমার জ্ঞান বা দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই। তবু আমার মন ও আবেগ তা মানতে পারছিল না। অতঃপর আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে পথনির্দেশের প্রার্থনা করি। পরদিন ঘুম থেকে ওঠার পর সব ঘৃণা-বিদ্বেষ পুরোপুরি দূর হয়ে যায়। আমি অন্তরে প্রবল শক্তি ও আনন্দ অনুভব করি। এরপর মা ও স্ত্রীকে আমার মুসলিম হওয়ার কথা জানাই। আমার ঘটনা প্রকাশের পর সবাই আমাকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে।
মূলত সারা জীবন আমি যে বিদ্বেষ ছড়িয়েছি তাই আমার কাছে ফিরে আসে। তা ছিল আমার পাপের ফল। যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের কৃতকাজের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ৪১)
পশ্চিমা বিশ্বে বসবাস করে আমার উপলব্ধি হলো, অমুসলিমরা সাধারণত কোরআন বা হাদিস পড়ে না; বরং তারা আমাদের পাঠ করে। তারা আমাদের আচার-ব্যবহার দেখে। আমাদের জীবনব্যবস্থাই তাদের জানাশোনার মূল উৎস। তাই আসুন, আমরা সুন্নাহ অনুসরণ করে প্রকৃত মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করি। সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড
-এসআর