মুফতি আনিছুর রহমান:।। কুরআন সুন্নাহ গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত দিবসে পৃথিবীর সব মানুষকে মৌলিকভাবে চার ভাগে বিভক্ত করে বিচার কার্য পরিচালনা করবেন।
প্রথমত, যারা পৃথিবীর জীবনে মোটেও ঈমান গ্রহণ করেনি। যতই ভালো কাজ করুক না কেন তারা হিসাব ব্যতীতই জাহান্নামে যাবে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, “বলুন! আমি তোমাদেরকে কি সংবাদ দেব নিজেদের আমালের ক্ষেত্রে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা হল সেসব লোক; দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা সাধনা ব্যর্থ হয়ে গেছে আর তারা নিজেরা মনে করছে যে, তারা সঠিক কাজই করছে। তারা হল সেসব লোক, যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শন ও তাঁর সাথে সাক্ষাৎকে অমান্য করে।
যার ফলে তাদের যাবতীয় আমাল নিস্ফল হয়ে গেছে। কিয়ামাতের দিন আমি তাদের (কাজের) জন্য কোন ওজন কায়িম করব না (অর্থাৎ তাদের এসব আমাল ওজনযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হবে না)। এটাই তাদের প্রতিফল জাহান্নাম। কারণ তারা কুফুরী করেছে আর আমার নিদর্শন ও রসূলদেরকে হাসি-তামাশার বিষয় বানিয়েছে। (সুরা কাহাফ: ১০৩-১০৬)।
দ্বিতীয়ত, যারা পৃথিবীতে ঈমান গ্রহণ করেছিল। তাদের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহ বুখারী: ৫৭৫২)।
তৃতীয়ত, যারা ঈমান গ্রহণ করেছিল এবং দুনিয়ার জীবনে নেক ও পাপ উভয়টিই করেছে তবে তাদেরকেও আল্লাহ তায়ালার দয়া বা কোনো নবী বা শহীদ কিংবা নাবালক শিশু অথবা রোজা বা নেককার মানুষ কিংবা কুরআন এবং বিভিন্ন নেক আমলের সুপারিশের মাধ্যমে জান্নাত দেয়া হবে।
চতুর্থত, যারা ঈমান এনেছিল বটে এমনকিছু মারাত্মক গুনাহ দুনিয়ার জীবনে করেছিল। এবং তাদের ভাগ্যে আল্লাহর দয়া বা কোনো সুপারিশ না জুটার কারণে তাদেরকে সরাসরি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে সাজা ভোগ করতে হবে। যেসকল গুনাহের কারণে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে সে গুনাহ সমূহের কয়েকটি নিম্নরূপ:
১। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা। যারা অন্যায়ভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে তাদের যতই নেক আমল থাকুক না কেন; প্রথমে তাদেরকে জাহান্নামে যেতেই হবে।
এ সম্পর্কে হজরত যুবাইর ইবনু মুতইম রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহুল বুখারী:৫৯৮৪)।
অন্য বর্ণনায় হযরত আয়শা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রহিম অর্থাৎ আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্ক আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে। সে বলে, যে ব্যক্তি আমার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখবেন। আর যে আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আল্লাহ তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবেন। (সহীহুল মুসলিম: ৬৪১৩)।
২। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া। এ সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রাহ রাদিআল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকেনা, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহুল মুসলিম: ৭৬)।অপর এক হাদিসে আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অমুক মহিলা বেশি বেশি (নফল) নামায পড়ে এবং সিয়াম রাখে ও দান-খয়রাত করে বলে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু সে নিজ যবান দ্বারা (অসভ্য কথা বলে বা গালি দিয়ে) প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়।
তার ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? তিনি বললেন, সে দোযখে যাবে। লোকটি আবার বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অমুক মহিলা অল্প (নফল) নামায পড়ে ও সিয়াম রাখে এবং দান-খয়রাত করে বলে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু সে নিজ যবান দ্বারা (অসভ্য কথা বলে বা গালি দিয়ে) প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। তার ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? তিনি বললেন, সে বেহেশতে যাবে। (মুসনাদে আহমাদ: ৯৬৭৫)। এ হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিবেশী যে ধর্মের বা বর্ণেরই হোকনা কেন কোনোভাবেই তাকে কষ্ট দেয়া জায়েজ হবেনা।
৩। অহংকার করা। ইহা এমন একটি মারাত্মক গুনাহ যা আমলনামায় থাকলে যতই নেকি থাকুক আগে জাহান্নামে যেতে হবে। আমাদের চিরচেনা শত্রু ইবলিশ একমাত্র অহংকারের জন্যই অভিশপ্ত হয়েছিল। এ বিষয়ে কুরআনুল কারিমে একাধিক আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্যত, অহংকারীকে পছন্দ করেননা।” (সুরা লোকমান: ১৮)।
অন্যত্রে ঘোষণা করেন, “নিশ্চয় যারা অহংকারে আমার ইবাদতে বিমুখ তারা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্চিত হয়ে।” (সুরা গাফির: ৬০)। এবং হাদিসে কুদসীতে এসেছে ‘মহান আল্লাহ বলেন, অহংকার হলো আমার চাঁদর এবং মহত্ব হলো আমার লুঙ্গি। যে কেউ এর কোন একটি নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪০৯০)।
৪। অধিনস্থদের হক আদায় না করা ও খিয়ানত করা। আমরা প্রত্যেকেই স্বীয় জায়গা থেকে দায়িত্বশীল এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সচেতন থাকা আবশ্যক যেন কারো হকের ব্যপারে খিয়ানত না হয়ে যায়। কেননা হাদিসে এসেছে হযরত হাসান বসরি (রহঃ) থেকে বর্ণিত, আমরা মা’কিল ইবনে ইয়াসারের কাছে তার সেবা-শুশ্রূষার জন্য আসলাম।
এ সময় উবাইদুল্লাহ্ প্রবেশ করল। তখন মা’কিল রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, আমি তোমাকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করে শোনাবো যা আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি। তিনি বলেন, কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল আর তার মৃত্যু হলো এই হালতে যে, সে ছিল খিয়ানাতকারী। তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন। (সহিহুল বুখারী: ৭১৫১)।
এছাড়াও বহু গুনাহ এমন রয়েছে, যেগুলার দ্বারা মানুষ মুমিন হওয়া সত্বেও সর্বাগ্রে জান্নাতে না গিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এসকল গর্হিত কাজ সমূহ থেকে হেফাজতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতীব, পূবাইল বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ গাজীপুর ঢাকা।
-এটি